অজানা পথের যাত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:৩০ | আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৩৬
১৯৭০ সালে অনুস্ঠিত পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা(১৬৭ টি আসন) পেয়ে পাকিস্তানের সরকার গঠনের গৌরব অর্জন করে।বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে বার্তা পাঠিয়ে অভিনন্দিত করে। বঞ্চিত বাঙ্গালীরা আশায় বুক বাধে যে এবার দু' যুগের বঞ্ছনা ও শোষন বৈষম্যের অবসান হবে। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধান মন্ত্রী বলে অবিহিত করেন। ৩ রা মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন প্রেসিডন্ট ইয়াহিয়া খান।
নির্বাচনের ফলাফল জানার পরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো অসাংবিধানিক বোলচাল দিতে থাকেন। ৮৮ আসন পেয়ে তিনি বিরোধী দলের আসনে বসবেন না, তাঁকে বাদ দিয়ে সরকার গঠিত হবে না, 'এধারমে হাম ওধারমে তোম' ধরনের কথাবার্তা বলতে থাকেন। তিনি ভারতের ক্রিকেট টিমকে পাকিস্তানে নামতে দেবেন না বলে হুমকি দেন।
বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের আগে এবং জেতার পর থেকেই বলতে থাকেন ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হবে। নির্বাচনে জনগন ৬ দফার পক্ষে রায় দিয়েছে। ষড়যন্ত্র চলছে,প্রয়োজনে আরো সংগ্রাম করতে হবে, আরো ত্যাগের জন্য শপথ নিতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা সত্য প্রমানিত হলো। হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চ এক ঘোষনায় ৩ মার্চে আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলে বাঙ্গালীরা প্রতিবাদ করে রাজপথে নেমে আসে।পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন জেলায় গুলি বর্ষণ করে বাঙ্গালী হত্যায় মেতে ওঠে।
এদিকে স্বাধীনবাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ ও বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলার সর্বাধিনায়ক ও জাতিরপিতা ঘোষনা করে।
বঙ্গবন্ধু ঐ দিন বলেন ৭ ই মার্চের জনসভায় আমি যা বলার বলবো।
৬ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতি দিয়ে বাংলার বুকে গণহত্যা বন্ধ করার আহবান জানান। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন এবং ঘোষনা করেন 'এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ সংগ্রাম তাজউদ্দীন আহমদ প্রেরিত নির্দেশ মোতাবেক বাংলায় চলতে থাকে।
তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল গভীর।তাঁদের এ সম্পর্ক বাঙ্গালীর স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ গোপনে সাক্ষাত করেন ঢাকাস্থ ডেপুটি হাই কমিশনার কে সি সেন গুপ্তের সঙ্গে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে প্রথমে ইয়াহিয়া খান ও পরে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো ঢাকা আসেন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করতে। আলোচনা চলাকালে ভূট্টো তাঁর সহকর্মীদের বলেন যে,ভবিষ্যতের জন্য এই তাজউদ্দীনই হবেন বড় সমস্যা। আলোচনা বৈঠকে আমি মুজিবকে ভয় পাই না। ইমোশনাল এপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়।কিন্তু তাঁর পেছনে ফাইল বদলে চুপচাপ যে ‘নটরিয়েস’ লোকটি বসে থাকে তাকে কাবু করা শক্ত।”
জুলফিকার আলী ভূট্টো ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদকে।
আলোচনার আড়ালে পাকিস্তান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কয়েক ডিভিশন সৈন্য বাঙ্গালীদের হত্যার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আনে। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশনসার্চ লাইট অনুমোদন দিয়ে ইয়াহিয়া খান চোরের মতো ঢাকা থেকে পালায়। ২৫ মার্চ রাতের প্রথম দিকে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করে যখন নিশ্চিত হলেন যে ,বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাড়ি ত্যাগ করবেন না। তখন তিনি স্থির করেন যে অজানার পথে তাকে যাত্রা করতে হবে দেশ স্বাধীন করার জন্য। ড.কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলামকে নিয়ে তিনি অজানার পথে যাত্রা শুরু করেন ৩২ নং থেকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ড. কামাল হোসেন কেটে পড়েন।ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন বিশ্বস্থ সহকর্মী ও বন্ধু রুপে ছায়ার মতো তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গ দিয়েছেন,সুপরামর্শ দিয়েছেন।
সাত মসজিদ রোড়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে স্ত্রী জোহারা তাজউদ্দীনকে বলে গেলেন,”আমি যাচ্ছি,আর্মি আসছে,তোমরা যেখানে পার চলে যেও।”নিজ বাড়ি ছেড়ে এক অজানা পথে যাত্রা হলো শুরু।তখন চারিদিক থেকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে হলো তাঁকে।আর্মি এগিয়ে আসছে।তাই নিরাপত্তার কথা ভেবে লালমাটিয়ায় ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল গফুরের বাড়িতে আশ্রয় নেন তাঁরা। এ বাড়ির পাশের সংগ্রাম পরিষদের অফিস বন্ধ করে পতাকা নামিয়ে সকলকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বললেন তাজউদ্দীন আহমদ। কর্মীদের তিনি বলেন ,সেনাবাহিনী আসছে, সংগ্রাম পরিষদের অফিস বুঝতে পারলে এখানকার সব শেষ করে দেবে। প্রতিরোধ করার মতো শক্তি এখন আমাদের হাতে নেই। সময়ের প্রয়োজন আছে। তাই সেই সময় পর্যন্ত আমাদের সাবধানে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাঁর নির্দেশ মেনে নিল। তাজউদ্দীন আহমদ তখন ভাবছেন, এ পথ বন্ধুর, এ পথ ভাড়ী কঠিন ।স্বাধীনতার ‘সূর্য’ বহু রক্ত চায়।কারন, তাঁর আবির্ভাবের রংও রক্তিম। নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাম ছব্দ নাম নিলেন যথাক্রমে মোজাফ্ফর হোসেন ও রহমত আলী। আর্মির হাতে ধরা পড়লে কি বলবেন তাও ঠিক করলেন। ২৬ মার্চ তাঁরা ঐ বাড়িতে রাত কাটিয়ে ২৭ মার্চ ভোরে কার্তুজসহ বন্দুক রেখে আবার বেরিয়ে পড়েন। কার্ফুর মধ্যে রওনা হয়ে অবাঙ্গালীদের আনাগোনা টের পেয়ে আতাউল হকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময়ে অবাঙ্গালীদের দ্বারা বস্তিতে আগুন দিতে এবং আর্মি কর্তৃক গুলি করে বস্তির মানুষদের হত্যা তান্ডব দেখে তিনি বলেন ‘এরা হারবে।’
কারফিউ প্রত্যাহারের খবর বেতারে ঘোষনা হলে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাম হেঁটে রায়ের বাজার পৌঁছে দেখেন সেখানে ওপাশের হত্যাযজ্ঞের কোন ছোঁয়াই এখানে লাগেনি। ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে নসুরুল্লা তাঁদের নাস্তা করায়। পাল বাড়ির ছেলেরা হাঁটার সুবিধার জন্য একজোড়া সামশু তাজউদ্দীন আহমদকে কিনে দেয়। রায়ের বাজার থেকে তাঁরা বুড়িগঙ্গা নদী পাড়ে পৌছেন। রায়ের বাজার আওয়ামী লীগের কর্মী রেজার চাচার সহায়তায় নদী পার হয়ে আটি বাজারে পৌঁছেন। চলার পথে বহু পরিচিত মানুষকে তাঁরা দেখতে পান। সকলে বেশ আন্তরিকতার সাথে তাঁদের যত্ন ও সেবা করে। আটি বাজারে সিরাজের সাথে দেখা হয়। সিরাজ তাজউদ্দীন আহমদের হাতে ২৫০ টাকা তুলে দিয়ে বলে ,” নিয়ে যান পথে প্রয়োজন হবে।”সিরাজ একটি মোটর সাইকেল দিয়ে তাঁদের জনৈক মতিউর রমজানের বাসায় পৌঁছে দেয়। এ সময়ে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল রুস্তমের সাথে দেখা হয়। রুস্তম তাঁকে ঢাকায় ঘুমন্ত পুলিশদের হত্যার বিবরন জানায়। ২৭ মার্চ রাতে মতিউর রহমানের বাড়ির পুকুরে গোসল করে রাতে পাটখড়ির ঘরে ঘুমান।
২৮ মার্চ সকালে আব্দুল আজিজ মন্ডলের মোটর সাইকেলযোগে নবাবগঞ্জের এমপিএ সুবিদ আলী টিপুর বাড়ি পৌঁছে কথাবার্তার পর খেয়ে আবার যাত্রা করেন জয়পারার পথে।আওয়ামী লীগের এম এমএ আশরাফ উদ্দীন চৌধুরীর বাড়ি পৌঁছেন।সেখান থেকে যান পদ্মা নন্দী পার হতে। কিন্তু পদ্মা উত্তাল থাকায় পার হতে না পেরে স্থানীয় তাঁতের ব্যবসায়ী শুরুর মিয়ার বাড়িতে রাত কাটান। শুরুর মিয়া তাঁদের আন্তরিক যত্ন করেন।
২৯ মার্চ সকালে তিন ঘন্টায় পদ্মা পার হয়ে নাড়ারটেক পৌঁছেন।সেখান থেকে ঘোড়া ও রিকশায় চড়ে বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ইমামউদ্দীনের বাড়ীতে যান। ইমামউদ্দীন বাড়ি ছিলেন না ।তাঁর স্ত্রী হাসি তাদের খাওয়ায়। সেখানে তাঁরা রেডিওতে জিয়াউর রহমানের ঘোষনা শুনতে পান। এ সময়ে খবর পান কামারখালী দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে। কালবিলম্ব না করে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাাম রিক্সা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পথে দেখা হয় রাজবাড়ির এসডিও শাহ মহম্মদ ফরিদের সঙ্গে। তিনি জানান সীমান্ত ভালো আছে।রিক্সা নিয়ে বেশি দূর যেতে পারলেন না। মুক্তিকামী বাঙ্গালী ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেট দিয়েছে। তাই পায়ে হেঁটে কামারখালী পৌঁছেন। মধুমতি নদী পার হলেন এক বৃদ্ধ মাঝির নৌকায়। হেঁটে আবার রওনা হয়ে রাত আড়াইটায় পৌঁছেন মাগুড়ায় । সোহরাব হোসেনের বাড়ি যাবার পথে একটি খাল পাহাড়ায় আছে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী। প্রত্যেকের শরীর তল্লাশি করছে তারা। আওয়ামী লীগের কর্মী ওয়াহেদ তাজউদ্দীন আহমদকে চিনতে পেরে সোহরাব হোসেনের বাড়ি পৌঁছে দেয়, তখন রাত তিনটা।সোহরাব হোসেন বাড়িতে নাথাকায় তাঁর ভাগিনা তাঁদের আবার নদী পার করে সোহরাব হোসেনের কাছে নিয়ে যায়। তাঁদের দেখে সোহরাব হোসেন অবাক হন এবং উৎসাহিত হন।
৩০ মার্চ সকালে সোহরাব হোসেনের সহযোগিতায় পাওয়া জিপে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে তাজউদ্দীন চলছেন সীমান্তের দিকে। এ সময়ের অনুভূতি সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন,”পথের দুই ধারে বাংলার নববসন্তের অপূর্ব শোভা,মায়াভরা বাংলারই প্রতিচ্ছবি বিরাজমান। অনুভূতির স্তরে স্তরে বার বার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন সৃষ্টি ‘পায়ে চলার পথ’-এর কথা,”এ পথ যে চলার পথ ,ফেরার পথ নয়।’কিন্তু আমি যেন মনে মনে বলেছি,কবিগুরু,এ পথেই যে আমাদের ফিরে আসতে হবে। না হলে তুমি,এই শাশ্বত বাংলা ধরণীর ধুলায়বিলীন হয়ে যাবে।’১
১০ টা ৩০ মিনিটে তাঁরা ঝিনাইদহ পৌঁছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও সংসদ সদস্য এম এ আজিজ ও এসডিপিও মাহবুব উদ্দীনের দেখা পান। এ দুজনের থেকে এলাকার খবর জেনে নিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এমএ আজিজের দেওয়া লুঙ্গি পরে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে মেজর ওসমানকে খবর দেন। সংসদ সদস্য ডা.আসহাব-উল-হক জোয়ার্দার,আফজালুর রশিদ বাদলসহ আরও কয়েক জনের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের দেখা হয়। সীমান্তের আরও নিকটবর্তী হওয়ার জন্য তাঁরা দুজন জীবননগর পৌঁছেন।এ সময়ে তাঁদের সাথে ছিলেন এসডিও তৌফিক -ই- এলাহী চৌধুরী এবং এসডিপিও মাহবুব উদ্দীন আহমদ।তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলামের খবর দিতে সীমান্তের ওপারে যান। সীমান্ত সংলগ্ন একটি কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে তখন তাজউদ্দীন আহমদ কি খবর আসে সে অপেক্ষায় থেকে ভাবতে থাকেন ,সিগন্যাল যদি স্বাধীনতার পরিপন্থী আসে ,তাহলে ওপারে না গিয়ে দেশের ভেতরে থেকেই যা কিছু আছে ,তা-ই নিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন। তবে তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল যে,ন্যায়ের সংগ্রামে,বাঙ্গালির অস্তিত্বের সংগ্রামে বিশ্ববাসীর নৈতিক সমর্থন পাওয়া যাবেই।
এ সব ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে তাজউদ্দীন আহমদ কালভার্টের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। ড্রাইভার এসে সংবাদ দেয় যে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন অফিসার এসেছেন। সেই অফিসার তাজউদ্দীন আহমদকে সেলুট করে জানায় ডিআইজি গোলক মজুমদার সীমান্তের ওপারে অপেক্ষায় আছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাম হেঁটেছেন সীমান্ত অতিক্রম করেন। গোলক মজুমদার জানান,তিনি দিল্লির সাথে যোগাযোগ করে এসেছেন। আলোচনার সংকেত দিলেন।
মি: মজুমদার তাঁদের সরাসরি দমদম বিমান বন্দরে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে একটি চশমা এনে দিলেন যার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের একটি বিশেষ বিমান দিল্লি থেকে আসে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক রুস্তমজি রাজা গোপাল এসে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলামকে স্বাগত জানান। একসঙ্গে গাড়িতে করে তাঁরা অসম ভবনে পৌঁছেন। এতদিন তাজউদ্দীন আহমদ ও আমির-উল-ইসলাম সেভ করতে পারেননি এবং তাঁদের কাপড় ছিল ময়লা । রুস্তমজি তাঁদের পায়জামা পান্জাবি পরতে দেন।
৩১ মার্চ সকালে শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় ,নিরাপত্তা অফিসার সৌমেন চট্টোপাধ্যায় ও গোলক মজুমদার সহ তাজউদ্দীন ও আমির-উল-ইসলাম টাকীর সীমান্ত এলাকায় যান। এসময় গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদকে একটি এলএমজি উপহার দেন। যা তিনি মেজর আবু ওসমানের হাতে তুলে দিয়ে বলেন’আপনি সামলাবেন এটা’। তখনই সুবেদার মুজিবুর রহমানকে এলএমজির ট্রনিং দেওয়া হলো। যা দেখে গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন,’ইউ উইল উইন।’ সাতক্ষীরা থেকে আগরতলা পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রহন করার জন্য খবর পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করে তাজউদ্দীন আহমদ হিঙ্গলগন্জ,টাকী,হাসনাবাদ প্রভৃতি সীমান্ত এলাকায় যান আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ করতে।
১ এপ্রিল রাত দুইটায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলামকে নিয়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন। দিল্লি পৌঁছিলে বিমান বন্দরে প্রটোকল অফিসার তাঁদের স্বাগত জানান।৮৭/বিডিসি নম্বর বাড়িতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়।
৩ এপ্রিল রাত ১০ টায় সবদার জং রোড়ের বাড়িতে ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই স্বাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন রুস্তমজি,সিএন হাকসার,মি:রাম এবং কর্নেল মেনন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করার আগে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ক্ষুরধার যুক্তি ও তথ্য দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি,আওয়ামী লীগের সহসভাপতিদের মধ্যে সিনিয়র সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অন্যদের মন্ত্রী করে সরকার গঠনে সম্মত করান। সাক্ষাতকালে তাজউদ্দীন আহমদ শ্রীমতী গান্ধীকে জানান যে,বাঙ্গালীরা ১ লক্ষ ৫৪ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত,বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন । এজন্য ভারতসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সহায়তা দরকার।
৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় বার পি এন হাকসার ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আরও কয়েকজন নীতি নির্ধারকের সাথে বৈঠকে মিলিত হন।
৫এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠন করার ঐতিহাসিক বিবৃতি ও দলিল লেখার কাজ শেষ করেন এ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গ ছিলেন ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাম ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
৬ ও ৭ এপ্রিল বিবৃতি ও দলিলের বাংলা অনুবাদের কাজ শেষ করা হয়। ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনসম্পর্কিত বিবৃতি তাজউদ্দীন আহমদের কন্ঠে রেকর্ড করা হয়।
৯ এপ্রিল ব্যারিস্টার আমির-উল- ইসলাম ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার নগেন্দ্র সিংহকে সাথে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ একটি বিশেষ বিমানে সীমান্তবর্তী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজে বের হন।ঐ দিন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান কলকাতা এসে পৌঁছেন।
১০ এপ্রিল রাতে তাজউদ্দীন আহমদের কন্ঠে ধারনকৃত বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত সম্বলিত বিবৃতি বেতারযোগে প্রচার করা হয়।যা পরের দিন আকাশবাণী থেকে পুন: প্রচারিত হয়।
১১ এপ্রিল ময়মনসিংহের তুরা এলাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে খোঁজে বাহির করেন তাজ উদ্দীন আহমদ।তাঁকে নিয়ে রাত ৮ টায় আগরতলা পৌঁছন ।আগরতলায় খন্দকার মোশতাক আহমদ,কর্নেল এমএজি ওসমানীসহ কয়েকজন নেতার দেখা পান।আগরতলায় অনুস্ঠিত এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় যে,চুয়াডাঙ্গায় ১৪ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ,প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহন করবেন।সেখানে রাজধানী স্থাপন করে সরকার পরিচালনা করা হবে।তাজউদ্দীন আহমদ ঠিক করলেন এ রাজধানীর নাম হবে’মুজিব নগর’।
কিন্তু একজনের অসাবধানতায় এ সিদ্ধান্ত সংবাদপত্রে প্রচার হওয়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গার নিদিস্টস্থানে প্রবল বোমা বর্ষণ করে।পরে নেতৃবৃন্দ ঠিক করেন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহন করবে।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বৈদ্যনাথ তলার আম বাগানে শত শত দেশি বিদেশি সোংবাদিকদের এবং কয়েক হাজার মানুষের সামনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীবৃন্দ শপথ গ্রহন করেন।ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বক্তৃতা করেন।প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদও বক্তৃতা করেন এবং দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
তারপর থেকে বিরামহীনভাবে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এক দিনের জন্যও বিশ্রাম না নিয়ে ,পরিবারের সদস্যদের সাথে না থেকে বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব প্রদান করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় অর্জন করেন।বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পরেই তাজউদ্দীন আহমদের অবদান।জন্ম দিনে এ মহান নেতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
*তথ্য সূত্র:-তাজউদ্দীন আহমদের একাত্তরের যাত্রা,দৈনিক প্রথম আলো ,তাং১৭ ও ১৮ এপ্রিল,২০২১
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি,ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম,কাগজ প্রকাশন,দ্বিতীয় মুদ্রণ
লেখক:- ‘৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা,ব্যাংক নির্বাহী(অবঃ), জয়নাল আবেদীন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত