বঙ্গবন্ধুর জেল-জীবন

  সুমন্ত রায়

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২১, ১১:৪৯ |  আপডেট  : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২২:১১

১৯৭১ সালে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির মুক্তির আকাঙ্খাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে যিনি ঘোষণা করেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম  স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।” তিনিই তো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি, সর্বোপরি বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে রাজনৈতিকভাবে  স্বাধীন হতে হবে। মৃত্যুভয় বা ক্ষমতার লোভ কোনো কিছুই তাঁর দৃঢ়সংগ্রাম মনোভাবকে দমিয়ে দিতে পারেনি। ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপায়ণ করেন তিনি। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ মন্ত্রের মতোই সমগ্র বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর একটি সুপ্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়াইয়ে নামতে এবং ওই লড়াইয়ে জিততে উদ্বুদ্ধ করেছিল। একটি  ভূখণ্ডে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে যিনি একটি ভাষণে এক করে দিয়েছিলেন, একসূত্রে গেঁথেছিলেন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্দীপ্ত করেছিলেন এবং স্বাধীনতা অর্জনও করেছিলেন, তাকে জাতির পিতা অবশ্যই বলব।

বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করতে বহু সাহিত্যিক ও রাজনীতিক এবং সংগ্রামী অবদান রেখেছেন। কিন্তু বাঙালি জাতি যদি হয় একটি স্বপ্নের নাম, আকাঙ্খা র নাম, সংগ্রামের নাম এবং সফলতার নাম, তবে তার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবহমানকালের শাশ^ত বাঙালি সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ¯^প্নকে তিনি বাস্তবায়িত করেন ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই বাঙালি জাতি কেবল মুসলিম নয়, হিন্দু নয়--এই জাতি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সবার--যার ভিত্তি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। বাঙালির এই স্বাধীন আবাসভ‚মির জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবনের একটা দীর্ঘসময় জেলে কাটিয়েছেন। তাঁর জেল-জীবনের কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কয়েকটি শিরোনামের মধ্য দিয়ে। শিরোনামগুলো হলো ঃ বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রথম কারাবাস, শেখ মুজিব জেল থেকে জেলে, জেলে বসেই ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ও ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের নির্দেশনা দেন’, ফরিদপুর জেলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শেখ মুজিব ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে আবার জেল।

 

বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রথম কারাবাস

 

১৯৩৮ সাল। একদিন শেখ মুজিব মাঠ থেকে ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন, পথিমধ্যে বাসুমিয়া নামক তাঁর এক সহপাঠী তাকে জানালো যে, মালেককে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জি ধরে নিয়ে গেছে। এ-কথা শুনে তিনি ততক্ষণাৎ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। শেখ মুজিবুর রহমান সুরেন ব্যানার্জিকে অনেক অনুরোধ করলেন ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মালেককে না ছেড়ে উল্টো তারা গালাগালি করতে লাগলেন। মুজিব তখন তাঁর আরও সহপাঠীকে খবর দিলেন। তারা এসে উপস্থিত হলো। পরবর্তীতে আরও সহপাঠী এলো। ইতোমধ্যে সুরেন ব্যানার্জি পুলিশকে খবর দিয়েছিল। তিনজন পুলিশ কনস্টেবল এলো। ওই পুলিশের উপস্থিতিতে শেখ মুজিব এবং তাঁর দলবল দরজা ভেঙে মালেককে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। হিন্দু সংঘের নেতারা থানায় গিয়ে শেখ মুজিব ও তাঁর সহপাঠীদের নামে মামলা করে। এজাহারে বলা হয়, মারধর, বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, হত্যার উদ্দেশ্য ছিল। পরদিন সকালে তাঁর কয়েকজন সহপাঠীকে গ্রেফতার করা হলো; কিন্তু দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদারের বাড়িতে পুলিশ ঢুকতে ভয় পাচ্ছিল। সেদিন ছিল রবিবার। তখনকার দিনে রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই প্রতি শনিবার শেখ মুজিবের পিতা নিজস্ব নৌকা নিয়ে টুঙ্গিপাড়া নিজ গ্রামের বাড়িতে যেতেন। আবার সোমবার সকালে ফিরে এসে অফিস করতেন। শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জে ফিরে এলে পুলিশ শেখ মুজিবকে থানায় আসার অনুরোধ জানায়। ইচ্ছে করলে মুজিব পালাতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। অবশেষে তিনি থানায় আত্মসমর্পণ করলে পুলিশ সব আসামিকে কোর্টে চালান করে দেয়। কোর্ট তাদের জামিন না দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। সাত দিন জেলে থাকার পর তিনি জামিন পান। শেখ মুজিব জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রথম কারাবরণ।

 

শেখ মুজিব জেল থেকে জেলে

 

জেলের মধ্যে বিচিত্র মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে, আছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শেখ মুজিব তখন ফরিদপুর জেলে। সকালবেলায় বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, এমন সময় আধাবুড়া একজন কয়েদি এসে তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়লেন।

শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’

বললেন, ‘বাড়ি গোপালগঞ্জ থানায়, ভেন্নাবাড়ি গ্রামে, নাম রহিম।’

শেখ মুজিব বললেন, ‘আপনার নামই রহিম মিয়া।’ রহিম নামে ঐ অঞ্চলে তাকে এক নামে চেনে। এত বড় ডাকাত গোপালগঞ্জ মহকুমায় আর ছিল না। শেখ মুজিব আবার বললেন, ‘রহিম মিয়া আপনি না আমাদের বাড়িতে চুরি করে সর্বস্ব নিয়ে এসেছিলেন।’ রহিম মিয়া কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ১৯৩৮-১৯৩৯ সালের দিকে রহিম মিয়া ও তার দল শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে চুরি করে শোয়া’শ ভরি সোনার গহনা এবং কয়েক হাজার টাকা নিয়ে যায়।

দুই-চারশত বছরের ইতিহাসে কোনোদিন এ বাড়িতে চুরি-ডাকাতি হয় নাই। রহিম মিয়া বলল, ‘হ্যাঁ আমি চুরি করেছিলাম।’

‘আমাদের বাড়িতেও সাহস করে এলেন কী করে? আমাদের ঘরে বন্দুক আছে। অনেক শরিকদের বাড়িতে বন্দুক আছে। এত বড় বাড়ি, কত লোক।’

‘গ্রামের লোক এবং আপনার বাড়ির লোক সাথে ছিল।’

‘রহিম মিয়া, আমার মা ও আব্বা বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ আমাদের সর্বস্ব গেলেও কিছু হতো না কিন্তু আমার বিধবা বড় বোনের গহনাই বেশি ছিল।’

‘আর জীবনে চুরি করবো না। আপনাদের বাড়িতে চুরি করে আসার পরই আমার পতন শুরু হয়েছিল। এরপর যত জায়গা চুরি করতে গিয়েছি, ধরা পড়েছি। অথচ আগে কোনোদিন ধরা পড়িনি। আপনার আম্মার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইব।’

রহিম মিয়া তার জীবনের অনেক ইতিহাস শোনালেন।

আরেকবার ফরিদপুর জেলে রাজবন্দিদের ওয়ার্ডে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলেন গোপালগঞ্জের চন্দ্র ঘোষ আর মাদারীপুরের ফণী মজুমদার। ফণী মজুমদার পূর্বে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ইংরেজ আমনে আট-নয় বছর জেল খেটেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরও রেহাই পান নাই। বিবাহ করেন নাই। হিন্দু-মুসলমান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাঁকে ভালোবাসত। সবার বিপদে তিনি এগিয়ে আসতেন।

চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সমাজকর্মী। জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছেন। কাশিয়ানী থানায় রামদিয়ায় ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন। রাস্তা করেছেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে একজন সরকারি কর্মচারী অতি উৎসাহ দেখাবার জন্যে সরকারকে মিথ্যা খবর দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করায় এবং তার শাস্তি হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে এসে ১৯৪৮ সালে সেই কর্মচারীকে বলেছিলেন ,  চন্দ্র ঘোষের মতো মানুষকে  গ্রেফতার করে ও মিথ্যা মামলা দিয়ে পাকিস্তানের বদনামই করা হচ্ছে।

শেখ মুজিব প্রচণ্ড শরীর খারাপ নিয়ে এবার ফরিদপুর জেলে এলেন। রাতে ভীষণ জ¦র উঠল। রাতভর চন্দ্র বাবু মাথায় পানি ঢাললেন। ফণী বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন। এভাবে তিন দিন তিন রাত তাঁরা দুজন শেখ মুজিবের সেবা করলেন। এই ঘটনার আবার কিছুদিন পরে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ জেল থেকে ফরিদপুর জেলে আবার এলেন। এসে দেখেন চন্দ্র বাবুর অবস্থা খুবই খারাপ। সিভিল সার্জন তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে বাইরের হাসপাতালে নিতে বলেছেন। তাঁকে অপারেশন করতে হবে। আত্মীয়-¯^জন কেউ নাই যে, তার পক্ষে অনুমতিপত্র লিখে দিবে। চন্দ্র ঘোষ নিজেই লিখে দিতে রাজি হলেন। চন্দ্রঘোষ সিভিল সার্জনকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নাই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মতো। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’

শেখ মুজিবকে জেলগেটে নিয়ে আসা হলো। চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। শেখ মুজিবকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘ভাই, এরা আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে বদনাম দিল, শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু-মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখ। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।’

এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে, সুপারিনটেনডেন্ট জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে শেখ মুজিবের চোখেও।

শেখ মুজিব বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’

১৯৫১ সালের শেষের দিকে শেখ মুজিব আবার ঢাকা জেলে এলেন। এই সময় তাঁর শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। ঢাকা জেল হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হবে। এ সময় তাঁর মুক্তির জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী তাঁর মুক্তির জন্য জোর দাবি তুললেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আতাউর রহমান বিশেষ অনুমতি নিয়ে শেখ মুজিবকে দেখতে আসেন হাসপাতালে। অনেক কথা হয়, শহীদ সাহেব শেখ মুজিবকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলে দিলেন শেখ মুজিবের দিকে বিশেষ নজর দিতে। এ-সময় শওকত সাহেব এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা ঢাকার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বের  স্বাক্ষর নিয়ে শেখ মুজিবের মুক্তি চেয়ে প্রচারপত্র বিলি করে। জেলে বসেই ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ও ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্টভাষা দিবস পালনের তিনি নির্দেশনা দেন।

১৯৫২ সাল। শেখ মুজিব তখন ঢাকা জেল হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি। একদিন সন্ধ্যায় মোহাম্মাদ তোয়াহা ও অলি আহাদ শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শেখ মুজিবের কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। শেখ মুজিব রাত ১টার দিকে তাদের আসতে বললেন। সেই সঙ্গে খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুবসহ আরও ছাত্র নেতাদের খবর দিতে। অনেক রাত পর্যন্ত শেখ মুজিব একা হাঁটাচলা করতেন। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশ চুপচাপ এক পাশে পড়ে থাকত। গোয়েন্দা কর্মচারীরা এক পাশে বসে ঝিমাত। পিছনের বারান্দায় পাঁচ-সাতজন ছাত্রনেতা এলেন। শেখ মুজিব বারান্দায় বসে তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিলেন। শেখ মুজিব বললেন, ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগই এর নেতৃত্বে থাকবে। আওয়ামী লীগ নেতাদের খবর দিয়েছি। আবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দেবে, কারণ আমি না-কি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’

পরের দিন রাতে অনেকেই এলেন। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে।

শেখ মুজিব আরও বললেন, ‘আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে।’

তিন-চার দিন পরেই শেখ মুজিবকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিল। জনাব মহিউদ্দিন রাজি হলেন অনশন ধর্মঘট করতে। দুজন দুটি দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন তাদের ১৫ ফেব্রæয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট পালন করবে। বিনা বিচারে ছাব্বিশ মাস জেল এটা অন্যায়। শেখ মুজিব আরও বললেন, ÔEither I Will go out of the jail or my deadbody will go out.Õ 


 

ফরিদপুর জেলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শেখ মুজিব

 

২১শে ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রতিদিনই ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল, শোভাযাত্রা, সমাবেশ হচ্ছিল। ২১ তারিখে গ্রেফতার হন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএলএ, মো. আবুল হোসেনসহ শত শত ছাত্র ও কর্মী। দুদিন পরে আরও গ্রেফতার হলেন মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, কয়েকজন প্রফেসরসহ বহু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সাধারণ কর্মী।

এদিকে জেলখানায় শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন দুজনেরই স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হতে লাগল। শেখ মুজিবের ছিল হার্টের সমস্যা আর মহিউদ্দিনের ছিল পরিমিস রোগ।

২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সিভিল সার্জন শেখ মুজিবকে পরীক্ষা করে মুখ গম্ভীর করে বসে পড়লেন এবং কিছু না বলে আবার বেরিয়ে গেলেন। ডেপুটি জেলার এসে বললেন, ‘কাউকে খবর দিতে হবে কি না? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোন টেলিগ্রাম করবেন।’

শেখ মুজিব জানিয়ে দিলেন না। কারণ এ-মুহূর্তে তাদের আর কষ্ট দিতে চান না। শেখ মুজিব ভাবলেন তার দিন ফুরিয়ে এসেছে, তাই তিনি চারখানা চিঠি লিখলেন। একজন কর্মচারীকে ডেকে চিঠিগুলো তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুর আমার আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিবেন।’

তাঁর প্রিয় সন্তানদের মুখ ভেসে উঠেছিল। হাসিনা, কামালকে একবার দেখতেও পেলেন না। চিন্তাশক্তিও ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যেতে লাগল। ২৭ ফেব্রুয়ারি দুজনের অবস্থা আরও খারাপ করে, খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিলেন। দুজনে দুজনের হাত ধরে শুয়ে থাকেন। কথা বলতে ইচ্ছে করে না, আবার শক্তিও নেই। রাত ৮টার দিকে ডেপুটি জেলার শেখ মুজিবের কাছে এসে বসলেন এবং বললেন, ‘আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তবে খাবেন তো?’

শেখ মুজিব বললেন, ‘মুক্তি দিলে খাব, না দিলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে যাবে।’ ডেপুটি জেলার বললেন, ‘আমি পড়ে শোনাই আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে রেডিওগ্রামে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিস থেকেও অর্ডার পেয়েছি।’

ডাক্তার সাহেব ডাবের পানি নিয়ে এলেন। মহিউদ্দিনকে দুজন ধরে বসাল। সে অর্ডার পড়ে শেখ মুজিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মহিউদ্দিন বললেন, ‘আমি তোমাকে ডাবের পানি খাওয়াব।’ দুই চামচ ডাবের পানি খাইয়ে অনশন ভাঙলেন। দুদিন পরে মহিউদ্দিন সাহেবেরও মুক্তির আদেশ এলো।

 

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে আবার জেল

 

শেখ মুজিব জেলের মধ্যে সারাদিন বই পড়তেন, মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করতেন। ববীন্দ্র-সংগীত তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর প্রিয় গান : আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, ও আমার দেশের মাটি তোমার কোলে ঠেকাই মাথা এবং এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। বই পড়তে পড়তে যখনই হাঁপিয়ে পড়তেন তখন জেলের সহসঙ্গী আবদুল মোমেন পড়তেন, তিনি শুনতেন। মাঝে মাঝে আবার তিনি পড়তেন, আবদুল মোমেন শুনতেন। সরবে বই পড়তে শেখ মুজিব ভালোবাসতেন। এমনি করেই তাঁদের দিন যাচ্ছিল। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিনগত রাত্রি ১টার দিকে হঠাৎ তাঁদের ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত শোনা গেল। শেখ মুজিব তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জনাব মোমেন একটি শব্দেই জেগে গেলেন। জিজ্ঞেস করে তিনি জানলেন যে ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল মিয়া বাইরে অপেক্ষা করছেন। তোজাম্মেল মিয়া শেখ মুজিবকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মৃদু ও ভাঙা গলায় বললেন, ‘দরজা খুলতে হবে স্যার।’ মোমেন সাহেব দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন তোজাম্মেল মিয়া এবং সেপাই আছর আলী। শেখ মুজিব তখনও ঘুমুচ্ছেন। সাথে সাথেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল, তিনি চোখ কচলিয়ে বললেন, ‘দুঃসংবাদ নয় সুসংবাদ-- কোনো খবরই খারাপ নয়। বলুন কী খবর?’

তোজাম্মেল মিয়া একটি লিখিত আদেশ শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন স্যার, আপনাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।’

কয়েকদিন হলো নানা খবর বাতাসে কয়েদখানার মধ্যে শেখ মুজিবের কানেও পৌঁছেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্রে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে। শেখ মুজিব তাই নিলিপ্তভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে খালাস দেয়া হল কি নতুন কোন ফাঁদে নেবার জন্য।’

ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল মিয়া উত্তরে কোনো কথা বললেন না, মাথা নিচু করে রইলেন। সেপাই আছর আলীরও একই অবস্থা।

শেখ মুজিব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘বুঝলাম সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে মুক্তি এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।’

বিদায়ের পূর্বে বন্ধু আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বন্ধু, বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানি না, কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে--হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাবার সময় আপনাকে শুধু একটি কথা বলে গেলাম-- বাংলাদেশের সাথে কোনদিন আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, কোনদিন করবো না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম  স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন আমার লক্ষ্য।’

শেখ মুজিবের চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সেই অশ্রু স্পর্শ করল আবদুল মোমেনের গ্রীবাদেশ। অশ্রু নয় বিপ্লব বন্যার দুই ফোঁটা উজ্জ্বল পূর্বাভাস। বিশ্বস্ত সহচর আবদুল মোমেনের কণ্ঠে শিশুর কান্নার আবেশ। অপস্রিয়মাণ সূর্যের মতো শেখ মুজিব ধীরে ধীরে জেলগেটের দিকে অদৃশ হয়ে গেলেন। জেলগেট থেকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে একটি মিলিটারি ভ্যান সঙ্গীন উচিয়ে দাঁড়াল তাঁর সামনে। তাঁকে বিজাতীয় ভাষায় জানানো হলো--তুমি আবার বন্দি চল আমাদের সঙ্গে।

–অপরাধ?

উত্তর নেই। শেখ মুজিব জানেন উত্তর পাওয়া যাবে না। তিনি মিলিটারির সামনে দাঁড়িয়ে শুধু একটি অনুরোধ জানালেন ,
‘শুধু এক মুহূর্ত সময় দাও ভাই তোমরা আমাকে।’

তারপর কারাগারের সামনের পথ থেকে এক মুঠো ধুলো তুলে কপালে স্পর্শ করে প্রার্থনা জানালেন :

‘এই দেশেতে জন্ম আমার,

যেন, এই দেশেতেই মরি।’ 

অতঃপর সেই একমুঠো মাটি নিজের কাছেই রেখে দিলেন। উদ্দেশ্য, যদি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়, তাহলে মৃত্যুর সময় তাঁর প্রিয় জন্মভ‚মি বাংলাদেশ থেকে তিনি অনেক দূরে থাকবেন। তখন এই এক মুঠি মাটির স্পর্শে তার মনে হবে যে, জননী জন্মভুমির মাটির পবিত্র স্পর্শ তাঁর অঙ্গে লেগে আছে। বাংলাদেশ, এই দেশের মাটি তাঁর নিকট কত প্রিয়, এ থেকেই তা অনুধাবন করা যায়। যখনই সময় এসেছে শেখ মুজিব সব নির্যাতন ও মৃত্যুকে প্রতি পদে পদে এমনি সহজভাবেই বরণ করে নিয়েছেন। ভয়ে বা বেদনায় কখনও মুষড়ে পড়েননি তিনি। এবার অনিশ্চিতের পথে মৃত্যুকে সামনে রেখেই শুরু হলো তাঁর অকুতোভয় যাত্রা।

রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব--এই শিরোনামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বন্দিরা সবাই জানালেন যে, ভারতের সঙ্গে যোগসাজশ করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার এক ব্যাপক ষড়যন্ত্রে না-কি তারা সবাই লিপ্ত ছিলেন--আর তার পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছেন শেখ মুজিব-- এই অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি দুজন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ-বিষয়ে কেন্দ্রীয়  স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত একটি প্রেসনোটে বলা হয় যে, গত মাসে (ডিসেম্বর ১৯৬৭) পূর্ব পাকিস্তানে উদঘাটিত জাতীয়  স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেয়। বঙ্গবন্ধুসহ সবাই মুক্তি পান।

বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ গ্রেফতার হন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যা ২৬ মার্চ প্রচারিত হয়। তাই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। তাঁকে গ্রেফতার করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম দিয়ে শুরুর পর বাংলাদেশের  স্বাধীনতা আনা পর্যন্ত সারাজীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৫৮ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তাঁর মোট জীবনের সিকিভাগ।

এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আসলে সাত দিন কারাভোগ করেন বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তাঁর জেলে কাটে পাকিস্তান আমলে। যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য শেখ মুজিব জীবনপণ লড়াই করেছিলেন, সেই পাকিন্তান  স্বাধীন হওয়ার পরে পাকিস্তানের জেলেই তাঁকে কাটাতে হয়েছিল ৪ হাজার ৬৭৫ দিন। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে একটা একটা অর্জনের পেছনে তাঁকে দীর্ঘ সংগ্রাম ও জেল খাটতে হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি জেল খেটেছেন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ করেও তিনি জেল খেটেছেন, ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারির প্রতিবাদে প্রায় তিন বছর জেল খেটেছেন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬-দফার আন্দোলনে জেল খেটেছেন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁর মুক্তি হয়। এমনকি ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পওয়ার পরও তাঁকে জেল খাটতে হয় এবং চূড়ান্ত বিজয়, অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি মুক্তি পান।

বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। তিনিই আমাদের জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

লেখকঃ গবেষক
তথ্যসূত্র
* অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান
* কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান
* বঙ্গবন্ধু অনলাইন আর্কাইভ
* বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মযহারুল ইসলাম


 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত