ইমারানের রাজনীতি কি তবে শেষ?  রাজনৈতিক ভবিষ্যত অন্ধকার

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৩, ১৩:২৪ |  আপডেট  : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:১৭

সর্বশেষ পাকিস্তানের সংবাদ হলো, ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে আট দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়, তোষাখানা মামলায় সাজা প্রদান ও ইমরান তার আইজীবিকে জানায়, তার বুকে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে, হয়তো বা তাকে ঔষধের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ইমরানের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে, পুলিশ স্টেশন, আর্মির বিভিন্ন স্থাপনা, রেডিও স্টেশন ভাঙ্চুর ‍এবং আগুন লাগানো হয়েছে। রাস্তায় আর্মি মোতায়ন করা হয়েছে। আর্মি ও জনগণ এখন মুখোমুখি। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরোকে (এনএবি) ইমরানকে এক ঘণ্টার মধ্যে হাজির করার নির্দেশ দেয়। কারণ এনএবি আদালতের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে আদালতের রেজিস্ট্রারের অনুমতি ছাড়ায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করে "আদালত অবমাননা" করেছে। প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়ালের নেতৃত্বে বিচারপতি মোহাম্মদ আলী মাজহার ও বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ সহ তিন বিচারপতির বেঞ্চ এই নির্দেশনা জারি করে। পরে ইমরানকে জামিন দেয়া হয়। কোর্ট থেকে জামিন পাওয়া সত্ত্বেও, ইমরান খানের ভবিষ্যত অন্ধকার থেকে গেছে। ইমরান খানের রাজনীতি এবং তার দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বের অবসান ঘটাতে সরকার ও আর্মির পরিকল্পনা চলছে।

সুপ্রিম কোর্ট দুর্নীতির অভিযোগে ইমরানের গ্রেপ্তারকে বেআইনি বলে রায় দেওয়ার একদিন পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিচারকরা খানকে সুরক্ষিত জামিন দিয়েছেন, যার অর্থ এই অভিযোগে তাকে দুই সপ্তাহের জন্য পুনরায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাছাড়াও গত মঙ্গলবারের পর ১৭ মে পর্যন্ত, দায়ের করা কোনো প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য বা গোপন অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও আদেশ দেন আদালত। তার জামিনের শুনানির আগে বিবিসির সাথে কথা বলার সময়, খান বলেছিলেন, তিনি মুক্তি পাওয়ার পরে অবিলম্বে পুনরায় গ্রেপ্তারের আশঙ্কা করছেন। “আমি ১০০% নিশ্চিত যে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করা হবে। এনএবি আমাকে আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলার অনুমতি দিয়েছে, তার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে,” খান তার শুনানির আগে আদালতের বাইরে সিএনএনকে বলেছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ অসীম মুনিরকে উল্লেখ করে খান শুক্রবার আদালতে সাংবাদিকদের বলেন, "আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজনই ব্যক্তি এবং তিনি হলেন সেনাপ্রধান।"

জামিন পাওয়ার পরেও কয়েক ডজন মামলা তার বিরুদ্ধে আছে। এসকল মামলায় তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করার ঘোষনা দিয়েছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকার। খানের গ্রেপ্তারের বৈধতার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বৃহস্পতিবার পিছু হটতে অস্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের টিভি চ্যানেলে বলেছেন: "যদি (খান) জামিন পান... আমরা জামিন বাতিলের জন্য অপেক্ষা করব এবং তাকে আবার গ্রেপ্তার করব। " তার মধ্যে খান তার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি করেছিলেন, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের একটি মামলায় তার সাজা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়াও অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে আছে সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ব্লাসফেমি । এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে আজীবনের জন্য রাজনীতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য করা হবে।

খানের ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয় সামরিক সহায়তায় হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি সেনাবাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তার মেয়াদের চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে, তিনি সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে সোচ্চার সমালোচক। ফলে জনগণের সামনে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা কমে গেছে। খান গ্রেপ্তার হওয়ার পরে দেশটিতে অস্থিরতার কারণে কমপক্ষে ১০ জন নিহত, ২৯০ জনের মতো আহত এবং প্রায় ২০০০ এর অধিক গ্রেপ্তার হয়েছে। পাঞ্জাব পুলিশ জানিয়েছে যে প্রদেশ জুড়ে সরকারী এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হামলার জন্য দায়ী ১৬৫০ জন "দুর্বৃত্ত"কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাঞ্জাব প্রদেশের মহাপরিদর্শক এক বিবৃতিতে বলেছেন, সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। "এই ধরনের দুর্বৃত্তরা কোন করুণার যোগ্য নয়," তিনি যোগ করেন।  এই বিক্ষোভের মধ্যে সামরিক কমান্ডারের বাসভবনে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়। বর্তমানে ইসলামাবাদ, পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখওয়ার সেনাবাহিনী মোতায়েন করা রয়েছে। ইমরান গ্রেপ্তারের পর দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের ক্ষমতার শীর্ষে দীর্ঘকাল ধরে বসে থাকা সেনাবাহিনীকে জনগণ সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে, সামরিক সম্পত্তিতে ভাঙচুর এবং সেনাকর্মীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং, ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর) বুধবার সামরিক সম্পত্তি ধ্বংসের বিষয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে বিক্ষোভে জড়িত "সুযোগদাতা, পরিকল্পনাকারী এবং রাজনৈতিক কর্মী" চিহ্নিত করা হয়েছে এবং "আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে"। বুধবার উর্দুতে জারি করা এক বিবৃতিতে আইএসপিআর ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর যে বিক্ষোভ হয়েছিল তার উল্লেখ করেছে। আইএসপিআর বলেছে, বিক্ষোভে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সম্পত্তি ও স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু ছিল। সেনাবাহিনী চরম সহনশীলতা, ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছে এবং দেশের সর্বোত্তম স্বার্থে অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে কাজ করেছে। বিবৃতিতে আইএসপিআর বলেছে, "কৌশল অনুসারে, সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়াকে ঘৃণ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যা সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রতিক্রিয়া দ্বারা ব্যর্থ হয়েছিল।" "আমরা ভালো করেই অবগত যে এর পেছনে দলের কতিপয় অসাধু নেতার কিছু নির্দেশ এবং পরিকল্পনা ছিল।" আইএসপিআর সতর্ক করেছে যে সামরিক ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় আর কোনো হামলার ঘটনা ঘটলে "শক্তিশালী এবং নিষ্পত্তিমূলক ব্যবস্থা" নেওয়া হবে।

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত মন্ত্রিসভার বক্তৃতায় খানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে বিচারকরা ইমরানের পক্ষে ছিলেন এবং তাদের রায় "পাকিস্তানে ন্যায়বিচারের মৃত্যু" ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, ইমরান দেশকে বিভক্ত করেছেন। পুলিশ খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে "অগ্নিসংযোগ ও সহিংস বিক্ষোভে উসকানি দেওয়ার জন্য" গ্রেপ্তার করেছে। পাকিস্তানি সংবাদপত্র এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের মতে, গ্রেপ্তার হওয়া অন্যান্য পিটিআই নেতারা হলেন আসাদ উমর, ফাওয়াদ চৌধুরী, জামশেদ ইকবাল চিমা, ফালকনাজ চিত্রালি, মুসরাত জামশিদ চিমা এবং মালেকা বুখারি। পুলিশ বলেছে যে "আরও গ্রেপ্তার প্রত্যাশিত"। সরকার ইমরানের দলের নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং শুক্রবার দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ড. শিরীন মাজারী ও ড. ইয়াসমিন রশিদকেও গ্রেফতার করে। এর আগে, কর্তৃপক্ষ প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খানের পিটিআই দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মাহমুদ কুরেশিকে গ্রেপ্তার করেছিল। গিলগিট-বালতিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খালিদ খুরশিদকে ইসলামাবাদে "গৃহবন্দী" করা হয়েছে। পিটিআইয়ের সিনিয়র নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগে অডিও টেপগুলি বুধবার ফাঁস হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে তারা লাহোরের কর্পস কমান্ডার হাউসে হামলার জন্য কর্মীদের প্ররোচিত করছে। পিটিআই কেন্দ্রীয় পাঞ্জাবের সভাপতি ইয়াসমিন রশিদ কর্মীদের বাড়িতে আগুন লাগানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

গত এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে পদ ও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে, খান দ্রুত নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে প্রায় নজিরবিহীন সমালোচনা ও তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। খান ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নভেম্বরে একটি হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সরকার "মাইনাস-১" ফর্মুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে, তারা খানকে রাজনৈতিক থেকে সরিয়ে পিটিআইকে একটি ছোট রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। তবে এখন পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়েছে। ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বর্তমানে কারাগারে। ইমরান সরকার ও সামরিক বাহিনীর নজরে আছেন এবং তার বিরুদ্ধে ১৫০ টিরও বেশি মামলা করা হয়েছে। ইমরানকে দলীয় প্রধান হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করতে আইনি পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। এটি ইমরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত শেষ করবে এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অন্যান্য মামলায় তাকে বিচারের আওতায় আনবে। "তোশাখানা মামলা এবং আল-কাদির ট্রাস্ট মামলা দুটি বড় মামলায় ইমরানকে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। অন্যান্য মামলাগুলির মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসবাদের মামলা, সহিংসতার উসকানি এবং এখন কোর কমান্ডারের বাসভবনে হামলা ও লুটপাটের মামলা।

ইমরানের দেশের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে তাকে অনেক বিপদে ফেলবে। ইমরান এক ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করার কয়েকদিন পরেই তাকে গ্রেফ্তার করা হয়। এখন প্রশ্ন হলোঃ ইমরান বনাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী: এরপর কী? গত নভেম্বরে একটি হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর, ইমরান একজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা এবং পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে এই প্রচেষ্টার পিছনে দায়ী করেছেন। একজন সেনা মুখপাত্র এই সপ্তাহে ইমরানকে "কোন প্রমাণ ছাড়াই একজন চাকরিরত সিনিয়র সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং ভিত্তিহীন অভিযোগের জন্য" নিন্দা করেছিলেন, যার জবাবে ইমরান মঙ্গলবার ভিডিও বিবৃতির মাধ্যমে উত্তর দিয়েছেন: "এটি আমার সেনাবাহিনী এবং আমার পাকিস্তান। আমার মিথ্যা বলার দরকার নেই।" সামরিক মুখপাত্র ইমরান তার অভিযোগ অব্যাহত রাখলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

লেখক : অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

কথা সাহিত্যিক , কবিগবেষক  প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত