ধারাবাহিক গল্পঃ ত্ল্যাংময়

স্বপ্ন পাহাড়ের খোঁজে

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ মে ২০২২, ১০:১৫ |  আপডেট  : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪১

শাশ্বত স্বপন
--------------


...বান্দরবানের গহীনে পাহাড় পাড়ার একটা সাধারণ বেশিষ্ট্য হল, পাড়াতে কোন টয়লেট থাকে না। বড়রা ঝোপে বা ঝিরিপথে আর বাচ্চারা যেখানে সেখানে প্রাকৃতিক কাজটি করে থাকে । তারপরও গন্ধ হবার মত কোন ময়লা থাকে না । গৃহপালিত শুকররা সব পরিষ্কার করে দেয়। পাহাড়ে এমন কোন পাড়া দেখা যাবে না, যেখানে গৃহপালিত শূকর নেই। বাকত্লাই পাড়ায় আমরা কয়েকজন মিলে একটা বাঁশের পায়খানা বানিয়ে দিয়েছিলাম, যখন তাদের দুইজন  কিশোরদের সহযোগিতা নিয়ে তৈরি করা শুরু করি, তারা সবাই আমাদের পাগলামি দেখে হাসতে ছিল। তৈরি করার পরে তারা কিছু মানুষ ব্যবহার করেছিল, অধিকাংশই করেনি, কাছে গিয়ে কি যেন মনে করে, তারপর কাছের জঙ্গলেই নাকি চলে যায়, কেউ প্রায় একশত ফুটের নিচে ঝিরিপথের কোথাও যায়। একদিন এক পর্যটকের কাছে শুনি, আমাদের বানানো টয়লেটের সামনে দরজা নাই, তারা  নাকি ফেলে দিয়েছে। আরো পরে শুনি, টয়লেট নাই, তারা ভেঙ্গে ফেলেছে। শুনেছি, বর্তমানে তারা টয়লেটের ব্যবহার শিখেছে। পর্যটকদের অতিরিক্ত যাতায়াতের কারণে, অনুরোধের কারণে হয়তো তারা টয়লেট বানাতে বাধ্য হয়েছে। এমনও হতে পারে, আমাদের মত কোন গ্রুপ হয়তো আবার টয়লেট বানিয়েছে, এরপর আর হয়তো ভাঙ্গেনি।

হান্জুরাই, এক গহীন পাহাড়ী ত্রিপুরা পাড়া, এখানে কোন টয়লেট নেই। তাই প্রকৃতির কোন ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিক কর্মটা সম্পাদক করতে হয়। রাজু সকালে ঘুম থেকে উঠেই পেট খালি করার চাপ অনুভব করতে লাগলো কিন্তু একা একা কোন ঝোপে যাবার সাহস করতে পারলো না। স্বপন ঘুম থেকে উঠার পর গ্রীপের সেন্ডেলে পড়ে মাচাং থেকে নিচে নামতেই রাজু বললো, 
দাদা, কোথায় যান?
কোথায় আবার, জঙ্গলে
আমি তো ঘুম থেকে উঠেই সঙ্গী খুঁজছি।
চল তাহলে-
স্বপন আর রাজু কোন ঝোপের আড়ালে প্রাকৃতির কর্ম শেষ করার পর ঝিরিতে গিয়ে বাকি কাজ শেষ করতে গিয়ে হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেল। চিৎকারের কথাগুলো ছিল ত্রিপুরা ভাষার, তাই দুজনে প্রথমে বুঝতে পারেনি, কিন্তু গত রাত থেকে আরাকান আতংক সবার মনেই ভীতি জাগিয়ে রেখেছিল।

রাজু বললো, দাদা দৌঁড় দেন, কে যেন আমাদের কাছে দৌঁড়ে আসছে, আর কি যেন বলছে। পাহাড়ী কোন ত্রিপুরাকে দৌঁড়ে আসতে দেখেছে কিনা স্বপন মনে করতে পারছিল না। দুজনে দৌঁড়ে পাড়ার আঙ্গিনায় আসতেই পাড়ার দোকান ঘর থেকে তিন –চার জন বলতে লাগলো, দুর দেন, ঘরে গিয়ে ঘুম করেন, আরাকানরা আইছে…। গত রাতের অস্বস্তিকর, কষ্টকর কাহিনী মনে হতেই দুজনে দৌঁড়ে মাচাং ঘরে চলে আসলো। সেন্ডেল নিচে রাখাতে কে একজন রাগ করে সেন্ডেলগুলো ঘরের ভিতরে ছুড়ে মারলো। ভাঙ্গা বাঁশের দরজা বন্ধ, দুজনকে আসতে দেখে সৈকত দরজা খুলে দিল, তারপর দ্রুত আবার বন্ধ করে দিল। 

বাঁশের ভাঙ্গা দর্জা, দরজার ডানপাশের নিচে কিছুটা বাঁশের অংশ নাই, ফাঁক দিয়ে ভিতরের অনেকটা দেখা যায়। সেই ফাঁক দিয়ে একটা ডিমপাড়া বা ডিমে তা দেওয়া মুরগী বারবার উঁকি দিচ্ছে, ঘরে ঢুকছে, আবার ভয় পেয়ে বাইরের মাচাং এ চলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কক কক করে এত মানুষের ভীরে, পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। এর আগে তার এই ডিমপাড়া  ঘরে এত অপরিচিত মানুষ কোনদিন হয়তো দেখে নাই। মুরগীটা ভিতরে যেদিকে যাবে সে পথে স্বপনের ট্রাকিং ব্যাগটা বাঁধা হয়ে আছে। একবার কিছুটা ভিতরে ঢুকেছিল, স্বপনের ভীতিকর চাহনী দেখে ভয় পেয়ে আবার ফিরে যায়।

সে তার প্রতিদিনের জায়গা মত ডিম পাড়বে কিন্তু আমাদের উপস্থিতির কারনে ডিম পাড়তে পারছে না, বা  তা দিতে পারছে না,  ডিমের নিরাপত্তার কথা মুরগীকে চিন্তা করতে হচ্ছে। কেউ মাথা উঁচু করলেই সে চলে যায়। সে ডিম পাড়বে নাকি  ডিমে তা দিবে—ত্রিপুরাদের কেউকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ হয়নি।

মাচাং ঘরের নিচে হেঁটে হেঁটে সে তার ডিম পাড়ার সময়ে বা ডিমে তা দেবার সময়ে সারাদিন যে আওয়াজ করে, সেই স্বরে-- 'ককর ককর এইইই ককর ককর, কক কক...' বিরামহীম আওয়াজ করেই যাচ্ছে। এই আওয়াজ আমাদের বাঙালীদের গ্রাম্য মুরগীর মতই, কোন তফাৎ নাই। স্বপন তার ছোটবেলার মুরগীর কথা মনে করছে। তার মা কত যত্ন করে ডিম পাড়া, ডিমে তা দেওয়া মুরগীকে সেবা দিত, সেই সাথে স্বপনও মাকে সহযোগিতা করতো। সারাদিন সে মুরগী আর খাবার নিয়ে খেলা করতো। বাচ্চা ফুটলে তো সারাদিনই মা মুরগীর পেছনে মুরগীর বাচ্চার মত ঘুরতো। মা মুরগী ওকে ঠোকর দিত না।

ডিম পারলে ডিম ধরতে যেত, একবার একটা তা দেওয়া ডিম কানের কাছে নিয়ে আওয়াজ শুনতে গিয়ে স্বপন ভেঙ্গে ফেলেছিল। ভাঙ্গা ডিমে বাচ্চা দেখা যাচ্ছিল।  মা মুরগী স্বপনকে সেদিন বারবার ঠোকর মেরেছিল। মুরগীর ঠোকর দেওয়া বন্ধ হয়েছিল, গালে মায়ের হাতের চড় পড়ার পর। বড় ভাইকে ডেকে বলেছিল, স্বপ্নারে ২১ দিন কৃষ্টনগরে রেখে আয়, নইলে আরো ডিম ভাঙ্গবে। জাজিজার কৃষ্টনগর স্বপনের মামাবাড়ি। ভাঙ্গা ডিমের বাচ্চা মুরগীর পাখার নিচে রাখলেও বাচ্চা আর বাঁচেনি। আজ এই মুরগীকে দেখে, তার অনবরত করকরানী আওয়াজ শুনে সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।

ঘরের বাইরে পাড়ার দোকান, আরকানী তিনজন বসে গল্প করছে, আর অপেক্ষা করছে, কখন পাথর টানার গাড়ি আসবে। গাড়ি আসলে সেই গাড়িতে চলে আরাকানী বিদ্রোহীরা তিনজন চলে যাবে। পলাশ ঘর থেকে বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনেকক্ষণ তিন আরাকানী আর তাদের আদর যত্ন করা স্থানীয় শ্যালকদের মনোযোগ দিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো। আরাকানীদের সাথে সাধারণত বউ- বাচ্চা থাকে না। দীর্ঘদিন, দীর্ঘবছর নোম্যান্স ল্যান্ড বা ভিনদেশে পড়ে থাকতে হয়, তাই এদের অনেকেই এই সব পাড়ার মেয়েদের বিয়ে করে, তাদের জামাই, দুলাভাই হয়ে উঠে। রাখাইন প্রদেশ স্বাধীন হলে, তারা হয়তো চলে যাবে, নয়তো এই পাহাড়ী বিভিন্ন জাতির সাথে এরা এক সময় রোহিঙ্গাদের অনেকের মত মিশে যাবে। তাদের ভাষা এই উপজাতিরা না বুঝলেও তথ্য আদান-প্রদান, সাধারণ কথা বার্তা চালাতে তেমন সমস্যা হয় না। সবার বুঝার মত, উর্দ্দু ভাষার মত কিছু ভাষার জন্ম গহীন পাহাড়ের অরণ্যে হতেই থাকে।

কি এক ভয়ঙ্কর অবস্থা! মুরগীটা আমাদের ভয়ে আছে, আর আমরা তার চেয়ে আরো অনেক বেশি ভয়ে ঝিম মেরে বসে আছি দশ হাত দূরত্বে পাড়ার দোকানে আরাকানী বিদ্রোহী সৈন্যদের উপস্থিতির কারনে। আমরা বের হলেই মুরগী ডিম পারবে, বা ডিমে তা দিবে, আর আরকানী সৈন্যরা চলে গেলে আমরা বের হব। গহীন পাহাড়ে আরাকানী সৈন্যদের কর্মকান্ড আগে থেকেই স্বপন জানে। তাই অন্যদের চেয়ে তার ভয়টা ছিল বেশি।

পাহাড়ের অনেক পাড়াতে শুনেছি, কারা যেন মেশিন দিয়ে পাথর টুকরো টুকরো করে, তারপর পাথর টানার ট্রাক দিয়ে সব নিয়ে যায়। এই পাড়ায় ঝিরিপথের পাশে সারা দিন-রাত মেশিন পাথর ভেঙ্গে যাচ্ছে। পাড়ার মানুষেরা কি অসহায় নাকি তারাও জড়িত, বুঝা গেল না। তবে পাথর ব্যবসার কারনে তাদের আয়-রোজগার হচ্ছে, পাড়ায় দুইটা দোকানও খুলেছে, আগে এসব দোকান ছিল না। এখানে পর্যটকরা সচরাচর আসে না। পর্যটক থাকার কোন পরিবেশ এখানে নেই।

আমাদের চিন্তা হচ্ছে, এভাবে এই জ্ঞানহীন কর্মীরা ঝিরিপথের বা দুপাশের সব পাথর উত্তোলন করলে ঝিরিপথের পানির চেহেরা কেমন হবে, একদিন পাহাড় প্রকৃতির কি হবে?

(চলবে)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত