রাণী এলিজাবেথের প্রয়াণ ও বাঙ্গালের শোক
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪৭ | আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৩১
দ্বিতীয় এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা ম্যারি ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের রাণী ছিলেন। তিনি তার রাজত্বকালে যুক্তরাজ্য ছাড়াও আরও প্রায় ৩২ টি দেশের রাণী ছিলেন এবং মৃত্যুকালে তার রাজত্ব ছিল ১৪ টি কমনওয়েলথ রাজ্যের উপর। তার ৭০ বছর ২১৪ দিনের রাজত্ব ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় যাবত ক্ষমতায় থাকা নারী। ব্রিটিশ রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। ব্রিটিশ রানীর প্রয়াণে দুঃখ প্রকাশ দেখে মাষ্টার দা সুর্যসেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, সুশীল দাশ, নবাব সিরাজউদ্দোলা, ক্ষুদিরামরে মতন অনেকের কথা খুবই স্মরণ হচ্ছে। অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশকে শোষণ করে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী ও জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত রাষ্ট্র থেকে দরিদ্র বানিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের শাসন। ভারতবর্ষের মণি-মাণিক্য-হীরা-জহরত লুটে তা পরিহিতা সম্রাজ্ঞী, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরা কোহিনূর, যা রানীর মুকুটে শোভা বর্ধন করে, যা আমাদের মোগল সাম্রাজ্যের সম্পদ।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সূর্য সেন ও বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সূর্য সেন ও বিল্পবী তারকেশর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম অত্যাচার করে হাতুড়ী দিয়ে দাঁত ও হাড় ভেঙে দেয়। হাতুড়ী দিয়ে ইচ্ছে মতো পিটিয়ে অত্যাচার করে। এই অত্যাচারের এক পর্যায়ে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদার অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তাদের অর্ধমৃত দেহগুলোকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে পুরো মৃত্যু নিশ্চিত করে জেলা খানা থেকে ট্র্যাকে তুলে চার নং ষ্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন একটি জায়গায় ফেলে দেয়া হয়। যাতে কেউ মাস্টারদা ও তারকেশরের মৃত দেহও খুঁজে না পায়।
ব্রিটিশ শক্তিকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে বাংলার সন্তান মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ১৮৩১ সালে ভারতের কলকাতার নিকটবর্তী নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে একটি বিপ্লবী কেন্দ্র শিবিরের গোড়াপত্তন এবং বাঁশ দিয়ে কেল্লা নির্মাণ করেন। এই কেল্লাকে ‘তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা’ নামে চিহ্নিত করা হয়। তিতুমীরের পরিচালিত তাহরিক-ই-মুহাম্মদিয়া বা ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার। পরবর্তিতে এটি একটি ব্যাপক কৃষক আন্দোলনে রূপ নেয়। যা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। জমিদারদের প্ররোচনায় ইংরেজ সরকার তিতুমীর এবং তার অনুসারীদের দমনের জন্য বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজেন্ডারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠায়। কিন্তু তারা তিতুমীরের বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৫ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত ও বহু আহত হয়। এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন বড়ো লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তিতুমীরের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার এক বিশাল প্রশিক্ষিত বাহিনী প্রেরণ করে। মেজর স্কটের নেতৃত্বে এই বাহিনী তিতুমীরের নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। ইংরেজদের কামান বন্দুকের সামনে বীরের মতো লড়াই করে পরাজিত হয় তিতুমীরের বাহিনী।
মীরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করছিলেন শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা দখলের স্বপ্ন মীরজাফর, ক্লাইভ, জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ ও রাজবল্লভ বাস্তবায়ন করেন। হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজ-উদ-দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য রাজা মহেন্দ্র, রাজা রামনারায়ণ, রাজা কৃষ্ণদাস, রাজা রাজবল্লভ, মীর জাফর প্রমুখ প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গ মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়িতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় মিলিত হন। সভার আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ইংরেজদের সাহায্য নেয়া হবে এবং পরবর্তী সময়ে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল ক্লাইভের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিকল্পনা ঠিক করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাইভ মীর জাফরের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন, চুক্তি অনুসারে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণ করে তার জায়গায় মীর জাফরকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এ চক্রান্তের সাক্ষী ছিলেন জগৎশেঠের প্রতিনিধি ধনকুবের উমির্চাঁদ। ইংরেজদের এদেশে শাসন ও রাজ্য বিস্তারের যে পরিকল্পনা লর্ড ক্লাইভ করেছিলেন তাতে সহযোগিতা ও দেশের স্বাধীনতাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দায়ী কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও ষড়যন্ত্রকারী। পলাশী যুদ্ধের ফলেই প্রায় ২০০ বছর ধরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তথা অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগ্যচক্র আবর্তিত হয় ইংরেজদের হাতে। ক্লাইভ প্রথমে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে কেন্দ্র করে ভারতে যে আঞ্চলিক ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করলেন, অতি অল্পকালের মধ্যেই তা সারা উপমহাদেশে প্রসারিত হয়েছিল।
ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন একজন ভারতীয়-বাঙালি বিপ্লবী যিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিহারের মুজফ্ফরপুরে ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসু বোমা ছুড়ে হত্যা করতে গিয়েছিলেন অত্যাচারী ব্রিটিশ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবকে। প্রফুল্ল চাকি আত্যহত্য়া করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে। বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক মি. কর্নডফ। রায় ঘোষণার পর ক্ষুদিরামের মুখে ছিল হাসি। ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট সকালবেলা কাটায় কাটায় ঠিক ছয় টার সময় ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হল। চিতারোহণের আগে স্নান করাইতে মৃতদেহ বসাতে গিয়ে দেখা যায় মস্তকটি মেরুদণ্ড চ্যুত হইয়া বুকের উপর ঝুলে পড়েছে। দুঃখে – বেদনায় – ক্রোধে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাথাটি ধরে রাখলেন তার সঙ্গীরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামরিক প্রয়োজনের অজুহাতে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ও বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য সরিয়ে নেয়, যখন ভারতবর্ষের সৈন্যরাও ব্রিটিশদের হয়ে লড়ায় করছিল। খাদ্যশস্যের অভাবে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তেতাল্লিশের মন্বন্তর। বাংলার ছয় কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সেই মন্বন্তরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ মারা যায়। ব্রিটিশ রানির সাম্রাজ্যে যা একটা গণহত্যার ঘটনা। ব্রিটিশরা বাংলা দখলের আগে বাংলায় কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশরা আসার পর প্রতি দশকে একটা করে বড় দুর্ভিক্ষ হতো। কেননা ব্রিটিশ রানির সাম্রাজ্যে ব্রিটিশরা সব ফসল ব্রিটেনে পাচার করে দিত। যার বদৌলতে ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে সফলভাবে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ব্রিটিশরা আসার আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষে কখনো হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হয়নি। ব্রিটিশ রানির সাম্রাজ্যে ব্রিটিশরা নিজেদের শাসন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে কৌশলে হিন্দু মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই কৌশলের কাছে হার মেনে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, যারা এখনো সাম্প্রদায়িক বিষে জ্বলছে।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের রাণীর শাসনে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও ক্লেশময় সামাজিক সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে আছে নীলচাষের ইতিহাস। ‘নীলচাষ’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো ইংরেজ সাহেবের হাতে চাবুক, অসহায় কৃষকের চোখে জল, নিরুপায়ের আহাজারি ও ক্ষুধার হিংস্র থাবা আর নীলকুঠি। নীল চাষের মালিকানা ছিল নীলকর সাহেবদের হাতে। কৃষকদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে তার জমিতে নীল চাষের ব্যবস্থা করা হত। এই দাদনের পরিমাণ ছিল নগণ্য। কিন্তু কৃষকদের শ্রম ও অর্থ দিয়ে নীল চাষ করতে হত। এইভাবে নীলচাষীদের শোষণ করে নীল সাহেবরা মুনাফা লুটত । ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি বাংলার গরীব চাষীদের নির্মম অত্যাচার করত। কোন চাষী নীল চাষ করতে অসম্মত হলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলত। ব্রিটিশরা লাঠিয়াল ও পাইক বরকন্দাজ দিয়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে নীল চাষ অনিচ্ছুক চাষীদের ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিত, গরুবাছুর কেড়ে নিত, জোয়ান পুরুষদের ধরে নীল কুঠিতে অন্ধকার কক্ষে মাসের পর মাস আটক করে রাখত ও বেত্রাঘাতে জর্জরিত করত এবং আরও নানাপ্রকার শারীরিক দন্ড দিত। চাষী মেয়েদের উপরও অত্যাচার করত।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ দখলের আগে ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী জনপদ। ব্রিটিশদের ২০০ বছরের সীমাহীন শোষণে ভারতবর্ষ আর সমৃদ্ধ বাংলা হয়ে যায় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র জনপদ। ভারতবর্ষ আর সমৃদ্ধ বাংলার রাজাদের সম্পদ লুট করে, শস্য লুট করে দুর্ভিক্ষ এনে, নীল চাষে বাংলার আকাশ অত্যাচার আর নির্যাতনে নীল করে, বাংলার মেয়েদের অত্যাচরের কান্না, বাংলার বীর বিপ্লবীদের হাতুড়ী দিয়ে দাঁত ও হাড় ভেঙে বা ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাজ্য দখল করে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী ও জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত ভারতবর্ষ আর বাংলাকে দরিদ্র বানিয়ে ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে সফলভাবে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল, আর রানী এলিজাবেথ ছিলেন এই ভয়ানক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কর্ণধার। ইতিহাস ভুলে গিয়ে বাঙ্গালরা মহারাণীর প্রয়ান মহাশোকে শোকাহত।
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত