মুজিববর্ষে জেলার নাম হোক বিক্রমপুর  

  মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২১, ১৯:৩৬ |  আপডেট  : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৫

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাস সচেতন ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি নারায়নগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার থানার নাম পরিবর্তন করে সোনারগাঁও ও মুন্সীগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে নামকরণ করেন বিক্রমপুর। যা বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সচেতনতার প্রমাণ।

জিয়াউর রহমান সরকার ১৯৮০ সালে মুন্সিগঞ্জ মহকুমাকে নারায়নগঞ্জের সাথে একীভূত করে নারায়নগঞ্জ জেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার বিরুদ্ধে বিক্রমপুরবাসী দলমত নির্বিশেষে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। প্রফেসর হাওলাদার আবদুর রাজ্জাককে আহবায়ক করে ‘বিক্রমপুর জেলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়।

প্রতিটি থানা সদরে ও ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গনে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইসব জনসভায়  নারায়নগঞ্জের সাথে বিক্রমপুরকে একীভূত করণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও বিক্রমপুর নামে পৃথক জেলা গঠনের দাবি জানানো হয়। হরগঙ্গা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জি এম এ মান্নান পত্রিকায় বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, বিক্রমপুরের কেবলা নারায়নগঞ্জ নয়, ঢাকা।

প্রবল জনমতের কারণে জিয়া সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে আন্দোলনে আমাদের দাবি ছিল জেলার নাম হবে বিক্রমপুর। আন্দোলনকালে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, মুন্সিগঞ্জ সদরের লোকজন বিক্রমপুর নামে জেলা করতে আগ্রহী  নন। তাদের ধারণা বিক্রমপুর নামে জেলা হলে জেলা সদর মুন্সিগঞ্জ থেকে স্থানান্তর হতে পারে। তাই বিক্রমপুর নামের প্রতি তাদের অনীহা। মরহুম আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরী সাহেবও নামের শেষে ‘বিক্রমপুরী’ ব্যবহার করলেও বিক্রমপুর নামে জেলার নামকরণ আন্দোলনকে সমর্থন করেন নি। সে সময়ে আমি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় বিক্রমপুর নামে জেলা চাই দাবিতে প্রচুর লেখালেখি করি। দৈনিক ইত্তেফাকে লেখা পাঠালে বিভাগীয় সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান আমাকে জানান- আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরী সাহেবের নামে দিলে তিনি তা ছাপাবেন। আমার নাম বাদ দিয়ে বিক্রমপুরী সাহেবের নামে টাইপ করে তাঁর স্বাক্ষরের জন্য ডাকযোগে মুন্সিগঞ্জে পাঠাই। তিনি এ বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করবেন জানিয়ে পত্র লিখে দিনক্ষণ দিয়ে তাঁর ভাতিজীর রথখোলার বাসায় যেতে নির্দেশ দেন। আমি আমাদের এলাকার সন্তান বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক দেশ-এর তৎকালীন সহকারি সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ নূরুল ইসলামকে নিয়ে আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী সাহেবের  সাথে দেখা করি। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘বিক্রমপুর হলো প্রবহমান খরস্রোতা নদী আর মুন্সিগঞ্জ হলো পাড়বাঁধা পুকুর। জেলা নামকরণ করে আমরা কেন বিক্রমপুরকে পাড়বাঁধা পুকুর বানাতে চাই? তাঁর যুক্তি না মানতে পারলেও আর কোনো কথা না বলে আমরা চলে আসি।

মুন্সিগঞ্জের নামকরণের বিষয়ে বিক্রমপুরী সাহেব আমাদের আরো বলেছিলেন, ‘মুন্সিগঞ্জের হিন্দু জমিদারদের বংশীয় পদবি মৈত্রমুন্শী থেকে মুন্সিগঞ্জ ও মুন্সিরহাট নামকরণ হয়। মুন্সি শব্দের সাথে মুসলমানিত্বের কোনো সম্পকর্ নেই । যেমন নেই বিক্রমপুরের সাথে হিন্দুত্বের সম্পর্ক। বিক্রম অর্থ শৌর্য-বীর্য, শক্তি ও সাহস। যে জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বীর বিক্রম।

বিক্রমপুর নামে জেলা চাই আন্দোলন আর এগোয় নি। তবে সাংবাদিক শেখ মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম তার বিভিন্ন বহু লেখায় বিক্রমপুর জেলা নামকরণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। এমন কি ‘কেন বিক্রমপুর নামে জেলা চাই’ শিরোনামে একটি পুস্তিকাও ছাপিয়েছিলেন। বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া বিশ্ববিখ্যাত মনীষী-বিজ্ঞানী, উপমহাদেশের রাজনীতি, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রভূত অবদান রাখা ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করে জেলার নাম বিক্রমপুর রাখার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীতে সাংবাদিক রফিক চৌধুরীর উদ্যোগে গঠিত বিক্রমপুর প্রেস ক্লাব ‘বিক্রমপুর জেলা চাই’ আন্দোলন কিছুদিন অব্যাহত রাখে।  ১৯৮৪ সালে বিক্রমপুর প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে কুচিয়ামোড়া ফেরি ঘাটে বিক্রমপুর জেলার দাবিতে দিনব্যাপী প্রতীক অনশন করেন ক্লাবের সদস্য ও বিশিষ্টজনেরা। প্রখ্যাত সাঁতারু ও বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান ব্রজেন দাশ সন্ধ্যায় লেবুর শরবত পান করিয়ে সে অনশন ভঙ্গ করান। এরপর ওই বছরই জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে সংগঠনটি বিক্রমপুর জেলার দাবিতে সভা করে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি শাহজাহান মিঞা এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব) সহ বিক্রমপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে ওই দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পরবর্তী সময়ে নানা কারণে সে আন্দোলন আর এগোয় নি। এক পর্যায়ে তা স্তিমিত হয়ে যায়। 

গত কয়েক বছর যাবত জনৈক ফৌজদার মুনশী হায়দার হোসেনের নাম থেকে মুন্সিশীগঞ্জ নামকরণ হয়েছে বলে কেউ কেউ  লেখালেখি করছেন; যার ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই, কোনো রেফারেন্সও নেই।। অথচ মুন্সিগঞ্জ জেলার মুদ্রিত বানিজ্যিক ম্যাপে তাই ছাপা হয়েছে,  যা ঠিক নয়। এভাবেই ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে।

সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক প্রয়োজনে নতুন নতুন ইউনিয়ন, উপজেলা, বিভাগ সৃষ্টি করছে। কোনো কোনোটির নামও পরিবর্তন করছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্য বিবেচনায় তাই মুন্সিগঞ্জ জেলার নাম বিক্রমপুর জেলা করা এখন সময়ের দাবি। সরকার যদি এ জেলার নাম বিক্রমপুর করে, তাহলে হাজার বছরের ইতিাহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ জনপদের নামটি বেঁচে থাকবে এবং এ জেলাবাসী একটি ঐতিহ্যমন্ডিত জেলার বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবে। 

বঙ্গবন্ধু যদি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাত নির্মমভাবে নিহত না হতেন, তাহলে আজ বাংলাদেশের ইতিহাস যেমন ভিন্ন হতো, তেমনি বিক্রমপুর জেলাও প্রতিষ্ঠিত হতো। আজ বাংলাদেশের কান্ডরি হিসেবে আছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা; যিনি বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমি মনে করি জাতির জনকের গৃহিত উদ্যোগ ‘বিক্রমপুর জেলা’ তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে। এখানে আমি এটাও বলতে চাই যে, জেলার নাম বিক্রমপুর করা হলেও জেলা সদর মুন্সিগঞ্জে রাখতে কোনো সমস্য নেই। যেমন জেলার নাম নোয়াখালী হলেও এর হেড কোয়ার্টার মাইজদী কোর্ট। তেমনি জেলার নাম বিক্রমপুর হলেও জেলা সদর মুন্সিগঞ্জ থাকলে কারো কোনো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না।

এই নিবন্ধের মাধ্যমে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আকুল আবেদন জানাই, মুন্সিগঞ্জ জেলার নাম বিক্রমপুর জেলা করে লাখো মুজিবভক্তের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করুন। আজ দেশে পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীতে এটা একদিকে বিক্রমপুরবাসীর জন্য যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হবে, তেমািন বঙ্গবন্ধুর শেষ ইচ্ছার প্রতি দেখানো হবে যথাযথ সম্মান।    

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ সম্পাদক, বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত