পাকিস্তান আজ এক ব্যর্থ রাষ্ট্র, বেনানা রিপাবলিক

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ১২:৫৭ |  আপডেট  : ৪ মে ২০২৪, ১৫:২৫

৭ই মার্চ ১৯৭১ সাল, ঢাকার রমনায় রেসকোর্স ময়দানে এক মহানায়ক দৃঢ়, কুন্ঠাহীন, বলিষ্ঠ পাদবিক্ষেপে এসে দাঁড়ালেন, চারিদিক শ্লোগানে শ্লোগানে হলো মুখরিত। জনসভায় জনস্রোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষনা করলেন, রচনা করলেন এক মহাকাব্য, ঐতিহাসিক ভাষণ। রচিত হলো একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’’ এই মহান মার্চ মাসেই প্রমাণিত হলো জাতির পিতার সে ডাক ছিল সঠিক। কারণ সন্ত্রাস দুর্নীতির কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের পথে, পাকিস্তান আজ এক বেনানা রিপাবলিক।  

মুসলমান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হয়। ১৯৪৮ সালেই রাষ্ট্রপ্রধান মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোষণা করলেন :  Urdu shall be the state language of Pakistan. । চারিদিক মুখোরিত হয়ে আওয়াজ উঠল 'No'. 'No', 'N'o। শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষাকেও মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে তীব্র ছাত্র গণ-আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে মিছিলে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে গুলি চালাল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশবাহিনী। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবীকে রক্তে রাঙ্গিয়ে দেয়া হলো। সেই রক্তের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে উপস্থাপন করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। শুরু হয় সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসন। এরপর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সরকার গঠন করতে দিলেন না জেনারেল ইয়াহিয়া খান। শুরু করে নির্মম অত্যাচার হত্যা। বিভিন্ন আর্ন্তজাতীক চাপ, আমেরিকার হুমকি উপেক্ষা করে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন স্বাধীনতার। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম।

পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকে ইতিহাস খুবই উত্তাল। ক্ষমতা, লোভ এবং পৃষ্ঠপোষকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইসলামিক বা ধর্মনিরপেক্ষতা, উগ্র আদর্শিক বিতর্ক, জাতীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতির কারণে পাকিস্তানকে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সিভিল সার্ভিস এবং সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হয়েছে। পাকিস্তানের বহুমুখী সমস্যা ১৯৪০ সালের মার্চে শুরু। দেশভাগের ফলে সৃষ্ট ব্যাঘাতের কারণে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাকিস্তানে বিশটিরও বেশি ভাষা এবং ৩০০ টিরও বেশি স্বতন্ত্র উপভাষা রয়েছে। এই বৈচিত্র্য দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং সংবিধান গঠনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণ। পাকিস্তানের রাজনীতি প্রাদেশিক ঈর্ষা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ছোট প্রদেশগুলিতে গভীর অসন্তোষ এবং পাঞ্জাবি সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা প্রভাবিত। ঐতিহাসিকভাবে, পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেননি। মজার বিষয় হল, তাদের অধিকাংশকেই সংবিধান বহির্ভূত/সংসদীয় বা বিচারিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে, তবুও কোনো প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়নি। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ক্ষমতায় চতুর্থ বছরে বিচার বিভাগ, সামরিক শাসক আর কথিত মার্কিন যোগসাজশে রাজনৈতিক অনাস্থা ভোটের নাটকে মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে।

খান অভিযোগ করেন, তিনি পাকিস্তানে "শাসন পরিবর্তন" প্রভাবিত করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার শিকার। ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বর্তমান সরকারকে তিরস্কার করে, খান অভিযোগ করেন যে তারা (মার্কিন) আইন প্রণেতাদের বিবেক কিনেছে, ফলে আইন প্রণেতারা "বিদেশী শক্তির (যুক্তরাষ্ট্রর) বুট পালিশ করেছে"। ৩ নভেম্বর ২০২২, খান তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে একটি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন খানের কন্টেইনার-মাউন্ট করা ট্রাকে একজন বন্দুকধারী গুলি চালায়। খানের এক সহযোগীর মতে, ট্রাকটিতে ছয়বার গুলি চালানো হয়। খান তার ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। মোট ১৪ জন আহত এবং খানের এক সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গত সপ্তাহে খান লাহোরে একটি নির্বাচনী সমাবেশে পুলিশের অভিযানে তার কয়েক ডজন সমর্থককে গ্রেপ্তার ও আহত করার পর পাকিস্তান সরকার তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার অভিযোগ করেছেন। জনসমাবেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য পুলিশ তার সমর্থকদের উপর টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান ব্যবহার করার পরে, পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী পূর্ব শহরটিতে খান তার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এর একটি সমাবেশ বন্ধ করে দেন। PTI -এর ৩০ এপ্রিল নির্ধারিত প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রচার শুরু করার জন্য একটি সমাবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ "কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে" শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে অনুষ্ঠানটি নিষিদ্ধ করেছিল। খান দাবি করেছেন দলীয় সমর্থক আলী বিলালকে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বিরোধী সমর্থকদের ওপর পুলিশের দমন-পীড়নকে "অপ্রয়োজনীয় এবং নৃশংস" বলে অভিহিত করেছেন। পুলিশ রবিবার খানকে লাহোরে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করেছিল। মঙ্গলবার, ইসলামাবাদ হাইকোর্ট খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেছে। আদালতের একক বিচারকের বেঞ্চ পুলিশকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত খানকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দিয়েছে। ইমরান খান রবিবার তার সমর্থকদের সম্বোধন করেছিলেন যখন পুলিশ তোশাখানা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করতে লাহোরে তার বাসভবনে পৌঁছেছিল। খান বলেন, “এভাবেই একটি দেশ বেনানা রিপাবলিকে পরিণত হয়।”

পাকিস্তানের ধ্বংসের জন্য দায়ী সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক প্রধানরা। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার, মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর কারণে পাকিস্তান আজ দেউলিয়াত্ব এবং ঋণের বোঝার বতর্মান সরকারের শেহবাজ শরিফ একটি টুইটে বলেছেন যে খানের সরকার "গত ২০ বছরে দুর্নীতির সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল,"। বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) দলের শহীদ খাকান আব্বাসি ডিডব্লিউকে বলেছেন, খানের সরকারের অধীনে দুর্নীতি সর্বকালের সর্বোচ্চ। খানের শাসনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবাদিকদের উপর হামলা এবং দেশে আইনের শাসনের অবনতি হয়েছিল। পাকিস্তানে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। কয়েক ডজন বিরোধী ব্যক্তিত্বকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাদের বিচার করা হয়নি। ইমরান খান স্বীকার করেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিদেশী অতিথিদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার ছাড়ের হারে তোষাখানা থেকে নিয়েছেন। এসব উপহারের মধ্যে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের দেওয়া একটি দামি হাতঘড়ি ছিল। খানের স্ত্রী বুশরা বিবি গোপনে রেকর্ড করা অডিও ক্লিপগুলিতে ধরা পড়েছে যে খানের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে সেই উপহারগুলি নিষ্পত্তি করতে বলেছিল এবং পরে দুবাইতে তা করেছিলেন। হীরা খচিত ঘড়িটি দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল।

পাকিস্তানের বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া সম্পর্কে ফ্যাক্ট ফোকাসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তার পরিবারসহ তাদের সম্পদ ১২.৭ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (৪৭ মিলিয়ন ডলার) বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তাানে সব মেগা প্রকল্প যেখানে ২৬.৫ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক রাজস্ব রয়েছে, সামরিক বাহিনী জড়িত। আসকারি ফাউন্ডেশন, ফৌজি ফাউন্ডেশন (পাকিস্তান আর্মি), শাহীন ফাউন্ডেশন (পাকিস্তান এয়ার ফোর্স), বাহরিয়া ফাউন্ডেশন (পাকিস্তান নৌবাহিনী), আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি এবং অন্যান্য জনহিতৈষী সংস্থার নামে এই সংগঠনটি চলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় প্রতিটি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে জড়িত। ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, ন্যাশনাল লজিস্টিক সেল, ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন এবং স্পেশাল কমিউনিকেশনস অর্গানাইজেশন (এসসিও) সহ এক ডজনেরও বেশি পাবলিক সেক্টর ইউনিট পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দেশের শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আসকারি ব্যাংক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন। বায়ু এবং সৌর শক্তি এবং রিয়েল এস্টেট উন্নয়নেও সেনাবাহিনী মেগা প্লেয়ার।

পঁচাত্তর বছর আগে পাকিস্তান তার সূচনা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে শুরু করে। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখতে, অভিজাতদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রদেশগুলির মধ্যে লড়াই দ্বন্ধ বিরাজমান, রাজনৈতিক অস্তিরতা, সামরিক বাহিনীর প্রভাব, দূর্নীতি গত পাঁচ দশকে পাকিস্তানকে প্রকৃত স্থিতিশীলতা অর্জন করতে দেয় নি। সামরিক শাসন এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলির মধ্যে দ্বন্ধ লেগেয় আছে। পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজরা, দুর্নীতিবাজ শাসক ও সেনাবাহিনী দেশের অর্থনীতিকে খেলাপির মতো অন্ধকারে টেনে নিয়ে গেছে । প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের সাথে শাসনের ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং বৈদেশিক নীতির ভুলগুলির কারণে পাকিস্তান আজ এক ব্যর্থ রাষ্ট্র, বেনানা রিপাবলিক।  

 

লেখকঃ অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ।

 

 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত