চলমান অর্থনৈতিক সংকট এবং বাংলাদেশ

  সাজ্জাদুর সিরাজ নিবিড়

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ১৫:৩৯ |  আপডেট  : ২২ মার্চ ২০২৪, ২১:৪৯

বাংলা ভাষার আদি গ্রন্থ চর্যাপদে বলা হয়েছে, “আপণা মাংসে হরিণা বৈরী”। হরিণ যেমন তার সুস্বাদু মাংসের জন্য শিকারীদের প্রথম পছন্দ, ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকেই সূচিত হয় অর্থনৈতিক সংকট। বিশ্বায়নের এই যুগে একটি দেশ যে কোন সময়ের চাইতে অন্য দেশের উপর অধিক নির্ভরশীল। প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে সহজ করে বৈশ্বিক বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি সরবরাহ ব্যবস্থা একবার সংকটে পরলে তা বিশ্বের সমগ্র দেশের অর্থনীতিকে কম্পিত করবে। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের শুরুটা হয় কোভিড-১৯ মহামারির মাধ্যমে। মহামারি থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যকটি দেশ যখন চলাচল সীমিত করছিল, তখনি বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থবির হতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশ কতৃক লকডাউন ঘোষণার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরের কথা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমরা দেখেছি শ্রমিকেরা যাতায়াত করতে না পারার ফলে আমাদের ফসল ঘরে তুলতে কৃষকদের বেগ পেতে হয়েছে। কোভিড-১৯ লকডাউন যখন অর্থনৈতিক চাকাকে স্থবির করে দেয়, তখন মানুষের আয় কমতে থাকে। আয় কমলে স্বাভাবিকভাবেই কমে যায় ভোগ। ভোগ কমলে উৎপাদন কমে যায়, শুরু হয় বেকারত্ব। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার আয় দ্বারা প্রথমে খাদ্যের সংস্থান করবে, পরবর্তীতে বস্ত্রের সংস্থান করবে। করোনাকালীন আয় স্থবির হওয়াতে উন্নত দেশের মানুষ ( আমেরিকা/ইউরোপ যেখানে আমাদের তৈরী পোশাক রপ্তানি করা হয়) খাদ্যের সংস্থান ব্যতীত সকল ব্যয় কমিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় বাড়াতে থাকে। ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ কমতে থাকে ( সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়াও অন্যতম কারণ)।

কর্মীছাটাইয়ের ফলে তখন অনেক পরিবারকেই গ্রামমুখী হতে দেখা যায়। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতে শুরু করে। অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চাষবাস শুরু করে ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়ে যায়। কোভিডজনিত যোগাযোগ হ্রাস পাওয়াতে হুন্ডি ব্যবস্যা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়ে, প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করে, বৃদ্ধি পেতে থাকে আমাদের রেমিট্যান্স। প্রাবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর ভিত্তি করেই শক্ত অবস্থানে চলে যায় আমাদের অর্থনীতি। যখনই করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো, আমাদের সরকার তাদের কূটনীতিক সাফল্যের মাধ্যমে দ্রুত ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করে এবং অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করে। অর্থনীতিকে উৎপাদনশীল করতে সরকার কর্তৃক বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, যা ব্যবসায়ীদের নতুনভাবে উদ্যোমী করে তোলে। বাংলাদের করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। সামাজিক পিরামিডের নিচের তলার মানুষের জন্য সরকারের সুচিন্তা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের শুরুটা হয় মূলত কোভিড পরবর্তী অর্থেনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময়। হুন্ডির ব্যবসা শুরু হওয়ার সাথে সাথে বৈধ পথে প্রবাসী আয় কমতে থাকে। প্রণোদনা থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে ব্যবসা শুরু করতে নতুন মেশিনারিজের ক্রয়াদেশ বাড়তে থাকে। অপরদিকে, আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাকের বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করে আনতে হয়। ফলে আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইউরোপের দেশগুলিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যতটা চিন্তার বিষয় ছিল, এশিয়াতে চীন এবং ভারত ব্যতীত অন্য দেশগুলোতে তেমন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকাতে ভোগ কিছুটা শ্লথ হয়, যা আমাদের রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। হুন্ডির বিবৃদ্ধি, আমদানীতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে দ্রুতই রিজার্ভ কমতে থাকে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে জাতীর নির্বাচন। আমাদের দেশে কালোটাকা বিদ্যমান একথা অস্বীকার কোন উপায় নেই। নির্বাচনের আগের বছরগুলোতে সেই কালো টাকা বিদেশে পাচার হয় ফলে রিজার্ভের উপর তা অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে।

সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোভিডকে পরাজিত করতে ব্যস্ত তখনি ইউরোপে শুরু হয় যুদ্ধ। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছাকে পুঁজি করে ক্রেমলিন বিশেষ সামরিক অভিযান চালায় কিয়েভে। শুরুতে মনে হয়েছিল রাশিয়ার জয় নিশ্চিত, কিন্তু ইউক্রেন পশ্চিমা সহায়তা পাওয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধ জয় রাশিয়ার জন্য কঠিন হয়ে পরে। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া শুরু করলে, রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ কমাতে থাকে যা ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ব্যহত করে। রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধ জ্বালানিকে অপ্রতুল করে তোলে। ফলে বিশ্ব বাজারে বাড়তে থাকে জ্বালানি মূল্য। জ্বালানির জ্বালা উন্নত দেশগুলো সহ্য করতে পারলেও, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর জন্য তা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নেয়ার মত অবস্থা। দক্ষিন চীন সাগরে উত্তেজনা, হরমুজ প্রণালীতে উত্তেজনা, চীনের উপর চিপ অবরোধ, রাশিয়ার উপর বাণিজ্যিক অবরোধ, শ্রীলংকার দেউলিয়াত্ব, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক চাপ দক্ষিন এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্যকে একটি গোলক ধাঁধায় ফেলে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত আমদানি নির্ভর। আমাদের দেশে ভারী শিল্প গড়ে ওঠে নি। রপ্তানি পণ্য বলতে কেবল পোশাককেই বোঝানো হয়। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি বড় হয়েছে, মানুষের ভোগ বেড়েছে। মানুষ লাক্সারিয়াস গুডস ক্রয় করতে চাইছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় ইলেকট্রনিক গুডস আমাদের নিত্য দিনের পণ্য তালিকাতে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ভারী শিল্পের বিকাশ হয়নি। গাড়ি, ল্যাপটপ, প্রযুক্তি, কাঁচামাল এমনকি খাদ্য সামগ্রী আমাদের প্রতিনিয়ত আমদানি করতে হচ্ছে। রপ্তানি বৈচিত্র্য না থাকায় আমাদের রপ্তানি একক পণ্যে স্থিতি হয়েছে যা অর্থনীতির জন্য ভয়ংকর। যদি কোন রাজনৈতিক স্বার্থে ইউরোপিয় ইউনিয়ন কিংবা আমেরিকা আমাদের পোশাক রপ্তানির উপর অবরোধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক সেকেন্ডে স্থবির হয়ে যাবে। বাংলাদেশ যদি একটি উন্নত বোয়িং বিমান ক্রয় করতে চায় তবে ৫০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। অপরদিকে আমাদের সমগ্র রপ্তানি গত বছর ছিল ৫২ বিলিয়ন ডলার। আমদানি-রপ্তানির এই ভারসাম্যে আমরা পিছিয়ে পড়ছি প্রতিনিয়ত।

আমদানি-রপ্তানির যে ব্যবধান ( বাণিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রার ধনাত্নক বা ঋণাত্নক ব্যবধান) তা সাধারণ পূরণ হয় রেমিট্যান্স এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে। আমরা দেখেছি স্বাভাবিক অর্থনীতিতে হুন্ডি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হ্রাস করে কেননা হুন্ডি টাকা পাচারের অন্যতম মাধ্যম। অপরদিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে বাংলাদেশে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকারি সকল সুবিধা ভোগ করলেও বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা দক্ষ নয়। ভারত তুলনামূলক অধিক দক্ষ শ্রমিক পাঠিয় বাংলাদেশি শ্রমিকদের চেয়ে দ্বিগুন বেতনে কাজ করাচ্ছে। এক্ষেত্রে সেই দেশের সরকারেরও সদিচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের এ ক্ষেত্রে আরো সচেতন হওয়া উচিৎ। এবং সেই সাথে বাজারে ডলারের একটিমাত্র বিনিময় মূল্য নির্ধারন করতে হবে। যা বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনতে সহায়তা করবে। কার্ব মার্কেট যদি ব্যাংকের চেয়ে বেশি বিনিময় মূল্য প্রদান করে তবে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা ক্ষীয়মান হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মেকিভাবে টাকার মুল্য ধরে রেখেছিল বহু বছর যা বর্তমান ডলার সংকটের অন্যতম কারণ। প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির সাথে যদি টাকা অবমূল্যায়িত হতো তবে বাংলাদেশকে ডলার সংকটে পরতে হতো না। আকস্মিকভাবে, এক বছরে টাকা অবমূল্যায়িত হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ যা আমাদের উন্নয়ন ব্যয়কে বৃদ্ধি করেছে। সেই যাথে আমরা আমদানি নির্ভর দেশ হওয়াতে পণ্য মুল্য বেড়েছে। জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি আগুনে ঘি ঢালার মত পণ্যমূল্যকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার বাইরে নিয়ে গিয়েছে। এরসাথে যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা রোগ। উপরের কারণগুলো একইসময়ে সংগঠিত হওয়ার ফলে বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। সংকটে গুজব ছড়ায় দ্রুত। গত বছর সেপ্টেম্বরের দিকে ব্যাংকে টাকা নেই এই গুজবে ব্যাংকগুলোতে টাকা উত্তোলনের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েছে যা ব্যাংকের আমানত উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। পরবর্তীতে, টাকা জমা হলেও বিশাল একটি অংশ ব্যাংকের বাইরে রয়ে গিয়েছে। অর্থনীতিতে ব্যাংকের বাইরে যতটাকা গ্রাহকের/ ভোক্তার হাতে থাকবে মূল্যস্ফীতি ততই বাড়বে। সেই সাথে কালো টাকা পণ্যমূল্য বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে নীতিসুদহার বাড়াচ্ছে যা বৈদেশিক মুদ্রাকে আরো দামি করে তুলছে, একই সাথে অবমূল্যায়িত হচ্ছে টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতি আকারে বড় হচ্ছে ঠিক কিন্তু বৈষম্য বাড়ছে আরো দ্রুত। আয় কিছু মানুষের কাছে কুক্ষিগত হয়েছে। নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের মানুষ
সঞ্চয় ভাঙ্গছে এবং ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চাইতে কম, তাই মানুষ সঞ্চয়ে উৎসাহ হারাচ্ছে। আমরা দেখিছি কালো টাকার মালিকেরা টাকা দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে এবং মধ্যবিত্তরা সুদহার কমার কারণে ব্যাংকে আমানত রাখছে না। ফলে ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মত মূলধন হ্রাস পাচ্ছে। সেই সাথে ঋণখেলাপি ব্যাংকিং খাতকে একেবারেই নাজুক করে তুলেছে। ব্যাংক বিনিয়োগের অর্থের যোগান দিতে না পারলে ক্ষুদ্র ও মধ্যম ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে না। যা কর্মসংস্থান হ্রাস করবে। ভোগ কমলে এলডিসি থেকে উত্তরণ অধিক চ্যালেঞ্জের হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার এখনি সময়। আমাদের কর হার বাড়াতে হবে, এনবিআরকে তাদের জনশক্তিকে পরিপূর্ণ দক্ষ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। কুঋণ হ্রাস এবং অর্থপাচারকারিদের আইনের মাধ্যমে শাস্তির বিধান করতে হবে। বিডা, বেজা, বেপজাকে শক্তিশালী করে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে সেই সাথে পরিধি বাড়াতে হবে রপ্তানির। দেশের চাহিদাকে মাথায় রেখে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানির লাগাম টানতে হবে। অর্থনৈতিক খাত শক্তিশালী না হলে জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই সোনার বাংলা বিনির্মানে সরকারের সকল সংস্থাকে একত্রে কাজ করতে হবে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত