চিকিৎসক-পুলিশ বাকবিতণ্ডা: পাল্টাপাল্টি বিবৃতি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৬ |  আপডেট  : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০৭

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসকের সাথে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের বিতণ্ডা এখন দেশব্যাপী আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পরার পর থেকেই শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। কেউ কেউ দুষছেন চিকিৎসককে, কেউ কেউ পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে, কেউবা আবার উভয়পক্ষের আচরণকেই দায়ী করছেন। বলছেন, এখানে উভয়পক্ষকেই সংযত হওয়া দরকার ছিল। 

এরইমধ্যে ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ)। এ ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরকে দায়ী করে যথাযথ বিচার দাবি করে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। 

কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ‘অপেশাদার এবং অপমানজনক’ আচরণ করে নিয়ম ভঙ্গ করার কারণে ওই চিকিৎসকের বিচার দাবি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। আর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়রানি ও নাজেহাল না করতে এবং গতকালের ঘটনায় দ্রুত তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন।

সোমবার (১৯ এপ্রিল) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংক্রমণ রোধে সরকারি আদেশ বাস্তবায়নে চলমান কার্যক্রম হিসেবে গত রোববার (১৮ এপ্রিল) রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের প্রতি অসদাচরণ হয়রানি ও অসহযোগিতার কিছু চিত্র গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যা বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই স্থানে এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে চেকপোস্ট চলাকালে এক চিকিৎসককে (ডা. সাঈদা শওকত জেনি) তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র দেখাতে বললে, তিনি অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে কর্তব্যরতদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। যা একজন পেশাদার ও সচেতন নাগরিকের কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি শুধু ওই পুলিশ সদস্যদের এই অপমান করেননি গোটা পুলিশ বাহিনীকে কটাক্ষ, হেয় প্রতিপন্ন করেছেন যা গণমাধ্যমে এসেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নিজ পেশার পরিচয় বাদ দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক পরিচয় তুলে ধরে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন এবং জাতির সামনে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য কার্যক্রমে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাফতরিক পরিচয়পত্র আবশ্যিকভাবে ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও তিনি তা অমান্য করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তার পরিচয় না দিয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন করেছেন। উক্ত চিকিৎসক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাদানুবাদকালে যে শব্দ প্রয়োগ করেছেন তা অত্যন্ত অরুচিকর এবং লজ্জাজনক। এক পেশার সদস্য হয়ে আরেক পেশার কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি কী ভাষা প্রয়োগ করেছেন তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেছেন এবং ‘আর আমি কী সেটা এখন তোদের দেখাচ্ছি হারামজাদা’ বলে হুমকি দিয়েছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই পর্যন্ত কর্তব্যরত অবস্থায় ৯১ পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এছাড়া ২০ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। পেশাগত বৈচিত্র্যের কারণে পুলিশের এই চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনকালে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। করোনাকালে দেশের স্বার্থে ও মানুষের জীবন রক্ষার্থে ও করোনার বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেতে পুলিশের কাজে সবাই সহযোগিতা করবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশা। এছাড়া বাংলাদেশ করোনা মহামারি মোকাবিলায় এবং করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় মেডিকেল সার্ভিসে নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অব্যাহত কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সর্বদা কৃতজ্ঞ।

এতে আরও বলা হয়, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের প্রতি ওই চিকিৎসকের অপেশাদার এবং অরুচিকর আচরণে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য অত্যন্ত মর্মাহত। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। একজন গর্বিত পেশার সদস্য হয়ে অন্য একজন পেশাদার বাহিনীর সদস্যদের প্রতি কটাক্ষ বা অসৌজন্যমূলক আচরণ কখনই কাম্য নয়। নিজ মন্ত্রণালয়ের বৈধ আদেশ লঙ্ঘন এবং কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জোর দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সব শ্রেণি-পেশার লোকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারি নির্দেশনা পালনে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে।

এদিকে, সোমবার (১৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরীর স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে চলমান লকডাউনকালীন সময়ে সম্মুখ সারির যে চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীগণ কর্মস্থলে যাতায়াতকালে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হয়রানী ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এধরনের ঘটনা ঘটায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীগণ আতঙ্কগ্রস্থ ও হতাশ হয়ে পড়ছেন।

রোববার এলিফ্যান্ট রোড এলাকার ঘটনা নিয়ে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাইদা শওকত জেনীর গাড়ি আটকিয়ে পরিচয় জানতে চাওয়ার নামে একজন নারী চিকিৎসককে যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে তার খবর ও আংশিক ভিডিও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজ গাড়িতে কর্মরত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের স্টীকার লাগানো এবং নিজের নামাঙ্কিত চিকিৎসক গাউন পরিহিত অবস্থায় নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে আক্রমণাত্মকভাবে জেরা করে উত্যক্ত ও হেনস্থা করার খবর দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। 

এতগুলো পরিচয় দেওয়ার পরও কেবলমাত্র মুভমেন্ট পাস ও প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ডের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এহেন আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়। সচিবালয় কিংবা পুলিশ কিংবা সাংবাদিক লেখা স্টিকারমুক্ত কোন গাড়ি কোথাও আটকানো হয়েছে বা থামানো হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত নজির নেই। অধিকন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট চিকিৎসকই প্রাইভেট প্রাকটিসের সাথে জড়িত। তারা সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন না। ফলে তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ডও নেই।

ক্রমাগত এ ধরনের ঘটনা সংগঠিত হওয়ার কারণে বিষয়টি এসোসিয়েশনের সভাপতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অবহিত করার পরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয় নাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলে এবং রাস্তায় ক্রমাগত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়রানি ও নাজেহাল করতে থাকলে নানা ধরনের মানসিক চাপে বিপর্যস্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মীগণ তাদের কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে এবং যার প্রভাব বর্তমান নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পড়তে বাধ্য বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। 

পরে, গতকালের ঘটনায় দ্রুত তদন্ত করে দোষি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত