দু:সাহসিক অভিযান

সাইপ্রাং ঝরনা

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২১, ১১:৩৯ |  আপডেট  : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:২১


 
কাওসার পলাশ
-------------- 
 
পর্ব -২
 

খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে রনি দাদার সাথে পরিচিত হইলাম। রনি দাদার সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলাম, তিনিও বাংলা ভাষা খুব ভালো জানেন না এবং বুঝেনও না। এমনকি তিনি খুবই স্বল্পভাষী একজন মানুষ। আমরা ৩ জন ফ্রেশ হয়ে, আমাদের ব্যাগগুলা গুছাতে শুরু করলাম। ব্যাগ গুছানোর সময় টিম লিডার বললেন "যেহেতু আমাদের অভিযানটা ম্যানকিও পাড়া থেকেই  হবে এবং ফেরার পথে সেইম ট্রেইলেই ফিরবো সেহেতু আমাদের কষ্ট করে ২ টা টেন্টই নেওয়ার দরকার নাই, একটা তাবু নিয়ে যাবো আর শুকনো খাবার কিসমিস,খেজুর খুরমা  এসব নিয়ে নাও"। ক্যাপ্টেনের কথায় টিমের যা যা দরকার সেই অনুযায়ী ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।তারপর আবার চিন্তা করলাম যেহেতু সেইম ট্রেইলেই আমরা ফিরে আসবো, তাই বেশি কাপড় নিয়ে ব্যাগটা অযথা ওজন বাড়াতে চাই নাই। তাই অধিকাংশ কাপড় আমরা এখানেই রেখে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।
 

 
 কাজ শেষ করে আমরা নাস্তা করে নিলাম। পাপ্পদা এসে রাস্তায় কি কি বিপদ হতে পারে এবং আমাদের তখন করনীয় কি তা সবকিছু ভালো করে আমাদেরকে এবং রনি দাদাকেবুঝিয়ে দিলেন। পাপ্পুদার কথা শুনে আমার ভয় ভীতি অনেক বেড়ে গেলো। তার মুখে যা শুনলাম তাতে বুঝতে পারলাম " আমি না জেনে শুনেই , না বুঝেই মনে হয় আগুনে ঝাপ দিতে আসলাম্! পাপ্পুদা বলছিলেন, আমাদের আগে মাত্র ৩ টা টিম ট্রাই করে একটা টিমই সেখানে যেতে পারছিলো ! এই কথাগুলা আমাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুল্লেও আমি মনস্থির ছিলাম। গাইড রনিদা সহ আমরা ৪ জনের টিম পাড়া থেকে বের হলাম "ম্যানকিউ " পাড়ার উদ্দেশ্যে। রনিদার হাতে একটা পাহাড়ি  দা নিয়ে নিলেন। আমরা ঝিরিপথ ধরে হাঁটাশুরু করলাম। 
আস্তেধীরে আমরা যত ঝিরিপথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তার অকল্পনীয় সৌন্দর্য যেনো আমাদের পাগল বানিয়ে দিচ্ছিলো। আমরা গল্প করছি আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। এই ঝিরিপথ অন্য যে কোন ঝিরিপথের থেকে অনেক ভিন্ন। দুই পাশে মস্ত বিশালকার পাথুরের দেয়াল, একদিকে যেমন অন্ধকার ভূতুড়ে রূপ ধারণ করে আছে, অন্যদিকে ভয়ংকর সৌন্দর্য নিয়ে সোজা হয়ে মূর্তির রুপ ধারণ করে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে মনে হতে লাগলো যতই গহীনে প্রবেশ করছি তত ট্রেইলের ঝর্ণার আছড়ে পড়া পানির বিকট শব্দ যেনো আমাকে আরো ভিতরে যাওয়ার আগ্রহকে দ্বিগুণ করে দিচ্ছে। চারদিকের এই অমায়িক সৌন্দর্যে যেনো আমি আমার নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! কোথায় ছিলাম আমি আর এই কোথায় আসলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম পাপ্পুদা হুদাই আজাইরা সবাইকে ভয় দেখাইছে। আমি মনে মনে আমার দলীয় ক্যাপ্টেন প্রতি অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।  কিছুক্ষণ পরপরই আমরা এ পার থেকে ওপারে করে করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ২ ঘন্টার বেশি পথ পারি দেওয়ার পরেই আমাদের সাম্নে এক বিশাল ঝর্ণা আবিস্কার করলাম। এটা আমার কাছে এতোটাই ভালো লাগছিলো যে আমি ভাবছিলাম,"যে এটাই মনে হয় সেই সাইংপ্রা"!! আমি রনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম দাদা চলে আসছি আমরা? "দাদা হেসে মাথা নেড়ে না বুঝালেন"। টিম লিডারের আদেশে আমরা সেখানে থামলাম, আমি এই সুযোগে ঝর্ণায় গিয়ে এক্টু গোসল দিয়ে আসলাম। তারপর কিছু শুকনো খাবার খেয়ে যেই আবারও আমরা হাঁটার জন্য প্রস্তুত, ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখলাম, নারগিস  তার পেট থেকে কিছু একটা সরানোর ট্রাই করছে। আমি জাস্ট দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম! এটা যেনো আমার জম, বিশালকার এক জোঁক। ভয়ে আমার শরীর কাপণ ধরে গেছে আর অন্যদিকে দেখি নারগিসের কাছে এটা  কিছুই না। সে এটাকে হাসতে হাসতে ফেলে দিলো! আমরা আবার হাটা দিলাম, এইবার আমাদের সামনে বিশাল পাহাড়। এখন শুধু উপরের দিকেই উঠতে হবে।
উপরের দিকে হাটতে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম পাপ্পুদার কথা ভুল না।খুবই খাড়া আর ভয়ংকর সুরু রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে এক টানা হেটেই যাচ্ছি। আর চারদিকের  নতুন নতুন সব অদ্ভুত অজানা শব্দগুলো আমার শরীর শিহরিত করে তুলছিলো। রনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম এসব কিসের শব্দ আসছে? দাদা বললেন এখানে প্রচুর বানর, হনুমান, ভাল্লুক, হরিণ এবং আরো কি কি যেনো আছে! বিশাল বড় বড় গাছগুলা আমাকে অবাক করে দিচ্ছিলো।
 
 এতো বড় বড় গাছ মনে হয় দেশের আর কোথায় ও নাই। এখনো এরকম বড় বড় গাছ আর কোন ট্রেইলেই আমার চোখেই পড়ে নাই। এদিক দিয়ে টাইগার জোকের অতিমাত্রায় অত্যাচার সহ্য করতে লাগতেছিলো, এটা আমার প্রথম ট্রেকিং হওয়াতে এই টাইগার যেনো আমার কাছে বাঘের থেকে ও ভয়ংকর  রুপ ধারণ করে আসছিলো। আমি খুবই সাবধানে ভয়ে ভয়ে হাটছিলাম।জোক ধরার সাথে সাথেই আমি খুব জোরেই চিক্কার করে উঠি আর রনিদা এসে দা  দিয়ে কেটে কেটে আমাকে রক্ষা করে চলছিলেন। জোকের ভয় দূর করানোর জন্য রনিদা আমার সাথে সাথেই হাঁটা ধরলেন। এদিকে দিয়ে আমাদের টিম লিডারের পশ্চাতে জোক খেয়ে ছোটখাটো এক ঝর্ণার অবতারণ ঘটিয়ে  দিছে,বেচারার রক্তে প্যান্ট পুরাই ভিজে গেছে। এটা দেখে এক্টু পরপরই আমি চিপায় গিয়ে উপর নিচ ভালো করে দেখে আসি আর হাটি। এরকম করে প্রায় ৪ ঘন্টার ট্রেকিং শেষ করে অবশেষে এক্টা পড়ার দেখা পাইলাম। এত্ত দূরে মানুষ বসবাস করে এটা ভেবেই আমি হতবাক!
ভাবতে পারছি না, মনে হলো, আমি বাংলাদেশ ছেড়েই অন্য কোন এক দেশে চলে আসলাম! এটাই হলো সেই ম্যানকিউ পাড়া, যেখানের মানুষ বাংলা ভাষার কিছুই বুঝে না। পাড়ায় মাত্র ৪-৫ টা পরিবার। সবাই আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলো  পাড়াতে রনিদার চাচার বাসায় প্রবেশ করলাম, রনিদার চাচাই হলেন এই পাড়ার কারবারি(পাহাড়ে পাড়ার নেতা কারবারি)। আমরা উনার বাসায় কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম ব্যাগ থেকে শুকনা খাবার খাইলাম সবাই। পাড়ার দাদা থেকে রনিদা জেনে আমাদের জানালেন যে আরো ২ ঘন্টার মতো উপরে দিকে উঠলে আরেকটা পাড়া আছে নাকি,তাই আম্রা যদি সেখানে চলে যাই আমাদেরই অনেক সুবিধা হবে। সেই কথা অনুপাতেই আমরা চিন্তা করলাম সাম্নের পাড়ায় গিয়েই আমরা রাত কাটাবো। সম্ভবত ৩:৩০ মিনিটের দিকে আমরা আবার সেখানে থেকে সেই পাড়ার উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। এটাও প্রচুর খাড়া রাস্তা আর ঘন জংগলের ভিতরের দিয়ে রাস্তা। একদিকে খাড়া রাস্তায় হাটা যেমন ভয়ংকর হয়ে গেছে অন্যদিকে প্রতিটি মিনিটে মিনিটে জোকের কামড় আমাদেরকে বিশেষ করে আমাকে হতাশ করে দিচ্ছে। আকাশে প্রচুর মেঘ, আস্তে ধীরে তা যেনো ঘন অন্ধকারে রুপ নিচ্ছে। প্রায় ১ ঘন্টা হাটার পরে প্রচুর বাতাস শুরু হয়ে গেলো। সমগ্র দুনিয়া যেনো কঠিন অন্ধকার রুপ নিলো!

 

   

সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উপরে ও এই অন্ধকার এতটাই ঘোর ছিলো যে আমরা আমাদের ব্যাগ থেকে টর্চ লাইট বের করতে বাধ্য হইছি। বাতাসের ভয়ংকর শব্দ যেনো কেয়ামতের বিভীষিকার মতো লাগছিলো আমার কাছে। মুশলধারে বৃষ্টি আর বাতাস বয়ে চলছে চারদিকে। আমরা ঠিক তখন রুংরাং এর ঘন বাশের জংগলের ভিতরে। না পারছি সামনের দিকে যেতে, না পারছি পিছনের দিকে ফিরে আসতে!! কারো মুখে কোন কথা নাই।এদিক দিয়ে এই জংগলের ভিতর  জোকের সাগর হয়ে গেছে।আমরা মনে হয় জোকের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে গেছি। এক এক্টা জোক যেনো ক্ষুধার্ত নেকড়ের ন্যায় আমাদের শরীরে উঠতেছিলো। একদিকে ভয়াবহ ঝড় বৃষ্টি আর অন্যদিকে জোঁকের ভয়ংকর অত্যাচার আর অসম্ভব লেভেলের ঠান্ডায় আমরা সবাই ভয়ে চিক্কার শুরু করে দিলাম। আমিই সবার আগে বলে উঠলাম, আমি আর যাবো না, আমি এখানের জুম ঘরে তাবু  নিয়ে একা একা থেকে যাই আপনারা সবাই ঘুরে আসেন, যাওয়ার পথে আমাকে আপনারা নিয়ে যাবেন।  বীভৎস অবস্থা দেখে টিম লিডার পৃথিল ভাইয়ের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এদিক দিয়ে নারগিসের মুখের কথা একদম বন্ধ হয়ে গেছে।  কোন রকম জীবন বাঁচানোই মনে হয়, এখন দায় হয়ে গেছে, দ্রুতই সবাই পিছনে নিচের দিকে নামতে শুরু করে দিলাম। ১০ মিনিট দূরেই একটা জুমঘর ছিলো, সেই ঘরেই আমরা আশ্রয় নেওয়ার জন্য নামতে লাগলাম।হটাৎ করেই অতিরিক্ত ঠান্ডার কারনে নারগিস অজ্ঞান হয়ে গেলো!! এটা দেখে আমি হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলাম। রনি দাদার সহায়তায় নারগিসকে নিয়ে কোন রকমে জুমঘরে প্রবেশ করলাম। আমি খুব জোরে জোরে সূরা ইয়াছিন পড়া শুরু করে দিলাম। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেছিলাম বারবার। দ্রুত তাবু টানিয়ে নিয়ে ভিতরে নারগিসকে ডুকালাম। কারো ব্যাগের কিছু  শুকনো ছিলা না।সব ভিজে গেছে ফলে আমরা আরো বিপদে পড়ে গেলাম।গাইড দাদাকে বললাম, দাদা আপনি কি পাড়ায় যেতে পারবেন এখন ? দাদা বললেন, পারবো। আমি বললাম, দাদা তাহলে লাইট নিয়ে আপনি পাড়ায় যান, গিয়ে আমাদের জন্য কিছু খাবার আর পারলে ২-৩ টা কম্বল নিয়ে আসেন। দাদা বের হয়ে গেলেন। আমার ব্যাগে মাত্র একটা গেঞ্জি পাইলাম যেটা শুকনো ছিলো।তাড়াতাড়ি করে নারগিসের জামাকাপড় খুলে তাকে আমার টি শার্ট পড়িয়ে দিলাম। আমার ব্যাগে সরিষার তেল ছিল এটা দিয়ে নারগিসের শরীর মাখা শুরু করে দিলাম। এর মধ্যেই টিম লিডারৗ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এটা দেখে মুহূর্তেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেলো।আমি ভয়ে চিক্কার করতেছিলাম আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেছিলাম আর বারবার সূরা ইয়াছিন পড়তেছিলাম। অনেক্ক্ষণ তেল মালিশ করার পরে নারগিস স্বাভাবিক হয়। পৃথিল ভাই আবল তাবল বলে যাচ্ছেন, আমি সকালে অফিসে যাবো, তারপর দুপুরে তোমাকে কল দিলে তুমি আসবা, এক সাথে কাচ্চি খাইতে যাবো। ঠান্ডার অবস্থাও অত্যন্ত ভয়ংকর থেকে অতিমাত্রায় ভয়ংকর রুপ নিচ্ছে। নারগিসের টি শার্ট ছাড়া বাকি সবার শরীরে ভিজা কাপড়। এক্টু পরপর আমার শরীর থেকে টি শার্ট খুলে আমি চিপ দিয়ে পানি ফেলে আবার পড়ে নিচ্ছিলাম। 

 
 
 
এদিক দিয়ে ভাল্লুকের ভয় আছে মনে ,যে কোন মুহূর্তেই ভাল্লুক আক্রমণ করতে পারে। ৩ জন এক তাবুতে গাদাগাদি করে শুয়ে থেকে শরীর গরম রাখা ট্রাই করে যাচ্ছি। আর বারবার তাবুর চেইন খুলে দেখি  রনিদা আসেন কিনা। রাত বেড়েই যাচ্ছে কিন্তু রনিদাআর আসেন না।আমাদের ভয় ও বেড়েই চলছে। সবাই যে যার মতো স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম। বাহিরে প্রলয়ঙ্কারী তীব্র বাতাস আর মুশলধারে বৃষ্টির গতি যেনো বেড়েই চলছে।এই জুমঘরটা চারদিক থেকে খোলামেলা হওয়াতে যেমন বাতাস তাবুটাকে উড়িয়ে  নিয়ে যাবে, অন্যদিকে থেকে বৃষ্টির পানিও খুব সহজেই টেন্টের ভিতর প্রবেশ করছিলো।ভয়ংকর রকমের ঠান্ডা মনে হইতেছিলো আমরা জমে যাচ্ছিলাম। যে যার যার মতো করে স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম। কারো মুখেই কোন কথা নেই, শুধুমাত্র একজন আরেকজনের শরীরের ভয়ংকর শীতকাপণ টের পাচ্ছিলাম। আর সবার মুখ থেকেই এক ধরনের ভয়ংকর অদ্ভুত ঘ্যানঘ্যান শব্দ আসছিলো। এদিকে দিয়ে ক্ষিধার যন্ত্রণায় পেট আর পিঠ যেনো এক সাথে হয়ে গেছে। আমি তাবু থেকে বের হয়ে আবারো দেখতেছিলাম রনি দাদার রাস্তার দিকে তাকিয়ে তিনি আসেন কিনা, কোন লাইটের আলোর দেখা পাই কিনা? কিন্তু না কোন আলোই দেখতে পাই না। "কথায় আছে বিপদ যখন আসে চারদিকে থেকেই যেনো আসে"। শুকনা খাবারের ব্যাগটা ও রনি দাদার  থেকে রেখে দেওয়া হয় নাই। ফলে ক্ষিধার যন্ত্রণা যেনো এখন আরেকটা বিপদের কারণ হয়ে গেলো আমাদের। রাত যতই বেড়ে চলছে বৃষ্টি আর ঠান্ডা ও পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলছে। বিভীষিকাময় প্রলয়ঙ্কারী প্রকৃতির কাছে আমরা ৩ জন মানুষ নিতান্তই অসহায়ের মতো বাঁচার জন্য আকুতি করে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম যেই কোন মুহূর্তেই হয়তো মৃত্যুর ভয়াল থাবা আমাদেরকে গায়েল করে নিবে।বারবার নিজের অতীত কর্মের জন্য স্রষ্টার  নিকট ক্ষমা চাচ্ছিলাম আর আর পরিবারের সাথে একবার ও দেখা হবে কিনা ভাবছিলাম!। অসম্ভব লেভেলের  কষ্ট হচ্ছিলো। একবার হলেও যদি পরিবারের যে কারো সাথে কথা বলতে পারতাম!! এগ্লা ভাবছি আর চোখের পানি ফেলতেছিলাম। কতটা যে অসহায় লাগছিলো!
  
এ বিভীষিকাময় রাতটা ও যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাতে পরিনত হয়ে গেলো। ভয়ংকর বৃষ্টি, তুফান,জোক ঠান্ডা আর অসহ্যকর ক্ষিধার যন্ত্রণা যেনো আমাদেরকে মৃত্যুর যেনো প্রস্তুতির ইংগিত দিয়ে যাচ্ছিলো!!। কখন সকাল হবে সেই অপেক্ষায় থেকে আর এক্টু পরপরই ঘড়ি দেখি কয়টা বাজে?। সময় ও যেনো বড়ই কঠোর আচরণ করে যাচ্ছে, প্রতিটি মিনিট এক একটা দিনের মতোই বড় মনে হইতেছিলো!!। শরীরের জামাকাপরও শুকাচ্ছে না। এভাবেই ১০ মিনিট ৫ মিনিট পরপর ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই যখনই ভয়াল রাতের পরিধি শেষ হয়ে কালো অন্ধকারের ঘনঘটা কিছুটা কমলো, ঠিক তখনই সাথে সাথে ৩ জন টেন্ট থেকে বের হলাম। অতি দ্রুত টেন্ট গুছানো শেষ করে, ব্যাগ থেকে যা যা বের করছিলাম তা খুব দ্রুত ব্যাগে ঢুকালাম। তারপর আর এক সেকেন্ড ও মনে হয় সেখানে দেরি করি নাই। সাথে সাথেই আমরা ৩ জন পাগলা ঘোড়ার ন্যায় নিচের দিকে নামা শুরু করে দিলাম। মনে হইতেছিলো যমদূত আমাদের পিছনে পিছনে ছুটে আসছে আর আমরা তার হাত থেকে বাচার জন্য দৌড়ে নামতেছিলাম।কিন্তু নামতে গিয়ে হলো আরেক বিপদ, রনি দাদা না থাকার কারণে সঠিক রাস্তা কোন্টা তা নিশ্চিত ছিলাম না।ফলে রাস্তা হারিয়ে যাওয়ার এক্টা ভয় ও মনে কাজ করছিলো তারপর ও আমরা মনে হয় একবার ও পিছনের দিকে তাকাই নাই।এতটা দ্রুতই নেমে আসছিলাম, যে তখন সামনে রাস্তা যেটা মনে হইছে, যে এটাই হতে পারে, সেটা দিয়েই প্রবেশ করছিলাম। আর সেই ক্ষেত্রে মহান স্রষ্টা  আল্লাহ সাহায্য না করলে হয়তো ওয়াইযাংশনে রাস্তা হারিয়ে আরেকটা বিপদে পড়তে পারতাম। এভাবেই নামতে নামতে যখন চোখের সামনে সেই পরিচিত পাড়া দেখা গেলো, মুহূর্তেই যেনো সকল কষ্ট বেদনা দূর হয়ে বিজয়ের আনন্দ অনুভব হলো। তখনও বৃষ্টি চলছেই,এই বৃষ্টি যেনো থামার কোন নাম গন্ধ ও নাই। কোথায় এক সেকেন্ডও দেরি না করে ম্যানকিউ পাড়ায় রনি দাদার সেই চাচার বাসায় প্রবেশ করে যা দেখলাম তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঘরে গিয়েই দেখি রনি দাদা বিছানায়! "দাদা আপ্নি কেনো আমাদের এখানে রাতে গেলেন না " এই প্রশ্ন করার মতো কোন বিবেক আমাদের ছিলো না।
  
দাদার পা রক্তাক্ত ছিলো, কিছু পুরানো কাপড়ের টুকরো  দিয়ে উনার পা বেধে রাখা ছিলো। দাদা নাকি পাড়ায় ফেরত এসে আমাদের জন্য খাবার আর কম্বল নিয়ে যাওয়ার পথে তার হাতের লাইট ঠিকঠাক ব্যবহার না করতে পারার কারণে কোন এক গাছের গুড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে বাম পায়ে মারাত্মক আকারে কেটে যায়। 

তারপর উনি সেগুলো সেখানে ফেলে দিয়ে কোন মতে নিজের শরীর নিয়ে আবার পাড়ায় ফেরত আসেন! উনার এই অবস্থা দেখে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ভয়াল রাতের কথা ভুলে গেলাম। দেরি না করে সাথে সাথেই রনি দাদার কাছে থাকা সেই ব্যাগ থেকে খাবার এবং মেডিসিন বের করলাম, নিজেরা ও খাইলাম এবং সবাইকে দিলাম। তারাপর আমাদের সাথে থাকা ঔষধ  দিলাম দাদাকে। এর মধ্যেই রনি দাদাকে বলে বাসার লোকজনের কাছে জানতে চাইলাম, যে আমাদের জন্য কোন খাবার বা জুম রান্না করে দিতে পারবে কিনা? কিন্তু তাদের নিজেদেরই খাদ্য সংকট থাকার কারনে আমাদেরকে এক কেজি জুম চাল ছাড়া আর কিছুই  দিতে পারবে না বলে জানালো। আমরা বলরাম যে দাদা জুমের চালই রান্না করতে বলেন।দাদাও তাদেরকে তাইবলে দিলেন।


 
নারগিস আর পৃথিল ভাই শুয়ে পরলেন। কিছুক্ষণ পরে পাড়ার এক লোক এসে জানালেন যে তার কাছে শুকুর এর গোস্ত আছে।এটা শুনেই পৃথিল ভাই তা খাওয়ার  জন্য উঠে পড়ে লাগলেন এমনকি আমাকেও উনি বলতে শুরু করেন আমিও যেনো এটাতে রাজি হই। এই কথা শুনেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে যাওয়ার অবস্থা। আমি উনাকে খুবই কঠোর ভাবে এটা জানিয়ে দিলাম, "যে দরকার হয় আমি এখানে না খেয়ে মারা যাবো তাও আমি হারাম খাবার আমার পেটে যেতে দিবো না"। এটা নিয়ে আমার সাথে উনার তর্কবিতর্ক হয়ে গেলো কিন্তু  আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে সে সরাতে পারেন নাই। তারপর আমি আর নারগিস কাচা মরিচ আর বাঁশের নরম অংশ সিদ্ধ করে করে খাবার খেয়ে নিলাম।
খাবার খেয়েই আমরা সাথে সাথেই রনি দাদার চাচার বাসায় শুয়ে পড়লাম।কম্বল পেয়ে মনে হলো নিজের বাসার বিছানায় শুইলাম। এদিক দিয়ে বৃষ্টি চলমানই। সারাদিন সেই পাড়াতেই আমরা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। ম্যানকিউ পাড়ার মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকায় আমরা আমাদের পরিবারের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে নিলাম।
পরের দিন খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই দাদাকে বললাম "দাদা আপনি কি হাটতে পারবেন"? দাদা বললেন,পারবো। তাহলে দাদা চলেন আমরা বের হই? দাদা এই কথা শুনে আমাদেরকে বারবারই নিষেধ করলেন বের হতে কিন্তু আমরা কোন কথাই শুনতে রাজি হলাম না। পাড়ার কারবারিও আমাদেরকে নিজের ভাষায় বারবার বুঝাতে ট্রাই করলেন,আমরা যেনো বের না হই! কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার অভাবে সেদিন আমরা যেনো অন্ধ ছিলাম। রনি দাদা এবং সেই পাড়ার দাদারা আমাদেরকে বারবার বলছিলেন, আমরা যেনো ২ দিন পরেই এখানে থেকে বের হই।পাহাড়ে অভিজ্ঞতাটা কতগুরুত্বপূর্ণ সেটা আমাদের সেদিন জানা ছিলো না। ফলে আমরা পাড়ার প্রতিটি লোকের কথাকে অবহেলা করেই সকাল সকাল রনি দাদাকে নিয়েই সবচেয়ে ভয়ংকর  বিপদের দিকে এগুতে থাকলাম।

চলবে...

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত