নারীর পোশাক, শরীর এবং পুরুষ মনস্তত্ত্ব

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি 

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৫ |  আপডেট  : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৮

‘প্রিয় নারীঃ সভ্য দেশে “পুরুষ দৃষ্টি”র জন্য আপনার পোশাক কি ঠিক আছে?

 

'পুরুষ দৃষ্টি' শব্দটিকে নারীদের এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলা উচিত যেন এই ধারণাটি তার শক্তি হারায়। 'পুরুষের দৃষ্টি', "পুরুষদের খুশি করে এমন কিছু" এর সমার্থক। যদি কোনও মহিলা পুরুষদের রুচি পূরণের অভিপ্রায়ে পোশাক পরিধান করেন, তবে তিনি নিজেকে পুরুষের দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করেন। 'দৃষ্টি'র প্রয়োগটি মানুষের আচরণ সম্পর্কে অনেক কিছুকে ব্যক্ত করে। পুরুষদের খুশি করার জন্য পোশাক পরিধান করা কি সত্যিই নারীর উচিত? নারী কি পোশাক পরিধানে পুরুষদের আত্ম-ধারণা এবং আচরণকে বা জৈবিক আকাঙ্ক্ষাকে সত্যিই প্রভাবিত করতে পারে?

গত ১৮ মে সকালে নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দুই তরুণ ও এক তরুণী। মেয়েটির পরিধানে ছিল জিন্স প্যান্ট ও স্লিভলেস টপস। পোশাকের কারণে ওই তরুণীকে হেনস্তা করা হয়। সে প্রসঙ্গ নিয়ে উচ্চ আদালত প্রশ্ন রেখেছেন- “সভ্য দেশে এমন পোশাক পরিধান করে রেল স্টেশনে যাওয়া যায় কিনা।” উচ্চ আদালতের আদেশের পর আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, “আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গুলশান–বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না। সেখানে গ্রামের মতো একটি জায়গায় পাবলিক প্লেসে এ রকম পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না। যেমন খুশি তেমন পোশাকের নামে আমাদের সোসাইটির কালচারকে ধ্বংস করতে পারে না। ওই মেয়ে যে ধরনের পোশাক পরিহিত ছিল সেটা আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার সঙ্গে বেমানান। যে কারণেই প্রতিবাদের শিকার হয়েছিল।”

উচ্চ আদালতের বিচারপতির মন্তব্য সংবিধান ও বিদ্যমান মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। সাতটি মানবাধিকার সংগঠনের এই জোটের সমন্বয়ক তামান্না হক এক বিবৃতিতে বলেন, “উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময়ে নারীর অধিকার, স্বাধীনতা রক্ষায় ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রায় ও নির্দেশনা প্রদান করে আসছেন। তবে একজন বিচারপতির সাম্প্রতিক এ বক্তব্য এসব অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে।” বুধবার ১৭ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আসক জানিয়েছে, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানতে পেরেছে যে নরসিংদী রেল স্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্তার প্রসঙ্গ নিয়ে উচ্চ আদালত প্রশ্ন রেখেছেন- ‘সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেল স্টেশনে যাওয়া যায় কিনা।’ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মহামান্য উচ্চ আদালতের বক্তব্য যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা যদি সত্য হয় তবে তা নারীর সমানাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার মানদণ্ড এবং বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়।”

মহিলারা শুধুমাত্র পুরুষদের দৃষ্টিতে নয় বরং 'মহিলা দৃষ্টির' জন্যও পোশাক পরেন - নির্দিষ্ট ফ্যাশন প্রবণতা বা তাদের বন্ধুদের বৃত্তের সাথে মানানসই পোশাক পরিধান করেন। প্রশ্ন হলো, সমাজের একজন নারীর শরীরকে কীভাবে দেখা উচিত? প্রাচ্য হোক বা পশ্চিম, ইসলাম হোক, বৌদ্ধ হোক বা হিন্দু বা খ্রিস্টান ধর্মই হোক দেশে জনসমক্ষে নারীদের জন্য উপযুক্ত পোশাক কী বলে বিবেচিত হয় তা পুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত হয়ে আসছে। সর্বোপরি, এই সামাজিক নিয়ম এবং পোশাক কোডগুলির জন্য দায়ী যুক্তিগুলি এই দর্শন থেকে উদ্ভূত যে, “একজন মহিলা তার শরীরের নির্দিষ্ট অংশকে 'পুরুষ দৃষ্টি' থেকে আড়াল করে রাখবেন।”

সমাজের এই ধারণা যে পরিমিত পোশাক পরা বা রক্ষণশীলভাবে পোশাক পরা নারীদের 'পুরুষ দৃষ্টি' এবং পুরুষের জৈবিক আকাঙ্ক্ষার হয়রানি এবং আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু তা কি সত্য? আমাদের দেশে রাস্তায় বা পাবলিক পরিবহনে রক্ষণশীলভাবে পোশাক পরা নারীও পুরুষ দ্বারা হয়রানি ও ধর্ষনের শিকার। পাকিস্তানের একজন তরুণ আফগান শরণার্থী তার বোনের সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য হাঁটছিলেন, যিনি বোরকা পরা ছিলেন। ছেলেটি বর্ণনা করেছেন কিভাবে পুরুষরা তার বোনের সম্পর্কে যৌন অবমাননাকর মন্তব্য করেছিল। ইরানে মহিলারা পুরুষদের অশ্লীল দৃষ্টি এবং অশ্লীল মন্তব্য শোনার ভয়ে একা হাঁটাও এড়িয়ে চলেন। পাকিস্তান সমমা টিভি চ্যানেল লাহোরের রাস্তায় এক সামাজিক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, রাস্তায় শালীন পোশাক পরা একজন একা নারী কিরূপ পুরুষের অশ্লীল দৃষ্টি ও মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্রের রাষ্ট্র ভারতের নারীরা নিয়মিতভাবে "ইভ-টিজিং" এর শিকার হয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি শব্দ যা নারীদের পোশাক, আচরণ বা চেহারা নির্বিশেষে প্রকাশ্য স্থানে বিভিন্ন ধরণের যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতাকে বোঝায়। ভারতে মহিলাদের পরা দুটি জনপ্রিয় পোশাক, শাড়ি এবং সালোয়ার, উভয়ই রক্ষণশীল। তবুও এটি তাদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়া থেকে বিরত রাখে না, অনেকটা তেহরানের ইরানী নারীদের অভিজ্ঞতার মতো।

ইসলামিক ঐতিহ্যগত ভাবে মহিলারা বোরকা ও হিজাব পরেন। কারণ ইসলামিক ঐতিহ্যগত ভাবে নারীদের পোশাকের নিয়ম হল শালীনতা। হিজাব শব্দের অর্থ হল "পর্দা," ৷ সুতরাং কোন নারী শালীনতার জন্য বোরকা ও হিজাব পরলে তাকে বাঁধা দেয়ার অধিকার রাষ্ট্র বা সমাজের নেই। তেমনই যেকোন নারী শাড়ি, স্কাট, টি শার্ট, স্নিকার এবং জিন্স পরতে পারে। শাড়ি এবং সালোয়ার, বোরকা ও হিজাব এর মতন শালীন পোশাক পরা নারীদের পুরুষদের চোখে ও মনে যৌন তৃপ্তির বস্তু হয়ে উঠতে সাহায্য করবে না এর কোন প্রমাণ নেই।

আমাদের সমাজে পুরুষরা নারীদের কিভাবে দেখবেন বা প্রকাশ করবেন তার মালিকানা তারা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা দৃষ্টি দিয়ে হোক, অশ্লীল মন্তব্যে হোক বা শারীরিকভাবে সহিংসতার মাধ্যমেই হোক। কারণ পুরুষদের তাদের জৈবিক আকাঙ্ক্ষার উপর নিয়ন্ত্রণ নেই । নারীবাদী আন্দোলন এখন অনলাইনে সোচ্চার। ২১ শতকের অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের মতোই, নারীরা সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য মোকাবেলায় বিশেষভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। পর্দা সম্পর্কে গণতান্ত্রিক আলোচনাকে স্বাগত জানাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনসাধারণকে একজন নারীর স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে হবে শুধুমাত্র তার নিজের পোশাকের রূপই বেছে নেওয়ার জন্য নয় বরং সর্বক্ষেত্রেই।

সমাজে ড্রেস কোডগুলি অল্প বয়স থেকেই মহিলাদের শেখায় যে তাদের দেহ লুকিয়ে রাখতে হবে। চামড়া দেখানোর জন্য "সঙ্কুচিত" হতে হবে, মেয়েদের শরীর উত্তেজক, ক্লিভেজ এবং উরু ঢেকে রাখতে হবে। সমাজে পোশাক কোড মেয়েদের শেখায় যে তাদের শরীর একটি বস্তু এবং তারা পুরুষতান্ত্রিক অশ্লীল দৃষ্টিতে বন্ধি। যৌন সহিংসতার বিষয়ে আমাদের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। নারীর পোশাক নিয়ে নারীদের এবং আচরণকে দায়ী করা , লাঞ্ছিত করা এবং যৌন সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়। যৌন হয়রানি এবং লাঞ্ছনা আমাদের সমাজে একটি খুব বড় সমস্যা। আমাদের দেশে নির্যাতিত নারীদের দোষারোপ করার সংস্কৃতি রয়েছে। যে মহিলারা যৌন হয়রানি এবং সহিংসতার অভিযোগ করেন তারা তাদের বন্ধু, সহকর্মী, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও ভাল সমর্থন পান না।

ঢাকা শহরে টিএসসি প্রাঙ্গনে নববর্ষ উদযাপনের রাতে বাঁধনকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল, তখন অনেকেই বাঁধনকে দায়ী করেছিলেন। নারী স্কাট, টি শার্ট, স্নিকার এবং জিন্স পরবে কেন? 'পুরুষ দৃষ্টি' তো পরবেই। নারী শাড়ি পরলে শরীরের কিছু অংশ দেখা গেলে তা ঢং উগ্রতা নয় কেন? সালোয়ার পরে ওড়না কেন পরবে না? ওড়না না পরলে 'পুরুষ দৃষ্টি' তো বুকের দিকে পরবেই। নারী স্কাট, টি শার্ট, স্নিকার এবং জিন্স পরবে কেন? পুরুষের জৈবিক আকাঙ্ক্ষা জাগবে শরীরে হাত দেবে। মেয়েটা দুই পা ফাঁকা করে সোফায় বসে বা মোটরসাইকেল চালায় বা পেছনে বসে কেন? এ নারীর স্বভাব ভালো না। নারী তার পুরুষ সহকর্মী বা বন্ধুর সাথে বাহিরে যায় কেন? এ নারী চরিত্রহীন। নারী একা রাতে চলাচল করে, তাই ধর্ষিত হয়? কিন্তু বোরকা ও হিজাব বা পর্দা করলেও কি নারী 'পুরুষ দৃষ্টি' পুরুষের জৈবিক আকাঙ্ক্ষা বা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির থেকে রক্ষা পাবে? শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালে হেফাজত যখন নাদিয়া ও ৩ জন নারী সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল, তখন দেশের অনেকেই এমনকি সুশীল সমাজ মন্তব্য করেছিল, হেফাজতীরা ধর্ম নিয়ে কাজ করে, তাদের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে মেয়েদের পাঠানোর দরকার কী ছিল? 

আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বিরোধি আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং এমন প্লাটফর্ম তৈরী করতে হবে যেখানে মহিলারা তাদের অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করবে। তাদের কথা বলার, শোনার এবং সমর্থন করার জায়গা তৈরী করতে হবে এবং যার মাধ্যমে অপরাধীদেরকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে ৷ যৌন হয়রানি এবং যৌন সহিংসতার চারপাশে নীরবতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। যৌন হয়রানি এবং যৌন সহিংসতার বিষয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে হবে এবং ভুক্তভোগীরা যাতে কথা বলতে পারবে এবং তাৎক্ষণিক সমর্থন পেতে পারে। প্রিয় নারীঃ “পুরুষ দৃষ্টি”র জন্য আপনার পোশাক নির্ধারণ করা উচিত নয়, আপনার পোশাক দায়ী নয়, বরং পুরুষের জৈবিক আকাঙ্ক্ষা দায়ী।

 

লেখকঃ কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত