তিন জনের মৃত্যুঃত্রিমুখী বেদনা

  জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:৩১ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ০৪:০২

বিক্রমপুরের জনাব মাহে আলম সিএসপি,ইন্জিনিয়র ড.আবুল কাশেম ও চট্টগ্রামের গণ চিকিৎসক ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে আমার অন্তরে ত্রিমুখী বেদনা টের পাচ্ছি, তিনজনকেই চিনতাম ।তিনজনের সুহৃদ ছিলাম। মাহে আলম সাহেবের সাথে পরিচয়ের আগে তাঁর নাম শুনেছি। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের নির্বাচনী জনসভা রারিখাল ইউনিয়নে করতে গিয়ে প্রথম মাহে আলমের নাম শুনি। ষোলঘরের গিয়াসউদ্দীন আহমদ রঙ্গু সে সভায় নৌকা মার্কার পক্ষে বক্তৃতা দিতে গিয়ে “ আমাদের এই গ্রামের মাহে আলম,সিএসপি মাহে আলম,ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট মাহে আলম ……. ইত্যাদি বলেন।”  তিনি নৌকা মার্কা ও আওয়ামী লীগের জনসভায় শুধু মাহে আলম.... মাহে আলম... বলেছিলেন আবেগের বশে। কারন বিক্রমপুরে হাতেগোনা যে কয়জন সিএসপি অফিসার পাকিস্তান আমলে ছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন জন্ম মাহে আলম। তাঁর পিতা খোরশেদ আলম ছিলেন রারিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, খুবই ভদ্র লোক ছিলেন তিনি। বাবার মতো পুত্রও ছিলেন খুব ভদ্র, তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় কবে, কোথায়, কিভাবে হয়েছিল তা স্মরণ করতে পারছি না। তবে প্রথম পরিচয়ে ,আমি শ্রীনগরের জয়নাল আবেদীন বলার সাথে সাথে তিনি বলেছিলেন- “তোমার নাম আমি বহুদিন যাবত জানি। তুমি প্রায়ই ইত্তেফাক ও সংবাদ পত্রিকায় বিক্রমপুরের বিশেষ করে শ্রীনগরের নানা সমস্যা নিয়ে লিখে থাক। ঐ রাস্তা নাই ,ঐ পুলটি ভাঙ্গা ইত্যাদি আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকি।” সেই পরিচয় আমৃত্যু তাঁর সাথে আমার ছিল। কোন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে অফিসার্স ক্লাব ঢাকার বার্ষিক সাধারন সভায় / নির্বাচনের দিন দেখা হতো। কাছে গিয়ে সালাম দিতাম, তিনি সালামের জবাব দিয়ে বলতেন - কেমন আছ জয়নাল? এই যে মানুষকে মনে রাখা,কুশলাদি জানতে চাওয়া সবাই করে না। তিনি ছিলেন শান্ত স্বভাবের মানুষ,সৎ চরিত্রের মানুষ। অহংকার তাঁর মধ্যে ছিল না, নীতি নিয়ে কাজ করেছেন জীবনভর। সর্বশেষ দেখা হয় গ্রামের বাড়ির সামনের রাস্তায়। আমি হুমায়ুন আজাদের সমাধীতে গিয়ে ফিরার সময় তাঁকে দেখে এগিয়ে যাই, সালাম দেই। সেটাই ছিল শেষ দেখা। হঠাৎ তাঁর মৃত্যু সংবাদে আমি মনে দারুন আঘাত পাই। মনে অনুভব করি অতি আপনজনের বিয়োগ ব্যথা। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নসিব করুন।

ইন্জিনিয়ার আবুল কাশেম রারিখালের সন্তান হলেও তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয় ১৯৯১ সালের দিকে। আমি তখন কৃষি ব্যাংকের এজিএম, মতিঝিলের অফিসে আসেন কাশেম সাহেব আমাকে দেখতে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন” আপনাকে দেখতে আসলাম এই জন্য যে আপনার সম্পাদিত বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন স্মরণিকা আমার এত ভাল লেগেছে যে সম্পাদককে না দেখে থাকতে পারলাম না। ”সেই যে পরিচয় তা ছিল সব সময়। আমার মনে আছে- ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জননেত্রী শেখ হাসিনা মহিলা কোটায় বিক্রমপুরে সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলিকে এমপি করে। তাঁকে আওয়ামী লীগাররা এলাকায় পাত্তা দিচ্ছিল না। কাশেম ভাই ছুটে আসেন আমার কাছে বলেন “মুন্সিগঞ্জে ইলেকশনে আওয়ামী লীগ একটা আসনও জিততে পারে না। নেত্রী দয়া করে একজন এমপি দিয়েছেন - তাঁকেতো কাজ করতে দিতে হবে। দলকে সংগঠিত করতে হবে।” এ ব্যাপারে তিনি আমার সহায়তা চান। তাঁর অনুরোধে আমি ভূমিকা রাখি যাতে মহিলা এমপি এলাকায় কাজ করে দলকে চাঙ্গা করতে পারেন। কাশেম ভাই একবার উদ্যেগ নেন আওয়ামী লীগকে তৃনমূল থেকে সংগঠিত করার। আমরা কাজ শুরুও করেছিলাম, কিন্তু দূর্নীতিবাজ এক ব্যবসায়ী টাকা ছড়িয়ে ম্যাসেলম্যান টাইপ লোকজনের সহায়তায় তৃনমূল থেকে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই আমরা বিকল্প পথে কাজে নামি, তিনি স্যার জেসি বোস উচ্চ বিদ্যালয়ের উন্নয়নে মনোযোগ দেন। বিজ্ঞানীর কর্মকান্ড যাতে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে সে জন্য গড়ে তোলেন জেসি বোস মিউজিয়াম। গঠন করেন জেসি বোস ফাউন্ডেশন। স্কুলে বিজ্ঞান মেলা,নববর্ষ ইত্যাদির আয়োজন করেন। তাঁর ঢাকার বাসায় ও গ্রামের বাড়িতে একাধিকবার গিয়েছি।দেখেছি সে সব ঘরোয়া অনুষ্ঠানে স্বস্ত্রীক যোগ দিতেন সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমান। ঢাকায় এক সন্ধ্যায় জেসি বোস ফাউন্ডশনের ব্যানারে বিজ্ঞানীর নামে বড় কিছু করার বিষয়ে এক সভা হয়। নোয়াখালী এলাকার এক ভদ্রমহিলা ভারত সরকারের সহায়তায় অনেক কিছু করবেন বলে জানালেন। পরে আর কিছুই হলো না। তিনি বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সাধারন সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সকল অনুষ্ঠানের কার্ড পেতাম। এলাকায় কোন অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতি তিনি প্রয়োজন মনে করলে বাসা থেকে খুব ভোরে আমাকে নিয়ে যেতেন। ষোলঘর বাস স্টেশনের তাঁর পরিচিত এক দোকানে আমরা নাস্তা করতাম। অনেক দিন পরে একদিন ফোন করে আমাকে জানালেন তাঁর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানীর বিষয়ে উপজেলা সমাজ কল্যাণ অফিসে কাজ আছে। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চান, আমি বললাম একদিন আগে জানাবেন-আমি যাব। এই যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। পরে একদিন বললেন শরীর ভাল যাচ্ছে না। চিকিৎসা নিয়ে একদিন যাবেন, কিন্তু নিতে গিয়েই চলে গেলেন না ফেরার জগতে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমার জন্য খুব বেদনা ও শোকের । তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নসিব করুন।

ডাঃ জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে চিনি বহুদিন ধরে। তবে তাঁর সাথে সামনে সামনে আলাপ ছিল না। এ সুযোগ মিলে ডাঃ এম এন নন্দীর এক স্মরণ সভায়। তিনি ও আমি ডাঃ নন্দীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করি। তিনি সে সভায় বলেন- তাঁর পিতা অসুস্থ হলে একদিন ডাঃ নন্দীর ওয়ারির চেম্বারে নিয়ে যান। সব শুনে ডাঃ নন্দী বলেন চিকিৎসার দরকার নেই। সিগারেট না ছাড়লে কবর ঠিক করে রাখেন। এ কথার পরে তাঁর বাবা সিগারেট ছাড়েন এবং ডাঃ নন্দীর চিকিৎসায় ভাল হন। এর পরে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ করতে গিয়ে। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ৯ তলায় তিনি একটি কক্ষ সংঘকে ব্যবহার করতে দেন। সাপ্তাহিক সভা আমরা সেখানে করতাম। করোনার কারনে এখন আর সাপ্তাহিক ভাবে বসা হয় না। তবে মাসে একবার ৫ তলার মিলনায়তনে মাসিক সেমিনার আমরা একত্রিত হই। সেমিনার ডাঃ চৌধুরী মাঝেমধ্য আসতেন। একদিন তিনি ফটোগ্রাফার দিয়ে আমাদের সাথে অনেক ছবি তোলেন। ১৯৭১ সালে তিনি উচ্চ ডিগ্রীর ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে যোগদান করেন মুক্তিযুদ্ধে। গড়ে তোলেন বিশ্রামগন্জে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গণ হাসপাতাল। হাজার হাজার আহত মুক্তিযোদ্ধা সেখানে চিকিৎসা পায়। স্বাধীনতার শেষলগ্নে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানির সাথে হেলিকপ্টার যোগে কলকাতা ফিরার পথে তাঁদের বহন করা হেলিকপ্টারে গুলি লাগে। এতে একজন আহত হয় এবং কপ্টারের অংয়েল ট্যাঙ্ক ছিদ্র হয়ে যায়। সহযাত্রীর বুদ্ধিমত্তায় জরুরী অবতরন করে তাঁরা বেঁচে যান। শেখ কামালও তাঁদের সাথে ছিলেন। ডাঃ জাফর উল্লাহ অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর মননে এ পরিবর্তন ঘটায়। এরশাদ আমলে তিনি যে ঔষধ নীতি চালু করেছিলেন তা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এতে অপ্রয়োজনীয় অনেক ঔষধ নিষিদ্ধ হয়, ঔষধের দাম কমে যায়। তিনি ছিলেন জনবান্ধব চিকিৎসক। গ্রামের গরীবের চিকিৎসা নিয়ে তিনি ভাবতেন এবং সে লক্ষে কাজ করতেন। সাভারের গণ হাসপাতাল,গণ বিশ্ববিদ্যালয় ও ধানমন্ডির নগর হাসপাতাল তাঁর অনন্য কীর্তি। তাঁর মৃত্যু নেই,তিনি অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন চির দিন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত