"নিদারাবাদ হত্যাকান্ড ব্রাহ্মণবড়িয়া"

  শ্যামল কুমার রায়

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৩৯ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ১২:২৭

১৯৮৭ সাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা বর্তমানে বিজয়নগর উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামের শশাঙ্ক  দেবনাথকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। গ্রামবাসী বা তার পরিবার কেউ জানতো না শশাঙ্ক কোথায়। দুই বছর পর  ১৯৮৯ সাল এবার হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো শশাঙ্কের পুরো পরিবার। এক রাতেই হাওয়া শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী বিরজাবালা ও তার ৫ সন্তান।

গ্রামের দুতিনজন প্রচার করে বেড়াচ্ছিলো যে, শশাঙ্ক আগেই ভারতে চলে গিয়েছে। তারপর সুযোগ মত তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের অতি সঙ্গোপনে নিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে গ্রামের কয়েক জন দাবী করে বলতে থাকে যে, শশাঙ্ক নিজে তার বাড়ীঘর ও জায়গাজমি দাবীকৃতদের কাছে বিক্রি করে গেছে। দাবীকৃতদের একজন পাশের গ্রামের তাজুল কসাই। শশাঙ্কের সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দাবীকৃতদের মধ্যে একাধিকবার ঝগড়াঝাটি হলেও এক সময় তা আবার মিটেও যায়।

এই ঘটনায় নিদারাবাদ গ্রামের লোকজন শশাঙ্ককে গালাগালও করতে থাকে। শালা মালাউন এক সম্পত্তি ৩ জনের কাছে বিক্রি করে গেছে। বেঈমান, মীরজাফর দেশদ্রোহী ইত্যাদি বলে। কিছুদিন পরে স্কুল শিক্ষক আবুল মোবারক একদিন পড়ন্ত বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে ধোপাজুড়ি বিলের পানিতে দুর্গন্ধযুক্ত  তেল ভাসতে দেখেন। মাষ্টার তার নৌকার গতিপথ  একটু ঘুড়িয়ে নিতেই হঠাৎ কি যেন একটায় নৌকাটি আটকে যায় এবং এক পর্যায়ে নৌকাটি নিচ থেকে উপরের দিকে ঝাঁকুনিতে দুলে উঠে। নৌকাটি সরাতে মাঝির বৈঠায় এক ধরণের খটখটে আওয়াজ হয়। এতে মাষ্টার আবুল মোবারকের সন্দেহ আরও ঘনিভুত হতে থাকে। মাষ্টারের নির্দেশে মাঝি বৈঠা দিয়ে পানির নীচে খটখট করতেই ভেসে উঠে একটি ড্রাম। এ ঘটনায় আবুল মাষ্টার ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গণ্যমান্যদের দ্রুত খবর দেন। 

চেয়ারম্যানের নির্দেশে ড্রাম তুলে খোলার সাথে সাথে সবাই হতভম্ব ও স্তব্ধ হয়ে যায়। তেলের ড্রামের মধ্যে টুকরো করা ৩টি লাশ। এরপর সন্ধান চালিয়ে আরও একটি ড্রাম উদ্ধার করে তাতে টুকরো করা আরও ৩টি লাশ মোট ৬ জনের লাশ শনাক্ত করেন। এরাই ছিল নিদারাবাদ গ্রামের নিরীহ হতভাগ্য শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী  বিরজাবালা ও তার অবুঝ ৫ সন্তানের লাশ। বিরজাবাল(৪৫) কন্য নিয়তিবালা(১৭) প্রণতিবালা(১০) পুত্র সুভাষ দেবনাথ(১৪) সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন(৫) ও সুজন দেবনাথ(২)। 

গ্রামের ভাষায় একটি প্রচলিত কথা আছে, ধর্মের ঢোল নাকি পায়ে পেচিয়েও ফিরে আসে। শশাঙ্ক দেবনাথের বাড়ীঘর, জায়গাজমি দখল করার নিকৃষ্ট পরিকল্পনা থেকে তাজুল কসাই তার সঙ্গিদের নিয়ে প্রথমে শশাঙ্ককে খুন করে গুম করে ফেলে। তারপরে একরাতে পুরো পরিবারের সদস্যদের (বিরজাবালা ও তার ৫ সন্তানকে) নৌকায় তুলে মধ্য বিলে নিয়ে হত্যা করে ৬ টি লাশ টুকরো করে ২টি তেলের ড্রামে ভরে লাশ পচনের জন্য চুনা দিয়ে  ড্রামের মুখ আটকিয়ে পাথর বেধে বিলের পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলো। সম্পত্তি গ্রাসের লোভে একটি নিরীহ সংখ্যালঘু পরিবারের সাত ৭ জন নারী শিশুসহ জীবন্ত মানুষকে রোমহর্ষক কায়দায় হত্যা করে সাম্প্রদায়িক অপবাদ দিয়ে কি অভিনব নাটক সাজিয়ে ছিলো যা, গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে উল্টো হতভাগ্য শশাঙ্ককেই গালাগাল দিচ্ছিলো।

এহেন রোমহর্ষক হত্যাকান্ড তাজুল গংরা কুখ্যাত কিছু প্রভাবশালীদের সহায়তায় আড়াল করতে পারলেও সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিকে আড়াল করতে পারে নাই। হতভাগ্য শশাঙ্কদের এদেশে জন্মই যেন আজন্ম পাপ। খুনি কসাই তাজুলসহ ৩ জনের সেই ঘটনার বিচারে ফাঁসি হলেও প্রভাবশালীদের কয়েকজন এখনো আইনের চোখে ফাঁকি দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেছে। দুর্ভাগা এদেশে কারো প্রতি বিরাগ বা ক্ষোভের বশীভূত না হয়ে ইতিহাসের কাছে শুধু প্রশ্ন রেখে বলছি নিদারাবাদ সাত খুনের ঘটনা থেকে দেশ, জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্র আদৌ কোন শিক্ষা গ্রহণ করেছে কি? মানুষ আমরা কেউই থাকবো না কিন্তু ইতিহাস তার আপন গতিতে চলমান থাকবে যেখানে প্রযুক্তি সুদীর্ঘকাল পরে হলেও  ইতিহাসের বর্তমানের সাক্ষী হয়ে হাজির হবে। আর সেদিনই হয়তোবা নিদারাবাদ, চকোরিয়া হত্যাকান্ডের মত রোমহর্ষক মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকেই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে।

লেখকঃ সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত