সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে ‘আগাম উদ্বেগ’ কেন?

  হাসান শান্তনু

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২২, ১১:২৪ |  আপডেট  : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:২৪

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল, আবার সরকার গঠন করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করার। সরকার গঠনের পর তিন বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই। গত বছরের শেষদিকে আইনমন্ত্রী ‘শিগগিরই সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের’ কথা জানানোর দুইদিন পর বলেন, এ ‘আইনের প্রয়োজন নেই’। প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে এখন সরকারের ‘আন্তরিকতার অভাব ও গড়িমসি’ দেখছে সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের সংগঠনগুলো।

তাদের ভাষ্য, ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’ ও আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ‘আগাম শঙ্কা’ তৈরি হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় নির্বাচন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একই সঙ্গে চলেছে। দেশে সবশেষ কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও সরকার, বা নির্বাচন কমিশন (ইসি) কারো বিচার করেনি। নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘুদের নিশানা করে বিশেষ মহল, সাম্প্রদায়িক শক্তি আক্রমণ চালায়। পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে আগামী দুই থেকে আড়াই বছর সময় খুব সংকটপূর্ণ। বছরজুড়ে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হলেও নির্বাচনের আগে সহিংসতা বেড়ে যায়।

সম্প্রতি গঠিত ইসিতে অন্তত একজন সংখ্যালঘু প্রতিনিধিকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে। সেই দাবি মানা হয়নি। সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে ইসি তাই কোনো ‘আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি’ বলে মনে করেন সংগঠনটির নেতারা। গত বছর দুর্গোৎসব চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ও সহিংস ঘটনায় সংখ্যালঘুদের মনে ক্ষতের সৃষ্টি হলেও এ বিষয়ে সরকার বিচার করেনি।

সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর অন্তত চার নেতা মত ও পথকে বলেন, অতীত অভিজ্ঞাই তাঁদেরকে শঙ্কিত করছে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে। আগে থেকে প্রশাসন সতর্ক হয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে যে কোনো পরিস্থিতি এড়ানো যেতে পারে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড রোধ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে আগাম সতর্কতা জানাতে, বিভিন্ন দাবি আদায়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ ৩৩টি সংগঠন মিলে গঠিত হয় সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা। গত ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত মোর্চার সভায় দাবি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২৪ মার্চ অন্তত দুই লাখ মানুষের স্বাক্ষরসংবলিত স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আমরা গত দশ বছর ধরে সাক্ষী সুরক্ষা আইন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কথা বলে আসছি। সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছি। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়। এখন পর্যন্ত সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি।’

গত বছরের ২৩ অক্টোবর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজিত আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ‘শিগগিরই সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে।’ এর দুইদিন পর, ২৫ অক্টোবর আইনমন্ত্রী ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের কোনো প্রয়োজন নাই। সংবিধানেই তাদের সুরক্ষার বিধান আছে। তবে সাক্ষী সুরক্ষা আইন হবে। সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।’

ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের অভিযোগ, ‘গত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছিল, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের। বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নের পাশাপাশি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দ্রুত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দেয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তি, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নসহ সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করবে বলেও প্রতিশ্রুতি ছিল। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।’

জানা যায়, নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্ষণ, তাদের সম্পত্তি দখলের ভয়াবহ ঘটনা দেশজুড়ে সবচেয়ে বেশি ঘটে ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের সময়। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের সরকার গঠিত হয়। দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে চলতে থাকে সংখ্যালঘুদের উপর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা। সরকারের মদদে তখন সংখ্যালঘু নির্যাতন চলে বলে দেশ-বিদেশে অভিযোগ ওঠে। বিশ্বজুড়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে দেশের ভাবমূর্তি।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দেয়, সরকার গঠন করতে পারলে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলের সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যার বিচার করবে। দলটি টানা তের বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও সেসব ঘটনার বিচার হয়নি।

কৃতজ্ঞতায় :
মত ও পথ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত