প্রীতিরা খুন হউক আকাশরা খুনি হউক এমন রাষ্ট্র চাই না
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২, ১০:১৯ | আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:২৭
একজন পিতার কাছে তার জীবনের পরেই সবচেয়ে প্রিয় তার সন্তান। কখনো সন্তানের ভালবাসা নিজের জীবনকে ও হার মানায়। আর পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো পিতার কাঁধে তার সন্তানের লাশ। আবার বাবা মানে একজন সন্তানের কাছে তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের স্হান দাবী পুরনের জায়গা। বাবা তার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে তার সন্তাের দাবী পুরনের চেষ্টা করেন। সন্তান দুধে ভাতে থাকুক প্রতিটি পিতা মাতার ই একই আকাংখা । তবে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে কখন একজন পিতা তার প্রিয় সন্তান হত্যার বিচার চান না এটাই একটি বড় প্রশ্ন। গত ২৪ মার্চ রাত দশটার দিকে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা শাজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হতে হয় ঢাকা বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের ছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি। অবশ্য খুনিদের টার্গেট প্রীতি নয় খুনিদের টার্গেট ছিল বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। যদি ও খুনিরা তাদের টার্গেট সম্পন্ন করতে পেরেছে তারা উপর্যুপরি গুলি করা টিপুকে হত্যা করে সাথে আহত হয় টিপুর গাড়ী চালক মুন্না। আমি প্রথমেই জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা নিয়ে সামান্য কিছু বলবো। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা দেখলাম টিপুকে প্রাকশ্যে রাজধানীর একটি ব্যস্ততম এলাকা শাজাহানপুরের রাস্তার যানজটে শত শত মানুষের সামনে সিনেমার কায়দায় গুলি করে হত্যা করে খুনিরা। একটি নয় দুইটি নয় খুব কাছ থেকে টিপুকে ডজনের অধিক গুলি করে খুনিরা। খুনিরা টিপুকে হত্যা করে পালাবার পথ সুগম করার জন্য যখন এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে সেই গুলিতেই জীবন দিতে হয় কলেজ ছাত্রী প্রীতিকে। এর আগেও ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিপণী বিতানের সামনে এমনই একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল। ঐ ঘটনায় খুন হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি। আলোচিত মিল্কি হত্যা মামলার আসামী ছিলেন সদ্য খুন হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু পরে যদিও টিপুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া। টিপু নিজে মতিঝিল এলাকার সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে পরিচিত। প্রকাশ্যে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ঠিকাদারির ব্যবসা থাকলেও আড়ালে এলাকা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি ও চাঁদাবাজি ই ছিল নাকি তার মুল পেশা । এলাকার দখল বজায় রাখা নিয়ে প্রতিপক্ষের গডফাদারদের সঙ্গে ছিল দ্বন্দ্ব । এ দ্বন্দ্বের ফলাফল ই মিল্কির মত টিপুৃকে জীবন দিতে হয়। দখলের রাজ্যে এক দখলদার গ্রুপ নিজেদের স্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিজেদের ভিতর কুকুরের মত মারামারি কামড়াকামড়ি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ওদের খুনাখুনির বলি হতে হবে সাধারণ মানুষকে এটাই সবচেয়ে ভাবার বিষয়।
প্রীতি একজন সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন । প্রীতির বাবা জামাল মিরপুরের একটি প্লাস্টিক কারখানায় সামান্য বেতনে চাকুরির করেন। দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে থাকতেন শান্তিবাগের ভাড়া বাসায়। দুই সন্তান নিয়ে জামালের ও অনেক স্বপ্ন ছিল। প্রীতির ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিল অনেক স্বপ্ন। সংসার একটু ভাল ভাবে চলবে তার জন্য কলেজ পড়ুয়া প্রীতি একটি চাকুরি ও যোগার করেছিলেন । কিছু কিছু স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন ই থেকে যায়। প্রীতি হত্যার পর সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া প্রীতির বাবার বক্তব্য আমাদের রাষ্ট্রের একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। প্রত্যেক হত্যা কান্ডের পর ই ভুক্তভোগী পরিবার রাষ্ট্রের কাছে বিচারের দাবী করবেন তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের বিশেষ সহযোগিতা চাইবেন এটাই স্বাভাবিক কিন্তু প্রীতির বাবা এই রাষ্ট্রের কাছে বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের কাছে বিচার চান নি বা বিচারের দাবী করেন নি। প্রীতির বাবা বিচার চেয়েছেন সৃষ্টি কর্তার নিকট। প্রীতির বাবার এমন চাওয়াই প্রমান করে আমাদের রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্হা আইন প্রশাসন সরকার সব কিছু থাকার পর ও তা কতটুকু জনমানুষের কল্যানে কাজ করে? আমরা ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথা ও ভুলে যাই নাই। দীপন ছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বিকেলে সন্ত্রাসীরা তার অফিসে ঢুকে কুপিয়ে হত্যাকরে দীপনকে। দীবন হত্যার পর তার বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ও রাষ্ট্রের কাছে তার পুত্র হত্যার বিচার দাবী করেন নি। কারন তিনি জানতেন এই রাষ্ট্রের কাছে সাধারন মানুষ আজো বিচারের জন্য নিভৃতে কাঁদে। যদি ও ইতোমধ্যে দীপন হত্যার বিচারের রায় হয়েছে। ঠিক হয়তো প্রীতির বাবার মনের ভিতর ও বিচার হীনতার ই সেই প্রভাব বিস্তার করেছে। আমাদের দেশে আজো বিচারের বানী নিভৃতে ই কাঁদে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় খুন হয় সাংবাদিক দাম্পতি সাগর রুনী দীর্ঘ দিন পার হলে ও এই হত্যার কোন কুল-কিনারা করতে পারেনি আমাদের আইন ব্যবস্হা। প্রিয় সন্তানের বিচারের আক্ষেপ নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে রুনির মা নুরুন নাহার মির্জাকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্রী তনু হত্যার ই বা কি হলো? ২০১৬ সালের ২০শে মার্চ তনুর মৃতদেহ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে পাওয়া যায় খুন হন তনু। এর পর তনু হত্যাকান্ড নিয়ে জাতি কে দেখতে হয়েছে নানান নাটক। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট একেক সময় একেক ভাবে দেওয়া হলো। যা আমাদের জন্য একটি আশিন সংকেত বহন করে। আজো কারা তনুকে হত্যা করলো কেন করলো তা জাতির কাছে অজানাই রয়ে গেল। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে খুন হয় তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ৬ মার্চ ২০১৩ বিকেলে সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ করা হয়েছিল। এর দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ২৮ মে ২০১৩ উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর তদন্তভার গ্রহণ করে। ত্বকীর হত্যাকারী হিসেবে ত্বকীর বাবা নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে নানান প্রতিবাদ প্রতিরোধ অনুরোধ করলেও হত্যাকাণ্ডের বিচার আজো ও হয়নি। ত্বকি হত্যাকারী হিসেবে রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী পরুিবারকে দায়ী করলে ও তারা ধরা ছোয়ার বাহিরেই রয়ে গেছে। প্রতি মাসের ৮ তারিখে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আজও মোমবাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। দেশে আইন-আদালত-বিচার ব্যবস্হা সবই তো আছে তার পর ও কেন এমন আর্তনাদ কেন হাহাকার?
ইতোমধ্যে টিপু ও প্রীতি হত্যাকারীদের এক জন ঘাতক মো. মাসুম ওরফে আকাশকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। আকাশের দেয়া তথ্য ও পুলিশের ভাষ্যমতে আকাশ একজন কন্ট্রাক্ট কিলার। তবে টিপু হত্যার জন্য আকাশের সাথে হত্যার মুল পরিকল্পনাকারীদের চুক্তি ছিল কোন মোটা অংকের টাকা পয়সা নয় আকাশের বিরদ্ধে থাকা আগের সকল মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্হা করা হবে এমন চুক্তিতে ই টিপুকে খুন করে আকাশ । আকাশের এমন তথ্যে প্রমান করে টিপু হত্যাকারীরা কত টুকু প্রভাবশালী। ঘাতক আকাশের পিতা নাকি একজন শিক্ষক আকাশ ও নাকি একটি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাফিক ডিজাইনে পড়াশোনা শেষ করেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে একজন শিক্ষক পিতার শিক্ষিত সন্তানকে কে বা কারা একজন খুনি হিসেবে তৈরি করলো ? এই উত্তরটা সবারই নিঃসন্দেহে জানা। আমাদের দেশের নষ্ট রাজনীতি আর নিলজ্জ ক্ষমতার লোভ এমন অনেক মেধাবী আকাশকে সন্ত্রাসী খুনি হিসেবে আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রে পরিচিত করেছে। আর টিপুকে ও হত্যার করা হয় ঐ একই কারনে। টিপু রাজনীতির পাশাপাশি অপরাধ জগতের একজন হলে ও প্রীতিকে জীবন দিতে হয় বিনা কারনে। প্রীতি একজন ছাত্রী সাধ্রারন পথচারী তবে প্রীতকে জীবন দিতে হলো দখলদারিত্ব ক্ষমতার আধিপত্য তথা আমাদের নষ্ট রাজনীতি কাছে। শুধু প্রীতি ই না ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনিকে জীবন দিতে হয় এই একই ভাবে। টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সনি। পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে সনি হত্যার বিচার হলে ও আাসামীদের অনেকেই দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে আয়েশি জীবন যাপন করছে। প্রীতি হত্যার বিচার তার বাবা না চাইলেও রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রীতি হত্যার সঠিক বিচার দাবী করছি। সেই সাথে এটা চাইবো আমাদে রাষ্ট্রের নষ্ট রাজনীতির শিকার হয়ে আর কোন আকাশকে যেন খুনি হতে না হয় আর কোন প্রীতিকে অকালে জীবন দিতে না হয়।
লেখকঃ ওয়াসিম ফারুক, কলামিস্ট
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত