পাকিস্তানি পতাকা ইস্যুর সমাধান কী জুতাপেটায়?
প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:২৬ | আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৯
আবদুর রহমান বিশ্বাসকে মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বানায় বিএনপি; তার মৃত্যুর পর শোক জানান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের' বাম রাজনীতিক রাশেদ খান মেননের ভগ্নিপতি রহমান বিশ্বাসের মৃত্যুতে বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতার মুখ 'শোকাতুর' হয়ে ওঠে। বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের একাত্তরের কাহিনি পত্রিকায় লেখে পা হারিয়েছেন এক সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিটিভি মুসাকে অ্যাখ্যা দেয় 'বীরসন্তান'। মুসা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক নেতার 'বেয়াই'।
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করা রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে 'সামাজিক বর্জন' করার আহবান জানানো হয়ে থাকে 'চেতনার পক্ষের' রাজনৈতিক গোষ্ঠী থেকে। এর অংশ হিসেবে খেলার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা বহনকারীদের 'সামাজিক বর্জনের' শ্লোগান কয়েক দিন ধরে জোরালো। 'পাকিস্তানি পতাকা' বহন করায় একাধিকজনকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা, নালার পানিতে পড়তে বাধ্য করার ঘটনা ঘটে। 'সামাজিক বর্জন' কী শুধু সাধারণ মানুষই করবে, রাজনীতিকদের করতে হবে না? খেলার মাঠে কেউ পাকিস্তানি পতাকা উঁচিয়ে ধরলে সরকার ও প্রশাসন সেখানে ভূমিকা না রেখে এর বিচারের ভার জনতার কাঁধে গছিয়ে দিতে পারে?
আওয়ামী লীগের কয়েক শীর্ষনেতাসহ নগর, জেলা, থানা, তৃণমূলের নেতাদের রাজাকার পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গত পঞ্চাশ বছরে ভয়াল নির্মম সামাজিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। সেসব নেতা ও তাদের পরিবারের পক্ষে 'পাকিস্তানপন্থিদের সামাজিক বর্জন' কী সম্ভব? বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে এ আলোচনায় ঠাঁই দেয়ার দরকার নেই; দল দুটি 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি' করে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিলে রাজাকারদেরকে বর্জনের দায়িত্বটা বর্তায় 'রাজনীতিসচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের' কাঁধে। এ শ্রেণির মধ্যে 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের' সমর্থকদের বিভাজনও বেশ 'চমকপ্রদ'! এ বিভাজনে বিভিন্ন সরকার, দল মদদ দিয়ে এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধে সামান্য ভূমিকা না রাখা শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষগোষ্ঠীর বড় কবি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া কবি আল মাহমুদ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতাকারীদের 'সাহিত্যিক নেতা'। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, এক নাটকে তাঁকে কথিত 'গণধিকৃত' অ্যাখ্যা দেয়া কবি সৈয়দ শামসুল হক একটা পর্যায় থেকে হয়ে ওঠেন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দলের'। স্বৈরাচারী হু.মু. এরশাদ সরকারের দালালি করা সৈয়দ হক একসময় মাঠে নামেন 'বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে'। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক চেতনা ও গোষ্ঠী- দুটির গোড়াতেই আদর্শগত সমস্যা প্রকট। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু কোনো শ্লোগান নয়, অবিরাম আদর্শ।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে রাজনীতিক, কবি, লেখক, সাংবাদিকসহ জাতির একটা মূখ্য অংশ সেই 'অবিরাম আদর্শ' থেকে সরে গেছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশেরও নৈতিক অধ:পতন শুরু হয় বিজয়ের পর থেকে। তারা দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন, বনে যান কোটিপতি। আবার পঞ্চাশ বছর পরও প্রান্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ রয়ে গেছেন দারিদ্র্যের সেই অন্ধকারে। এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশের নৈতিক অধ:পতনের ঘটনা পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রের জন্মযোদ্ধাদের বেলায় তেমন নেই।
রাজনীতিক ও রাজনীতিক হতে চাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শহীন হয়ে পড়ার ঘটনাগুলো লজ্জাজনক, নিন্দিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধি জিয়াউর রহমান, এরশাদের সরকারে যোগ দিতে তারা সামান্য দ্বিধা করেননি। তাদের মধ্যে অনেকে বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে খেয়ে আওয়ামী লীগে ফিরেছেন। আদর্শচ্যুত এসব নেতার আদর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে কখনো প্রশ্ন তোলেনি। রাজনীতিক হতে চাওয়া মুক্তিযোদ্ধা, অভিনেতা সোহেল রানা, কণ্ঠশিল্পী কনক চাঁপাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস, আদর্শ পুরোদস্তুর রাজনীতিকদের মতোই।
আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য হওয়ার মনোনয়ন না পেয়ে সোহেল রানা চলে গেছেন জাতীয় পার্টির মতো ভয়ানক সাম্প্রদায়িক একটা দলে, কনক চাপা যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিশ্বাসের 'বিপরিতমুখি দল' বিএনপিতে। কাণ্ড দুটির আগে দুজনেই ছিলেন 'কড়া আওয়ামী লীগার'। পতাকা নিয়ে 'সরকারি রাজনীতির' উদাহরণ দেয়া যায় কনক চাপার একটা গান প্রসঙ্গে। মহাজোট সরকারের আমলে তাঁর গাওয়া 'ওই পতাকা আমার মায়ের মুখের মতো কারুকার্যময়, ওই পতাকা আমার বাবার চোখের মতো দূরদৃষ্টিময়' বিটিভিতে প্রচার শুরু হয়। তিনি বিএনপিতে চলে গেলে বিটিভি গানটির প্রচার বন্ধ করে দেয়। অসাধারণ সুর, নান্দনিক কথার গানটি দর্শককে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করছে কী না- এটা মূখ্য নয়। মূখ্য হচ্ছে- গানটি যিনি গেয়েছেন, তিনি 'আমাদের লোক' কী না।
ক্রিকেটে পাকিস্তান দলকে সমর্থন করা দেশে বিভেদমূলক বিষয়। পাকিস্তানের সঙ্গে এবারের সিরিজের শুরু থেকে গ্যালারিতে দেশটির পতাকা ওড়ানো নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। নাগরিক হিসেবে এর প্রতিবাদ জানানো যায়। গ্যালারিতে পতাকা ওড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অবজ্ঞা করার বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব সরকারের। সরকারি কোনো সংস্থা তা করেনি কেনো? মাঠে পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট আইন এতো বছরের মধ্যে সরকার করেনি কেনো? এ বিষয়ে কোনো নির্দেশ দিয়ে তা কার্যকর করতে খেলা চলাকালে সরকার প্রশাসনকে মাঠে রাখেনি কেনো? পাকিস্তানকে সমর্থন করার বিভেদমূলক বিষয়গুলো জিইয়ে রেখে সরকারগুলো রাজনৈতিক সুবিধা লুটছে কেনো?
যে দেশের মাটি ছুঁয়ে দিলে শহিদদের রক্তে ভিজে আসে হাতের সব আঙুল, সেই দেশের খেলার মাঠে বিজয়ের মাসের আগে একাত্তরের শত্রুপক্ষ পাকিস্তানের পতাকা মেনে নেয়া যায় না- এটা পরীক্ষিত সত্য। তবে পাকিস্তানি পতাকা হাতে রাখায় প্রকাশ্যে কারোকে জুতাপেটা করা, নালার পানিতে নামতে বাধ্য করার বিষয়গুলো কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, দেশ এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আছে, যে অবস্থায় প্রশাসন কার্যকর থাকে। প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রশাসনকে পালন করতে হয়। কারোকে জুতাপেটা করা, গুজবের বশে পিটিয়ে মেরে ফেলার কাজটা সাধারণ, বা অসাধারণ- কোনো নাগরিকেরই নয়।
লেখক- সাংবাদিক ও কলাম লেখক
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত