স্মৃতিতে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট

  মো. জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২১, ১১:৪৮ |  আপডেট  : ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৩:৩৭

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা ভাবলে এখনও বেদনায় ন্যূয়ে পড়ি। আমি জুলাই মাসে মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ কেন্দ্রে বিএ   পরীক্ষা দিয়ে শ্রীনগরে ফিরে খেলাঘর আসরের সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাই। আমরা যখন মুন্সিগঞ্জে বিএ পরীক্ষা দিই তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ও মেজপুত্র শেখ জামালকে বিয়ে দেন। খবরের কাগজে ছবি দেখে আমরা তা জানতে পারি।

আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে শ্রীনগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ধূমকেতু খেলাঘর আসরের সম্মেলনের মঞ্চ নির্মাণ, আমন্ত্রণপত্র বিতরণ নিয়ে আমরা খুবই ব্যস্ত। ১২ ও ১৩ আগস্ট বাকশালের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে দুটি জনসভা করেন বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জাতীয় সংসদের তৎকালীণ চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রথম সভাটিতিনি করেন বেলতলী জি জে উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। এ সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। অন্যান্য কথার মধ্যে তাঁর একটি কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে । তিনি বলেছিলেন-‘বঙ্গবন্ধু আমাকে যদি চৌকিদারের দায়িত্বও দেন তা আমি বিশ্বস্ততার সাথে পালন করবো।’ ১৩ আগস্ট সকালে তিনি স্পিডবোট নিয়ে মজিদপুর দয়হাটার কফিলউদ্দিন চৌধুরী সাহেবের বাড়ি গিয়ে চাঁন মস্তান সাহেবের সাথে দেখা করেন। শ্রীনগর ফিরে আসার পরে তাঁকে আমরা বিদায় জানাই। তিনি ভাগ্যকুলে জনসভা করে নৌপথে ঢাকা ফিরেন।

১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় খেলাঘর আসরের সম্মেলনের প্রধান অতিথি রনেশ দাস গুপ্তকে নিয়ে ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে শ্রীনগর পৌঁছেন খেলাঘরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বর্তমানে স্বনামধন্য াংবাদিক ফরিদ আহমদ ও আমার সহপাঠি দিলওয়ার হোসেন।

রনেশ দাদার খাবার ও থাকার ব্যবস্থা আমরা করি শ্রীনগর কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ওয়ালিউল ইসলাম খানের বাসায়।তিনি তখনও অবিবাহিত ছিলেন বিধায় সকল অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথিদের থাকা ও খাওয়ার দায়িত্ব আমরা তাঁর ওপর চাপিয়ে দিতাম। তিনি আমাদের এসব ব্যাপারে সব সময় সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন শ্রীনগর ধূমকেতু খেলাঘর আসরের প্রধান উপদেষ্টা।গত ১১ জুন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় ইন্তেকাল করেন।

১৪ আগস্ট দিনব্যাপী খেলাঘর আসরের সম্মেলন,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নতুন কমিটি গঠনের কাছে আমরা ব্যস্ত থাকি। রাতে রনেশ দাদাকে অধ্যক্ষ স্যারের বাসায় পৌছে দিয়ে আমরা বিদায় নিয়ে বাড়ি যাই।

১৫ আগস্ট সকালে  নাশতা করার পরে দাদাকে লঞ্চ উঠিয়ে বিদায় জানানোর জন্য অধ্যক্ষ স্যারের আবাস থেকে লঞ্চঘাটের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকি।। শ্রীনগর বাজারের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের দোকানের সামনে মানুষের জটলা দেখতে পাই। আমাদের দেখে হাবিবুর রহমান সাহেব হাত ইশারায় ডাকতে থাকেন। কাছে গেলে বলেন ‘কই যাস? রেডিওতে কী বলে শোন’। তখন রেডিওতে বারবার মেজর ডালিমের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও কার্ফু জারির কথা বলা হয়। যা শুনে আমি হাবিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে থাকি,‘আপনাদের মাথা খারাপ হইছে। সিরাজ শিকদারের দল কোথাও রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়ে এসব বলছে। আর আপনারা তা বিশ্বাস করতেছেন!’ আমার কথা শুনে রনেশ দা বললেন,‘মাথা গরম করো না। হয়তো  ক্যু দেতা হয়ে গেছে।

 রেডিওতে তখন খন্দকার মোশতাককে দেশের রাষ্ট্রপতি করা ও সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। সব শোনার পর রনেশ দাস গুপ্ত বললেন- মোশতাক খুব ধূর্ত ও নিষ্ঠুর।

আমরা আবার দাদাকে অধ্যক্ষ স্যারের বাসায় পৌঁছে দিয়ে শ্রীনগর থানায় যাই। ওসি ছিলেন আবদুর রশীদ মোল্লাহ। তাঁকে আমরা বলি ‘১৯৭১ সালের মতো আবার থানার অস্ত্র লুট করে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে’। তিনি বললেন, মাথা গরম করিস না। খন্দকার মোশতাক যখন প্রেসিডন্ট হয়েছে, তাহলে তোদের নেতাও তাঁর সাথে থাকতে পারে।’

এরমধ্যে একে একে তিন বাহিনী প্রধান,রক্ষীবাহিনী প্রধান ও পুলিশের আইজির মোশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা রেডিওতে বারবার প্রচার হতে থাকে। বিকেলে মন্ত্রিপরিষদের নাম ঘোষণা করা হলো। জাতীয় চার নেতা ও কোরবান আলী,আবদুস সামাদ আজাদ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর প্রায় সব মন্ত্রীসহ প্রাক্তন দুজন রাষ্ট্রপতি মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। আমরা হতভম্ব হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকি। আর ভাবতে থাকি কোথা দিয়ে কীহয়ে গেল।

বিকেলে আমরা শ্রীনগর কলেজ প্রাঙ্গনে রনেশ দাসসগুপ্তকে নিয়ে বসে আলাপ-আলোচনা করতে থাকি। দাদা বললেন- ‘আমরা অনেক পিছিয়ে গেলাম। কম করে হলেও দুই দশক লাগবে গণতন্ত্রে ফিরে যেতে।’

আমরা পরের দিন রনেশ দাদাকে নৌকা যোগে হাঁসারা কালীকিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু মন্ডলের বাসায় রেখে আসি। নির্মলবাবু দাদাকে পেয়ে মনেহলো তিনি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। তিনি বৌদিকে ডেকে বলেন,  ‘আসো, দেখ জয়নাল কাকে নিয়ে এসেছে।’ নির্মল স্যারের বাসায় ৩/৪ দিন অবস্থানের পর রনেশ দাসগুপ্ত খোঁজ খবর নিয়ে ঢাকায় চলে যান।

পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর মনে হলো বাংলাদেশটি আভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছে। সব কেমন যেন নিস্তব্ধ। একটা বিরাট শূন্যতা যেন গ্রাস করল আমাদের টারপাশ। যে বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করেছেন, সেই বাঙালিদের কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসের ওপর ভর করে তো সব ঘটে না। অবিশ্বাস্য এমন কিছু ঘটনা অনেক সময় ঘটে, চাখের সামনে দেখেও তা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড তেমনি একটি ঘটনা। ওই একটি হত্যাকান্ড শুধু একটি জীবনের স্পন্দন থামিয়ে দেয়নি, একটি দেশ ও জাতির আশা আকাক্সক্ষাকে চুরমার করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধুর  সুযোগ্য কণ্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হচ্ছে। সাফল্য আসছে চারদিক থেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারিয়ে যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে, তা কোনোদিন পূরণ হবে না।

 লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত