লৌহজং উপজেলা প্রশাসন ও অবারিত বাংলার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ
প্রকাশ: ২ জুন ২০২২, ১২:৩৭ | আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৬
২৬ মে লৌহজং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অবারিত বাংলা নামক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের সহায়তায় লৌহজং বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে দিনব্যাপী বিজ্ঞান বিষয়ে সেমিনার হয়েছে। এ উদ্যোগটি আমার কাছে অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়েছে।
বিষয়টি একই সঙ্গে আনন্দেরও বটে। আনন্দের এ কারণে যে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে আনন্দের খবর বড় একটা পাইনা। এই সময়ে বিজ্ঞান নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা এবং শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তরের অনুষ্ঠান আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করে বৈ কি। এমন একটি আয়োজনের জন্য উদ্যাক্তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন,অধ্যাপক ইয়াসমিন হক।
দিনভর বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনায় প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ অংশ গ্রহণ করেন।
বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মাত্র নয় মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু জাতিকে একটি আধুনিক সংবিধান উপহার দেন। তাতে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ মূলনীতির আদর্শ ধরে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। শাসনতন্ত্রে ঘোষিত মূল নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু ড. কুদরত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।
এ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে সুপারিশ ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রাধান্য ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার।
কিন্তু শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের আগে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ ও চেতনাকে পদদলিত করে বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে উল্টোপথে-পাকিস্তানি ধ্যান ধারনার লাইনে।
এর ধারাবাহিকতায় হেফাজতে ইসলামের প্ররোচনায় স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস থেকে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি লেখকদের কবিতা,প্রবন্ধ, গল্প যা যুগ যুগ ধরে স্কুলে পাঠ্য ছিল তা বাদ দেওয়া হয়েছে।হালাল হারামের অংক সহ উদ্ভট সব বিষয় সিলেবাসে যুক্ত করে আইয়ূব মোনায়েমি কায়দায় আমাদের নতুন করে মুসলমান বানানে হচ্ছে।
১৯৭৬ সালে শুরু হয় সামরিক শাসকদের অন্যতম বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী সীরাত সম্মেলনের মাধ্যমে ওয়াজ। যার মূল সুর ছিল বাংলাদেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম করা।
মাওলানা ভাসানীর এক শাসানিতে জিয়াউর রহমান তোওয়াবকে দেশ ছাড়া করেন। একই সময়ে তৎকালীন শাসকরা দেশব্যাপী আয়োজন করে প্রদর্শনীর নামে যাত্রা হাউজি ও লাকি খানের উলঙ্গ নৃত্য।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে সামাজিক ন্যায় বিচার ও ধর্ম নিরপেক্ষতার স্থানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেন জিয়াউর রহমান। এর ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চরিত্র ধারণ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের। যার ষোলকলা পূর্ণ করেন দ্বিতীয় সেনাশাসক লে. জে. হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সংবিধানে সংযোজনের মাধ্যমে।
এর ধারাবাহিকতায় দেশের সর্বত্র ধর্মান্ধতা ও গোড়ামি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পরবর্তীতে ধর্মান্ধ জঙ্গী তৎপরতায়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে মুন্সীগঞ্জ বাদে সারা দেশে বোমা বিস্ফোরণ ও ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জনের ফলে জঙ্গী উত্থানের কারণ বলে আমার ধারণা।
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজনের প্রতিক্রিয়ায় দেশের হিন্দু, খৃস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা গঠন করেন তিন ধর্মাবলম্বীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের বিপরীতে বিএনপি জাপার সর্মথন নিয়ে গঠিত হয় হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য ফ্রন্ট।
যা প্রকৃত পক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রের পরিপন্থি। এসব সংগঠন রাজনৈতিক না হলেও এখানে উদার প্রগতীশীল বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকে সাথে নেয়া উচিত ছিলো
জামায়াতে ইসলামীর মত জাতীয় হিন্দু মহাজোট গঠন ও মৌলবাদের এপিঠ ও পিঠ।
এসব কারণে দেশবাসীর মননে সেকুলার চেতনা হ্রাস পায়। দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতায়ও এর প্রভাব পড়ে । ডিগ্রী পর্যায়ে বিজ্ঞান শীক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পায়।
বিবিএ, এমবিএ পড়ার দিকে সবাই ঝুঁকছে। হ্রাস পায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
পাকিস্তান আমলে ও বঙ্গবন্ধুর আমলে শহর-গ্রামের স্কুল-কলেজে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশ নিত। শিশু সংগঠন খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর, চাঁদের হাট, মুকুল ফৌজের শাখা ছিল দেশের সর্বত্র। এসব কর্মকাণ্ড আমাদেরকে একতাবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল বিধায়, ১৯৭১ সালে আমরা হিন্দু ,মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃস্টান পরিচয়কে বড় করে না দেখে সবাই বাঙালি হয়েছিলাম। যার ফলে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের পর থেকে দেশে ধর্মীয় রাজনীতি চালু হওয়ায় আমরা বাঙালি পরিচয়কে তাড়িয়ে আবার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান হয়ে ওঠেছি।
এ ধারা থেকে জাতিকে রক্ষার একমাত্র উপায় ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান পাঠে উদ্বুদ্ধকরণ। সে কাজটির সূচনা হলো লৌহজং উপজেলায় । দেশের সব উপজেলায় এ চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত