কাগমারী সম্মেলনের উত্থাপিত সুদূরপ্রসারী প্রস্তাবের ফলাফল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ১৬:৪০

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সংক্ষেপে মাভাবিপ্রবি) বাংলাদেশের একটি সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় নামেও পরিচিত। ১৯৯৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত টাঙ্গাইলের সন্তোষে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের ১২তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশের কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নামানুসারে। এখানকার পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি। পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য এখানে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রতি বছর স্নাতক পর্যায়ে প্রায় ৮১৫ জন শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়। শিক্ষকের সংখ্যা সাকুল্যে ২৪৩ জন।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। তিনিই ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেন নি, অবশেষে ১৯৭০ সালে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মাওলানা ভাসানী "আমার পরিকল্পনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়" শিরোনামে লিখিত নিবন্ধের মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত প্রস্তাব করেন। তিনি জীবদ্দশায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি, কিন্তু তিনিই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় কাজ শুরু করে যান।

১৯৮২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ভাসানীর শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনায় একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বের ১২ সদস্যবিশিষ্ঠ একটা কমিটি গঠন করে দেন। উক্ত কমিটি ১৯৮৩ সালে ২২ মে সদুরপ্রসারী সুপারিশ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাবিদ ডক্টর মীর ফকরুজ্জামানকে চেয়ারম্যান ও সৈয়দ ইরফানুল বারীকে সদস্যসচিব করে ৯ সদস্যবিশিষ্ঠ সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (সইবি) ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে দেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন জটিলতাই কার্যক্রম আর সামনে এগায় নি।

১৯৯৬ সালে সরকারি উদ্যোগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারের প্ররিকল্পনা গ্রহণ করে। এর অংশ হিসাবে টাঙ্গাইলে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ১৯৯৭ সালে এডিবির আর্থিক সহায়তায় তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় পুরাতন জেলাগুলোতে (যেগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় নেই) একটি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থাপনের। এর পরিপ্রক্ষিতে সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (সইবি) ট্রাস্টি বোর্ড সরকারের নিকট সন্তোষেই একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে ট্রাস্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব আজিজ-উল-হক, ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর এস এইচ কে ইউসুফজাই, সদস্যসচিব সৈয়দ ইরফানুল বারী, টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মোঃ সামসুল হক ও অত্র এলাকার গণ্যমান্য বাক্তিদের প্রচেষ্টায় অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সন্তোষে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ পেশ করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক ২০০০ সালে অধ্যাপক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য নিয়োগ পান কিন্তু তিনি প্রকল্প পরিচালক পদে যোগদান করেন নাই। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার বুয়েটের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল হককে ৭ জানুয়ারি, ২০০১ সালে নিয়োগ দেন।

অধ্যাপক ড. আমিনুল হক সর্বপ্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ৯ জানুয়ারি ২০০১ সালে যোগদান করেন। ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর অধ্যাপক ড. মোঃ ইউসুফ শরীফ আহমেদ খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের অধীনে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি - বিভাগ দুটি নিয়ে এর দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়।

২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর এর শিক্ষায়তনিক কার্যক্রম শুরু হয় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের সর্বমোট ৮৩ জন শিক্ষার্থী এবং ৫ জন শিক্ষক নিয়ে। প্রায় ৮ মাসের শিক্ষায়তনিক সময় পর পরিবেশ বিজ্ঞান এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং অপরাধবিদ্যা এবং পুলিশ বিজ্ঞান নামক দুটি নতুন বিভাগ খোলা হয় জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে। ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অনুষদের অধীনে টেক্সটাইল প্রকৌশলে ও জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে জৈবপ্রযুক্তি এবং জেনেটিক প্রকৌশল এবং খাদ্য প্রযুক্তি এবং পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়।

২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীনে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ও সাধারণ বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে গণিত ও পরিসংখ্যান, রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ হতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে অর্থনীতি বিভাগ যাত্রা করে। ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষে জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে যুক্ত হয় ফার্মেসী ও জৈব রসায়ন এবং আণবিক জীববিদ্যা বিভাগ দুটি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়টি টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে মাওলানা ভাসানীর স্মৃতিধন্য সন্তোষে অবস্থিত। এই ক্যাম্পাসের আয়তন প্রায় ৭০.৬৯ একর। এই জায়গার ভেতরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদ, প্রশাসনিক ভবন, সাতটি আবাসিক শিক্ষার্থী হল, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ ইত্যাদি অবস্থিত। এছাড়া ক্যাম্পাসের অধিভুক্ত জায়গার ভেতরই মাওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মিত ঐতিহাসিক দরবার হল, প্রখ্যাত সুফি সাধক পীর শাহ্ জামানের নামানুসারে পীর শাহ্ জামান দীঘি, মাওলানা ভাসানীর মাজার, একটি মসজিদসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এই অধিভুক্ত জায়গা ছাড়াও সন্তোষের অদূরে রথখোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-সম্পত্তি রয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের আবাসন প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) বাদে প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস হয়ে থাকে। প্রায়শই শিক্ষার্থীদের জন্য নানান জায়গায় শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৭টি আবাসিক হল রয়েছে, যার মধ্যে ৪টি ছাত্রদের জন্য এবং বাকি ৩টি ছাত্রীদের জন্য। নানারকম আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ আরো কয়েকটি হল স্থাপনার বিষয়গুলো বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবরকম প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে এর প্রশাসনিক কার্যালয়। প্রশাসনিক কার্যালয়ের অধীনস্থ আরো নানারকম উপবিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া রয়েছে একটি শারীরিক শিক্ষা বিভাগ, যেটি শিক্ষার্থীদের জন্য যাবতীয় খেলাধুলার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক চর্চা কেন্দ্রটি পরিচালনা করে শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার সুবিধাদি প্রদান করে।

বছরজুড়েই ক্যাম্পাসে নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলে এবং বিশেষ দিবস উদযাপিত হয়। যেমন - আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মাওলানা ভাসানীর জন্ম ও প্রয়াণ দিবস, পহেলা বৈশাখ, বসন্ত বরণ ইত্যাদি।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নানারকম সেমিনার বা কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজিত হয়ে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা আমন্ত্রিত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের জ্ঞান ভাগাভাগি করে নেবার সুযোগ পান।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত