"ফুটবল ম্যানিয়া"

  ওমর ফারুক 

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৩৬ |  আপডেট  : ১৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩০

সমাজে নানা রকম উৎপাত আছে। আছে নানা উপসর্গ। মানুষ জরা, ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কিন্তু পৃথিবীর জ্বর হয়!  এ আবার কেমন কথা। অবাক হলেও এটাই সত্যি। পৃথিবী প্রতি চার বছর পরপর জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ জ্বর কোনো পারদ থার্মোমিটার দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কারণ এর পারদ স্তর অতিক্রম করে অসীমে গিয়ে মিলেছে। 

চার বছর পরপর পৃথিবী জ্বরের প্রকোপ অনুভব করে। জ্বরের প্রকোপ এতোটাই প্রকট যে পৃথিবীর সবগুলো দেশ এ জ্বরে আক্রান্ত হয়। আর মাতামাতি এতোটাই হয় যে যেকোনো মাপকাঠি অতিক্রম করে যায়। দেশে দেশে হই, হুল্লোড় উঠে যায়। দেশের আকাশ সীমায় নানা বর্ণের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। নিজ দেশের পতাকা ছাড়িয়ে ফ্যান দেশের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। নানা দল,উপদল আর শিবিরে ভাগ হয়ে যায় দর্শক। পৃথিবী পুড়তে থাকে ফুটবল ম্যানিয়ায়।

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ১৯৩০ সালে। সেবার ৩২ দল কিন্তু অংশ নেয়নি। ফুটবলের এতো পরিচিতিও পায়নি তখন। ভদ্রলোকের খেলা ফুটবলের তখন নবযাত্রা। সে আসরে উরুগুয়ে কাপ জিতে নেয়। পরের বারও একই ঘটনা। তারপরের ইতিহাস বিশ্বযুদ্ধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্বকাপ আয়োজন বন্ধ থাকে।তারপর আবার ফুটবল নতুনভাবে শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। ফুটবলে তখন ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালির নবযাত্রা। একঝাঁক নতুন তারকা মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। জুলে রিমে কাপ জয়ের মাধ্যমে ব্রাজিল নিজের জাত বিশ্বকে দেখালো। তারপর অনেক ঘটন অঘটনের মধ্যদিয়ে ফুটবল এগিয়ে চলতে লাগলো। 

সেলেসাওদের স্বপ্নসারথি ছিলেন পেলে। পেলে বনে গেলেন ফুটবল যাদুকর। সে যাদুকরের সাথে আর্জেন্টিনার নতুন যাদুকর যুক্ত হলেন ম্যারাডোনা। এই দুজনের ফ্যানের মাতামাতি এতোটাই মাত্রাতিক্রম করলো যে সেটা আর সভ্য থাকলো না। দুটো শিবির নিয়মিত অংক কষে কষে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠলো। গোল,ফাউল, শট,ইনসিস্ট, সবগুলো বিষয়কে সামনে আনা হলো। শুরু হলো নতুন বির্তক। কে বড়, কে সেরা। হলুদ আর আকাশী শিবিরের মাতামাতি এতোটাই প্রকট আকার ধারণ করলো যে জার্মানি, হল্যান্ড, ইতালি, ক্যামেরুন, ফ্রান্সের দর্শক পর্যন্ত বিভক্ত হয় এই দুই শিবিরের উত্তাপ বাড়াতে লাগলো। 

উত্তাপ বেড়াই চললো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে। পেলে, ম্যারাডোনা বির্তক চলতেই সামনে চলে আসলো  মেসি-কাকা-রোনাল্ড। সি আর সেভেন বড় নাকি মেসি বড়।এ লড়াই চলতেই থাকলো। শুধু ফ্যানদের মধ্যেই নয়।বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে রোনালদো এবং মেসিকে শুভেচ্ছাদূত বানিয়ে মাতামাতি আরও বাড়িয়ে দেয়। ক্লাবগুলো তাদের দাম হাকিয়ে এ জ্বরে ঘি ঢেলে দেয়। মেসি-রোনালদো বির্তক শেষ না হতেই ব্রাজিলের রোনালদিনহো এবং নেইমার জুনিয়র প্রতিযোগিতায় চলে আসে। শুরু হয় দ্বৈরথ থেকে তৈরথ প্রতিযোগিতা। মেসি-রোনালদো-নেইমার। সি আর সেভেনের পায়ের কারিশমায় দর্শকদের মাঝে নতুন করে স্বপ্ন জেগে উঠে। 

ফুটবল জ্বরে বেশি পুড়ে ল্যাটিনের দেশগুলো। তাবৎ ফুটবলের দেশগুলোর মধ্যে বাঘা বাঘ দেশগুলো ল্যাটিন আমেরিকায়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে,চিলি,পেরু। ল্যাটিন আর ইউরোপের মধ্যে তাই দ্বন্দ্ব চিরকালের। ল্যাটিন আমেরিকায় কোপা কাপ ফুটবল বিশ্বকাপের জ্বরটা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। ফুটবলের দেশগুলো কোপা জ্বরে আক্রান্ত হয়।

ফুটবল বিশ্বকাপের জ্বর ক্লাবগুলো প্রকট করে দেয়। বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি প্রভৃতি ক্লাবগুলো তারকা ফুটবলারদের দাম হাকিয়ে ম্যানিয়া আরও বাড়িয়ে দেয়। জ্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ক্লাবে কার পারফর্মেন্স কেমন সেটা নিয়ে চলে মাতামাতি, হাতাহাতি। ক্লাব ফুটবলে কে সেরা। কে জাতীয় দলের সম্পদ, কে ক্লাবের সম্পদ। এসব নিয়ে চলতে থাকে ভক্তদের চুলচেরা বিশ্লেষণ। 

পৃথিবীর তাবৎ দেশ জ্বরে আক্রান্ত। চলছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর। কাতার বিশ্বকাপের পর্দা উঠেছে। চলছে এখন সমীকরণ, সমীক্ষা। এ সমীকরণে কেউ বাদ নেই। দেশ নেতা, দেশ নায়ক, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সেলিব্রিটি থেকে সবাই নেমে গেছে প্রতিযোগিতায়। নিজ নিজ দল বাছাই করে টুইটার, ফেসবুকের কল্যাণে প্রচার করছে। এ প্রচারে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশেই ফুটবল, ক্রিকেটের ফ্যান বেশি। বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্বকাপে নেই। বাংলাদেশের আকাশে কাতার বিশ্বকাপের জ্বর উঠেছে। দর্শকেরা বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত। ভক্তদের মাতামাতি চলছে। এ মাতামাতি এতোটাই প্রকট যে সেটা আর শোভনীয় থাকে না। গাছে, ছাদে, গাড়িতে, ঘরের চালে, টি শার্টে, জার্সিতে, ব্যানারে,ফ্লাগে প্রভৃতি বিভিন্নভাবে নিজের দলকে রিপ্রেজেন্ট করছে। কিন্তু এ রিপ্রেজেন্ট নতুন ফ্যানদের মধ্যেই বেশি। 

তারা মানে না কোন আইন
তারা ভরা তরী করে ভরা ডুবি, ভাসমান মাইন।

এই নতুন ফ্যানরা আক্রান্ত। তাদের মধ্যে জ্বরের প্রকোপ বেশি। তারা জ্বরের প্রকোপে প্রলাপ বকছে। কোনো পরিসংখ্যান, কোনো সমীক্ষা, কোনো তথ্য এদের বিবেচনায় নেই। তাদের একটাই কথা আমার দল সেরা, আমার তারকা সেরা। এই করে করে তর্ক, বির্তক, সমালোচনা চলছেই। তবে এগুলো ফুটবলের সৌন্দর্য। টোটাল ফুটবল ফিরিয়ে আনতে হবে। সেলেসাওদের ফুটবল প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পরেছে। প্রযুক্তি ফুটবলের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। ছোট ছোট পাস দিয়ে খেলা এখন আর দেখা যায় না। ইতালি, হল্যান্ড শক্তি প্রদশর্নে জার্মানির সাথে কুলোতে পারছে না। বেড়ে গেছে হলুদ কার্ড, লাল কার্ডের ব্যবহার। কাঁপছে বিশ্ব। এ কম্পন ঘর থেকে চায়ের কাপেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে, ফুটবল জ্বরে যেন সমাজ পুড়ে না যায় সে দায়িত্ব আমাদের সকলের।

জয় হউক ফুটবলের।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত