কী রেখে যাচ্ছি আমরা ওদের জন্য
প্রকাশ: ৮ মে ২০২২, ১৫:৩৬ | আপডেট : ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৩৮
গ্রামের মধ্যে একটি নতুন কাঁচা রাস্তা। সদ্য মাটি ফেলে ডোবা-নাল ভরাট করে, কারো বা ক্ষেতের ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে সে রাস্তা। নবনির্মিত সে রাস্তার ওপর মনের আনন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে একটি ছোট্ট শিশু। ছবিটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন এই রাস্তাটি শিশুটির সামনে নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এতদিন হয়তো সে বাড়ির উঠোনকেই তার জগৎ মনে করত। এই রাস্তাটি হওয়ায় সে বুঝতে পেরেছে, পৃথিবী অত ছোট নয়। বাড়ির পাশে নতুন রাস্তা পেয়ে শিশুটির মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে আমি জানি না। তবে সে যে আনন্দিত হয়েছে এটা বোঝা যায়। এই রাস্তাটির সামাজিক, অর্থনৈতিক বা যোগাযোগ ব্যবস্থায় কী গুরুত্ব রয়েছে বা পরিবর্তন আনবে সে ভাবনা শিশুটির মনে নেই। তার ভাবনায় শুধু আছে সে হেঁটে বেড়ানোর একটি নতুন জায়গা পেয়েছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এই ছবিটি পোস্ট করেছেন আমার উপজেলা শ্রীনগরের শ্যামসিদ্দি ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান নাজির হোসেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর এ রাস্তাটি তারই উদ্যোগে নির্মিত। আগে এখানো কোনো রাস্তা ছিল না। ফলে এই এলাকার মানুষকে বর্ষাকালে যাতায়াতের জন্য অবর্ণনীয় ুদর্ভোগ পোহাতে হতো এমন একটি উদ্যোগের জন্য এলাকাবাসী নিশ্চয়ই তাকে ধন্যবাদ দেবে। নাজির হোসেন আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের হলেও ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। শ্রীনগর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস জিএস ছিল সে । বড়ভাই হিসেবে আমাকে সে যথেষ্ট সম্মান করে।
নাজিরের পোস্ট করা এই ছবিটি আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত অর্থবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর দেশ বা সমাজ তৈরি করে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। আর সেজন্য একটি মসৃণ এবং প্রশস্ত পথ অগে তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমরা কি তা করছি বা করতে পারছি? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব যে না-বোধক হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু আমরা কী করছি? ভেবে দেখার চেষ্টা করি না, ব্যক্তিগত স্বার্থে যে কাজটি আমি বা আমরা করছি, তা সমষ্টিগতভাবে কতটা হিতকর। আমাদের ‘নৈতিকাতা’ এমন পর্যায়ে নেমেছে যে, আমরা শুধু ‘আমার’ শব্দটি ছাড়া আর সব যেন ভুলে যেতে বসেছি। ঠিক যেন ‘হাশরের ময়দান’। সবাই ‘ইয়া নফসি’ জপছি। আশপাশে তাকানোর কোনো প্রয়োজন কেউ বোধ করছি না। আমার চলায়-বলায় কাজকর্মে পাশেরজনের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, ক্ষতি হচ্ছে কিনা, সে খেয়াল করার মতো ফুরসতও আমাদের নেই। লক্ষ্য একটাই- নিজের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখা, স্বর্থোদ্ধারে প্রয়োজনে অনৈতিকতার সর্বনিম্ন প্রয়ায়ে নেমে যাওয়া।
গত ৪ মে আমরা মহাসমারোহে উদযাপন করলাম ঈদুল ফিতর। এটা জানা কথা, ঈদুল ফিতর আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব। চারদিকে উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে যায় রোজা আসার পরপরই। সবাই প্রস্তুতি নেন কঠোর সংযম সাধনার পর আনন্দ উপভোগের। গত দুই বছর আমরা সে আনন্দ থেকে বি ত ছিলাম। সর্বনাশা করোনা আমাদের সে আনন্দে সাময়িক বিরতি ঘটিয়েছিল। এবার করোনা প্রকোপ সীমিত হওয়ায় আমাদের আনন্দের জোয়ার বাঁধ ভেঙে নেমেছিল। যত দুঃখ-কষ্টই থাকুক, সামর্থ্য যতই সীমিত হোক, আমরা চেষ্টা করি সে আনন্দ উপভোগের। কিন্তু এবার ঈদের আগে সে আনন্দ অনেকটাই নিরানন্দে পরিণত হয়েছিল। হঠাৎ বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল ভোজ্য তেল সয়াবিন। বাজারে এক ফোঁটা সয়াবিন তেলও নেই! কী আশ্চর্য! এ যেন ভোজবাজীর খেলা! সয়াবিন তেলের পদাংক অনুসরণ করে উধাও হলো তরল দুধও। কোনো দোকানেই এক প্যাকেট তরল দুধ পাওয়া যায়নি। কেন এমন সংকট? এর নতুন কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। কেননা, আমরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকটাই অভ্যস্ত। অতীতে বাজারে এমন পণ্য-সংকটের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। কারা কেন এ ধরনের সংকট তৈরি করে তা বুঝতে সক্রেটিস হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অক্ষর জ্ঞানহীন একজন মানুষও বলে দিতে পারে কারা এই কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে, কেন করে। অতি মুনাফালোভী কতিপয় ব্যবসায়ী যে এর পেছনে ‘নারদ’-এর ভূমিকা পালন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে নিজেরদের ট্যাঁকের স্বাস্থ্য বৃদ্ধিই তাদের মূল টার্গেট। সাধারণ মানুষের কী হলো, তারা খেতে পেলো কীনা, এসব বিবেচনার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না। এবার সেই বাজার সিন্ডিকেটের সাথে যোগ হয়েছিল সায়াবিন তেল উৎপাদনকারীদের কারসাজিও। এই তেল সংকটের কারণ কি জানতে চয়েছিলাম আমার পরিচিত এক ব্যবসায়ীর কাছে। তিনি জানালেন, দোকানিরা বারবার চাহিদার কথা জানালেও উৎপাদনকারী কর্তৃপক্ষ বাজারে তেল ছাড়েনি। কেন তাদের এমন নতিবাচক সিদ্ধান্ত? তাদের তো পণ্য বেশি উৎপাদন ও বাজারজাত করার কথা। কারণ যত উৎপাদন-বিক্রি, তত লাভ। ব্যবস্য়াী ভদ্রলোক জানালেন, এটা হলো তেলের দাম বাড়ানোর জন্য একটা কারচুপি। বুঝলাম, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে তারা এখন দাম বাড়ানোর দাবি তুলবে। অথচ এটা একটা পাঁয়তারা বৈ কিছু নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দাম বেড়েও থাকে, সে বাড়তি দামের তেল তো এখনও বাংলাদেশে আমদানি করা হয়নি! তাহলে কেন এই দুস্কর্ম? এ যেন সেই রাজনৈতিক ব্লেম গেমের প্রতিরূপ। এক সময় আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের দিকে ‘দিল্লতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে’, ‘মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা মেলে’ বা ‘পিকিংয়ে (বেইজিং) বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে’ ইত্যাদি কটাক্ষ করত। তেমনি কথিত আন্তর্জাতিক বাজারে বৃষ্টি নয়, আকাশ মেঘ জমলেই আমাদের দেশের কারবারিরা ছাতা নয়, ত্রিপলের সামিয়ানা খাঁটিয়ে বসে থাকে। আমরা জনগণ সেই সামিয়ানার নিচে কল্লাটা গুঁজে দিতে বাধ্য হই নিরুপায় হয়ে। আর তারা সেই কল্লার ওপর দামের কোপ মেরে রক্ত পানি করা টাকাটা হাতিয়ে নেয় মহাআনন্দে। আশ্চর্য বিষয় হলো, এতবড় অন্যাযের পরও তারা বুক ফুলিয়ে সমাজে বিচরণ করে! বিকচরণ শুধু নয়, রীতিমতো সমাজকে কাঁপিয়ে দাঁপিয়ে বেড়ায়। আমরা গোবেচারা জনগণ তা চেয়ে চেয়ে শুধু দেখি। মনের ক্ষোভ মনে পুষে হৃদরোগ বাড়াই।
কত কথা শুনি প্রতি রোজ! এই করব, সেই করব। হাতি মারব, ঘোড়া ধরব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অশ্বডিম্ব। বড় বড় মানুষেরা কত বড় বড় বুলি কপচান- এটা বরদাশত করা হবে না, ওটা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না ইত্যাদি। আমরা সেসব কথা শুনি। শুনে পুলকিত হই, আশায় বুক বাঁধি- এইবার বুঝি সমাজটা একটা নিয়মের মধ্যে আসবে। খারাপ লোকগুলো দমিত হবে। কিন্তু এই প্রত্যাশার ঘোর কেটে যায় কিছুকাল পরেই। চোখ কচলে দেখি যথা পূর্বং তথা পরং। আগে যা ছিল তার কোনো পরিবর্তন নেই। না, ভুল বললাম। পরিবর্তন হয়। তবে তা ইতিবাচক না, নেতিবাচক। খারাপ লোকগুলো শাস্তি পায় না, বরং তাদের আরো বাড়-বাড়ন্ত হয়। এই যে বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেল, সেজন্য ভাবছেন কাউকে জবাবদিহি করতে হবে? কেউ শাস্তি পাবে এই জনদুর্ভোগ সৃষ্টির জন্য? মোটেই না। ক’দিন পরে বাজারে সয়াবিন তেলের মহাপ্লাবন দেখা দেবে। কিন্তু আগের দামে আর পাবেন না। নতুন দামে পুরানো সয়াবিন তেল কিনে আমাদের ধন্য হতে হবে। মুখে খিস্তি-খেউড় আওড়াতে পারবেন। তাতে লাভের লাভ হবে নিজের মুখটা নষ্ট হওয়া। দূরে বসে যারা কলকাঠি নাড়ছে, তাদের গায়ে একটু আচড়ও লাগবে না। ভাবছেন এসব আমার মুখস্ত বিদ্যা? না, বাস্তবতা থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানের উদগীরণ। শুধু আমার নয়, এদেশের সব সাধারণ নাগরিকের এই একই অভিজ্ঞতা। আমি আবার ‘পষ্ট (স্পষ্ট) কথায় কষ্ট নাই’ নীততে বিশ্বাসী। তাই বলে ফেলি যখন যেটা দরকার মনেকরি। জানি এসব ‘ফালতু কথায়’ কান দিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নেই। তারা ব্যস্ত আছেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব বড় বড় বিষয় নিয়ে। সেখানে এসব ছোট ছোট বিষয় কি ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে? আর জনগণের কথা বলছেন? আরে সাহেব, নিজেরাই যখন মহাশক্তিধর তখন জনগণ কী কাজে লাগে? ভোটের সময়? না এখন তাও লাগে না। ওই সময় জনগণ জনগণের জায়গায় থাকে। আর ভোট ভোটের জায়গায় চলে যায়। জনগণকে আর কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয় না। কথাগুলোতে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন? তা একটু তো আছেই। সবকিছুর নিয়ন্ত্রক যেখানে রাজনীতি, সেখানে সব ব্যাপারেই রাজনীতির সুবাস তো থাকবেই। ঈদের আগের দিন দেখলাম আমাদের কর্তৃপক্ষ সয়াবিন তেল উদ্ধারের অভিযানে নেমেছে। এই অভিযান কি এক সপ্তাহ আগে শুরু করা যেত না? তারা কি বাজার থেকে সয়াবিনের অন্তর্ধানের খবরটি জানতেন না? আসল এত কথা বলে লাভ নেই। কেউ জবাব দেবে না। কথাগুলো কিছুক্ষণ ইথারে ভেসে এক সময় মিলিয়ে যাবে।
তবে বিরাজমান অব্যবস্থা নতুন প্রজন্মের ওপর যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলছে তা বিবেকবান মানুষ অনুভব করছেন ভালোভাবেই। কেন আমাদের তরুণ-যুবারা বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য এমন পাগলপারা হয়ে উঠেছে, তা কি আমরা কখনো তলিয়ে দেখেছি? প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে দেখি ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার আশায় নৌকায় সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে হতভাগ্যদের সলিল সমাধির খবর। কেউ কেউ বন্দী হয় বিদেশের কারাগারে। ক’দিন আগে খবর বেরিয়েছিল, ইউরোপে যাবার আশায় প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি যুবক দুবাইয়ে আটকে আছে। তাদের অধিকাংশ রাত কাটাচ্ছে বিভিন্ন পার্কে। কেন বিদেশ গমনের জন্য এই উদভ্রান্তের মতো ছুটে যাওয়া? কারণ একটাই। জীবনের নিশ্চয়তা খোঁজা। সে নিশ্চয়তা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক। সমাজ এখন আর আগের মতা নিরাপদ নেই। এই নিরাপত্তাহীনতার দায় কারো একার নয়। এ দায় সবার। আমরা পারছি না এ সমাজকে, নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করতে। তাদেরকে ভরসা দিতে- এখানে তোমাদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা আছে। তোমরা থাকো এই প্রিয় পিতৃভুমিতে। আমরা তা বলতে পারছি না।এটা আমাদের নিদারুণ ব্যর্থতা।
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘ছাড়পত্র কবিতায় বলেছেন- ‘এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আিম- / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ কিন্তু আমরা সে অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারিনি। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সমাজ আমরা তৈরি করে যেদে পারছিনা। ছোট ভাই চেয়ারম্যান নাজিরের উদ্যেগে তৈরি হওয়া নতুন রাস্তাটি যে শিশুটির চোখের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, ভবিষ্যতে তার চলার পথটি তেমন মসৃণ থাকবে কিনা আমরা বলতে পারি না। আর এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত