রিয়াজ ভাইয়ের মত মানুষ বিরল
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:০৭ | আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৩
সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, রিয়াজ ভাইয়ের দাফনের পরদিন। ভোরবেলায় রমনায় যখন হাঁটছি পরিচিত-অপরিচিত অনেকজন বললেনÑ আহা, করোনায় তাঁর মৃত্যু হলো, রিয়াজ সাহেব খুব ভাল মানুষ ছিলেন। আমাদের রিয়াজ ভাই, সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমদের মৃত্যুশোক কাটছে না। তবু এই উজ্জ্বল ভোরে মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। একজন পেশাদার সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমদকে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই ‘ভাল মানুষ’ বলছেন। সাংবাদিকদের সম্পর্কে অনেকদিন এমন ভাল মন্তব্য শুনি না। সত্যিই একজন পরিপূর্ণ এবং ভাল মানুষ ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন আহমদ। তিনি ভাল নেতা এবং ভাল সাংবাদিকও ছিলেন।
অপূর্ব মানবিক গুণাবলীর রিয়াজ ভাই কখনও কারও সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেছেন মনে করতে পারি না। দল-মত এবং বয়স নির্বিশেষে সবার সঙ্গে ছিল অসাধারণ সম্পর্ক। অসাধারণ রসবোধ ছিল তাঁর, অনেক কঠিন আলোচনায় তিনি প্রাণসঞ্চার করতে পারতেন এই রসবোধ দিয়ে। উচ্চকণ্ঠে কথা না বলে, অশোভন আচরণ না করেও যে প্রতিবাদ করা যায়, এটা আমরা রিয়াজ উদ্দিন আহমদের কাছে শেখার চেষ্টা করেছি। তিনি কারও সঙ্গে একমত হতে না পারলে ভিন্নমত জানাতেন কিন্তু কখনও খারাপ শব্দ ব্যবহার বা উত্তেজিত হওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েনি। কেউ সঙ্কটে পড়লে তার সঙ্গে কথা বলে সাহস পেতেন। মানুষকে বিপদে ফেলার কথা কখনও তিনি চিন্তা করতেন না। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাঁর। কখনও অনৈতিক সুবিধা নিতে হবে- এটা কল্পনাও করতেন না রিয়াজ ভাই। আর এ কারণেই সাহস নিয়ে পথ চলতেন। সত্য বলতে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত হবেন এমন ভয় তাঁকে তাড়া করত না। কোন ধরনের অহঙ্কারবোধ এক মুহূর্তের জন্যও তাকে গ্রাস করেনি। তিনি ছোট-বড় সবার সঙ্গে সমানতালে মিশেছেন। এজন্য তিনি সবার কাছে ‘প্রিয় রিয়াজ ভাই’ হতে পেরেছিলেন।
অসাধারণ নেতৃত্বগুণ ছিল তার। সাংবাদিকতার যে কোন সঙ্কটকালীন মুহূর্তে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার এ রকম গুণ হাতেগোনা খুব কম সাংবাদিক নেতার মধ্যে দেখেছি। সাংবাদিকদের অধিকার, নিরাপত্তা ও রুটি-রুজির প্রশ্নে রিয়াজ ভাই ছিলেন আপোসহীন। তাঁর স্পষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল কিন্তু তিনি তা পেশা বা পেশার নেতৃত্বের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতেন না। পেশার মর্যাদার জায়গাটিতে দলের আনুগত্যের কথা ভাবতেন না এই অসাধারণ সাংবাদিক নেতা।
১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী সদস্য হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হন রিয়াজ উদ্দিন আহমদ। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এবং ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন তিনি। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন। এরপর ২০০২ থেকে আবার দুই দফা প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন।
রিয়াজ উদ্দিন আহমদ সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাংবাদিকদের ফেডারেশন সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া সাংবাদিক সমন্বয় পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া এ্যাসোসিয়েশনের (সাফমা) সভাপতি ছিলেন। সম্পাদক পরিষদের সঙ্কটে তাকেই সামনে আসতে হয়েছিল। তিনি তার মেধা ও মনন দিয়ে চেষ্টা করেছেন সঙ্কট সমাধানে।
জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিক সমাজের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে তিনি তাঁর ফোরাম এমনকি তাঁর সমর্থক সরকারের কাছে অপ্রিয় হয়েছিলেন কিন্তু নীতির কাছে আপোস করেননি। আমরা যারা সাংবাদিক ইউনিয়ন করি বা জাতীয় প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব দিই, তাদের নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয়। কিন্তু সকল সঙ্কটকালে রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ছায়ার মতো পাশে থেকে সমাধান দিতেন। যে কোন কঠিন পরিস্থিতি খুব সহজভাবে সমাধানের অসাধারণ গুণ ছিল তার। এ সবই তিনি পেরেছেন তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বের কারণে। এ মানুষটিকে দেখেছি আমৃত্যু পেশা ও সহকর্মীদের পক্ষে অবস্থান নিতে। এর ফলে অনেক সময় তাকে তিনি যে দল সমর্থন করেন, সেই পন্থী সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়তে হতো। কিন্তু এসব তোয়াক্কা না করে তিনি সত্য ও সুন্দরের পক্ষই অবলম্বন করতেন। তিনি ভাল সাংবাদিক ছিলেন। রিপোর্টার থেকে সম্পাদক হয়েছিলেন। আমাদের পেশার নেতারা আগে ভাল পেশাদার সাংবাদিকও ছিলেন। বলা চলে, ভাল সাংবাদিকরাই আগে পেশার নেতৃত্ব দিতেন। অস্বীকার করার উপায় নেই এখন সেখানে ধস নেমেছে।
শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগদানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন রিয়াজ উদ্দিন আহমদ। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদক, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক, ডেইলি টেলিগ্রাফের সম্পাদক এবং নিউজ টুডের সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রিয়াজ উদ্দিন আহমদ পাকিস্তান অবজারভারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ অবজারভারে যোগ দেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে প্রধান প্রতিবেদক, বিশেষ প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নিয়মিত লিখতেন, বলতেন। তার লেখার মুনশিয়ানা আমাদের মুগ্ধ করে। ইংরেজী দৈনিকে কাজ করেও বাংলায় এত চমৎকার লিখতেন, অনেকের কাছে অনুকরণীয়। তার মৃত্যুতে ইংরেজী মাধ্যমের সাংবাদিকতা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর বহু লেখা আমাদের পথ দেখাবে অনেক দিন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন পরিচালনার কমিশনে রিয়াজ উদ্দিন আহমদ প্রধান ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি অনেক বছর। তিনি আমার ওপর অগাধ আস্থা রাখতেন, মাঝে মধ্যে কোন সভায় যেতে আমার দেরি হয়েছে কিন্তু তিনি আমাকে ছাড়া কোন সভা কোন দিন করেননি। তাঁর এই স্নেহ আমার খুব বড় পাওয়া। প্রেস কাউন্সিলে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কতটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তিনি।
সবমিলিয়ে সফল মানুষ রিয়াজ উদ্দিন আহমদ নিজেকে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
৭৭ বছর বয়সী রিয়াজ ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি একজন ভাল মানুষকে, একজন ভাল নেতাকে, একজন ভাল সাংবাদিককে। তাঁর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা পূরণ হতে হয়ত অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘদিন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত