রাঙামাটিতে বেড়েছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, আক্রান্ত ৬৬১

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৫, ১১:২২ | আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ১৫:৩০

সারা দেশে করোনা ও ডেঙ্গু প্রকোপের মধ্যেই পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে ম্যালেরিয়া। এখানে করোনো ও ডেঙ্গু রোগী অন্যান্য জেলার চেয়ে কম থাকলেও চোখ রাঙাচ্ছে ম্যালেরিয়া। তবে গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় চলতি বছরের মে পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) ৬৬১ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর গত কয়েক বছর কেউ মারা যাননি। ২০২৬ সালের পর থেকে মৃত্যুও কমে এসেছে এই রোগে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর একই সময়ে (পাঁচ মাস) জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৯৪৫ জন। হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমেছে। তবে পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে রোগটি। বিশেষ করে দুর্গম সীমান্ত অঞ্চলের চার উপজেলা বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকলের বাসিন্দাদের জন্য এটিকে মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এ বছর জেলায় আক্রান্ত রোগীর ৮৩ শতাংশের বসবাস এই চার উপজেলায়।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত দুই মাস ধরে দ্রুত বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জেলা সদরের চেয়ে এই রোগের প্রকোপ উপজেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি। যা গত দুই মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ রোগী গত দুই মাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় এই জেলা থেকে ম্যালেরিয়া পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের সরকারের যে লক্ষ্য অর্জন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ থাকে জেলাজুড়ে। প্রতি বছর রোগী শনাক্ত হলেও ২০১৬ সাল থেকে মৃত্যু কমে এসেছে। চলতি বছরের একমাত্র মৃত্যুটিও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হয়েছে। যার কারণে জেলার তালিকায় নাম আসেনি তার।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩০৮ জন। মে মাসে এসে সেটি দাঁড়িয়েছে ৬৬১ জনে। এর মধ্যে জুরাছড়িতে সবচেয়ে বেশি রোগী। জুরাছড়িতে ২০৮, বরকলে ৮৪, বাঘাইছড়িতে ৯৯, বিলাইছড়িতে ১৫৬, নানিয়াচরে তিন, লংগদুতে সাত, কাউখালীতে এক, কাপ্তাইয়ে ২৯, রাজস্থলীতে ৬৩ ও সদরে ১১ জন।
২০২৩ সালে জেলায় আক্রান্ত রোগী ছিল চার হাজার ৭১৪ জন। এর মধ্যে জুরাছড়িতে আক্রান্ত হন এক হাজার ৭৭৮ জন। ২০২৪ সালে রোগী ছিল তিন হাজার ৭৫৩ জন। তার মধ্যে জুরাছড়িতে রোগী পাওয়া যায় এক হাজার ২৩৩ জন। ২০২৫ সালে জেলায় রোগী ৬৬১ জন। এর মধ্যে জুরাছড়িতে ২০৮ জন।
এবার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক, জুরাছড়ির দুমদুম্যা, মৈদং, বিলাইছড়ি ও বরকলে আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। দুর্গম ও সীমান্তবর্তী হওয়ায় সরকারি চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা ও সচেতনতার অভাবে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, জুরাইছড়ির বিশেষ করে দুর্গম মৈদং ও দুমদুম্যা ইউনিয়নের কয়েক গ্রামে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে। মৈদং ইউনিয়নের আমতলা, ভুয়াতলিছড়া, বাদলহাটছড়া, কাটালতলি ও জামেরছড়িতেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া দুমদুম্যা ইউনিয়নের গবাখালি, লাম্বাবাগছড়া, হরিণহাটছড়া, বড় ও ছোট করইদিয়া, ঘন্ডাছড়া, দুলুছড়ি, আদিয়াবছড়া, কান্দারাছড়া, এটছড়ি, কলাবনছড়া গ্রামের মানুষজন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় নাজুক যোগাযোগব্যবস্থা, হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকা এবং প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষ করে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতিকে ম্যালেরিয়া বেড়ে যাওয়ার কারণ, বলছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া রোগটি নিয়ে দুর্গম পাহাড়ে সচেতনতার অভাবও রয়েছে। যদিও সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা। কিন্তু সেটি সম্ভব হবে না বলছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
রাঙামাটিতে ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির দেওয়া তথ্যমতে, ব্র্যাক বিনামূল্যে মশারি বিতরণ করে থাকে তিন বছর পর পর। জেলায় ২০২৩ সালে পাঁচ লাখ ৭৪ হাজারের কিছু বেশি মশারি বিতরণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে আর বিতরণ হয়নি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতে ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে রাখলেও দিনে জুমের মাঠে কাজ করার সময় মশা কামড়ায়। তখনই মূলত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অনন্যা চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যেতো। এখন সারা বছর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আমরা সীমন্তবর্তী এলাকাগুলোতে এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করলেও ভারতের ওই অংশে সেভাবে কাজ হয় না। ফলে ওই এলাকার মানুষ ও মশার কারণে রোগ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডা. নূয়েন খীসা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম শুর হলেই ম্যালেরিয়া রোগী বেড়ে যায়। তবে এই রোগে মৃত্যু ঠেকাতে জেলার প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের এ বিষয়ে নিবিড় দৃষ্টি ও সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। জুন ও জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত আরও বাড়বে। তখন রোগী আরও বাড়তে পারে। এজন্য সতর্ক থাকতে হবে।’
কা/আ
সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত