প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, মিয়ানমার যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ও ভূ-রাজনীতি

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫৪ |  আপডেট  : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫৯

রাখাইন ও চীন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভূমিকা তীব্রতর হওয়ায় গ্রামবাসীরা পালিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মির  মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের মধ্যে উত্তর রাখাইন এবং দক্ষিণ চিন রাজ্যে হাজার হাজার স্থানীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে আহ বাউং থার, হানা মা দার, থা হতায় কোন এবং কান্ট লে গ্রামের কাছে লড়াই শুরু হয়েছিল, যা দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপের কালাদান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত। ১২০ টিরও বেশি পরিবারের পুরো গ্রাম ৬ কিলোমিটার দূরে পালেতওয়া শহরে পালিয়ে গেছে। সৈন্যরা নির্জন গ্রাম দখল করে আছে, কাছাকাছি পাহাড়ে অবস্থান ও ফাইটার জেট এবং হেলিকপ্টার উভয়ই ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী উত্তর রাখাইন রাজ্যের অংশেও লড়াই হয়েছে।

 

দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং জাপানের মতো বড় শক্তিগুলি তাদের নিজস্ব কৌশলগত কারণে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে মেনে নিচ্ছে। চীন মিয়ানমারের সাথে তার ঐতিহাসিক 'পাউক-ফাও' (ভাই) সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। এটি মূলত চীনের কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পগুলিকে সুরক্ষিত করার জন্য মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক রাখা, যা চীনের ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানকে দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ। মায়ানমারের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারী রাশিয়ার মায়ানমারে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সুসম্পর্ক রাখছে। এছাড়াও, চীন-রাশিয়া ইন্দো-প্যাসিফিকের কেন্দ্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা এবং এ অঞ্চলে বিস্তৃত পশ্চিমা আধিপত্য বন্ধ করতে কৌশলগত ভাবে মায়ানমার, চীন-রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ।

 

রাখাইনে ক্রমাগত নিরাপত্তা সংকট এবং গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে ২৭০ কিলোমিটার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আন্তঃসীমান্ত বিদ্রোহ ও অপরাধের জন্য একটি হটস্পট। বাংলাদেশের প্রধান কৌশলগত উদ্দেশ্য মিয়ানমারের মাধ্যমে চীন ও আসিয়ান দেশগুলোর সাথে সংযুক্ত হওয়া। বাংলাদেশ আসিয়ান ব্লক এবং ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় হাইওয়ে উদ্যোগে যোগদানের দিকে নজর দিয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক প্রধানরা ঐতিহ্যগতভাবে মিয়ানমারে শুভেচ্ছা সফর করেছেন, নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে আরও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিরক্ষা অ্যাটাশের আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল। মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান যেমন ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ এবং ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে (ডিএসসিএসসি) অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ, মিয়ানমারে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারে রপ্তানি ও বিনিয়োগ করে বিলিয়ন আয়ের নতুন সুযোগ।

নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্য — বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের এজেন্ডা নিয়ে ভারত সফর করেছেন। তিনি আগামী বছরের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে. আবদুল মোমেন বলেছিলেন, “আমি ভারতে গিয়ে বলেছিলাম শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উভয় দেশের নেতৃত্বের মনে প্রধান উদ্বেগের বিষয় কিভাবে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়। ভারতের জন্য প্রধান উদ্বেগের কারণ চীন ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। ভারত সফরের সময়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত-বাংলাদেশ সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব - পণ্য ও পরিষেবার বিস্তৃত বাণিজ্য বিষয়টি খুবই গুরুত্ববহ।

 প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং চীন ফ্যাক্টর , চীনা 'গুপ্তচর' জাহাজ ইউয়ান ওয়াং ৫ ডকিংয়ের উপস্থিতি ও নানা কারণে নয়াদিল্লি তার প্রতিবেশীদের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে উঠেছে। ভারত নিশ্চিত করতে চায় যে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকবে না। এছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু সামরিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করছে, ভারত বাংলাদেশে আরও বেশি সংখ্যক অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে যেসব সাবমেরিন কিনেছিল সেগুলো কাজে লাগেনি। গত জুলাই মাসে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডের ঢাকা সফরের সময় অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল । এই মাসের শুরুর দিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়, বেইজিং বাংলাদেশকে তার "দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদার" হিসাবে উল্লেখ করেছিল এবং ঢাকা পুনর্ব্যক্ত করেছিল যে চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ 'এক চীন' নীতি বিশ্বাস করে।

 

চীনের প্রতি সহানুভূতিশীল পাকিস্তানে খানের আর শ্রীলঙ্কার রাজাপাকশার পতনের পেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং এই সফরের আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মন্তব্য অনেক কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। যা এই সফরে উভয় পক্ষের জন্য অস্বস্তিকর। পাকিস্তানের বর্তমান সরকার কাশ্মীর ইস্যুতে ছাড় দিয়ে হলেও ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে আগ্রহী। যাতে খানের যত আপত্তি। খান কাশ্মীর ও মুসলিম বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন ভূমিকার বিরোধী ও সমালোচক। সুতরাং খানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার রাজাপাকশার ভারতের প্রতি বৈরিতার প্রেক্ষাপটে ন্যাক্কারজনক পতন চীনের প্রভাব বলয় থেকে বেড়িয়ে এসে ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার ভারতকে অনেক কিছুই দিয়েছে ও দিতে আগ্রহী। খুবই উল্লেখযোগ্য ও মজার বিষয় হলো, খান আর রাজাপাকশার পতন হয়েছে খুবই অসম্মানজনক ভাবে।
 

রেলওয়ে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি এবং সম্প্রচারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাতটি স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে জল ভাগাভাগি, রেলপথ, মহাকাশ, বিজ্ঞান এবং বিচার বিভাগের বিষয়ে সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছেন। অভিন্ন সীমান্ত নদী কুশিয়ারা থেকে ভারত ও বাংলাদেশের পানি প্রত্যাহা, ভারতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য FOIS এবং অন্যান্য আইটি অ্যাপ্লিকেশনের মতো আইটি সিস্টেমে সহযোগিতা, ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি, ভারত এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে ভারতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচি, কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর), ভারত এবং বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সম্প্রচারে সহযোগিতার বিষয়ে প্রসার ভারতী এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানি সোমবার নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করার বিষয়ে আস্থা প্রকাশ করেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী ভারতের উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে মিটিং করেন ও বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য আহ্বান করেন। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেমন, তিস্তা, রোহিঙ্গা, বাংলাদেশ কোয়াডে যোগদান বিষয়গুলো আলোচনা হবে বলে সবায় আশা করেছিল। এর আগে মার্চে রাজধানীর একটি হোটেলে ডায়ালগ উইথ চায়না অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সমন্বয়ে গঠিত কোয়াডে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই বলে মন্তব্য করেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। এই মন্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির জন্য সুখকর নয়। তাছাড়া চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে মিসাইল রক্ষণাবেক্ষণ স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে এ সংক্রান্ত মিডিয়া রিপোর্টেও ভারতের জন্য চিন্তার কারণ। প্রধানমন্ত্রী ভারতের গার্ড অফ অনার শেষে সাংবাদিকদের দেয়া বক্তব্যর সময় অনেকটা আবেগতাড়িত মনে হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার অতীতে ভারতের বিভিন্ন সহযোগীতা স্মরণ করে আবেগতাড়িত ছিলেন।

সুতরাং বলা চলে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে মিয়ানমার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা অনেকটা সফল। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় মিয়ানমার কোন ইস্যু, চীনের স্বার্থ বিরোধী কোন ইস্যু স্থান পায়নি। এতে প্রকারান্তরে মিয়ানমারের ভূমিকার মাধ্যমে চীনের ভূমিকা কতটুকু সফল হলো তা আগামী নির্বাচনে বুঝা যাবে।

 লেখকঃ কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত