ঢাকায় আওয়ামী লীগের সূচনা পর্ব

  আনিস আহামেদ

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২২, ১০:৫৮ |  আপডেট  : ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৮

১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের শাহবাগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিতা জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১২ সালের ২ মার্চ ঢাকায় যাত্রা শুরু করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, যা সংক্ষেপে বিপিএমএল নামে পরিচিত ছিল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। যদিও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাংগঠনিক ভাষা ছিল উর্দু; কিন্তু বিপিএমএল সাংগঠনিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, প্রস্তাবাবলি চিঠিপত্র বাংলা ভাষায় লেখা হতো। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৪৫ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক সরকারের পতন ঘটে এবং বঙ্গে গভর্নরের শাসন জারি করা হয়।

বঙ্গের মুসলিম সমাজের অন্যতম বলিষ্ঠ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯২৬ সালে ইন্ডিপেন্ডেট মুসলিম লীগ ও ১৯৩৭ সালে ইউনাইটেড মুসলিম লীগ গঠন করেন। অতঃপর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে বঙ্গীয় মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় বিপিএমএল-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশিম। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গীয় আইন সভা ২৫০ আসনের মধ্যে ১১৪টি আসনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বঙ্গে সরকার গঠন করে বঙ্গের চিফ মিনিস্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

১৯৩৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগে যোগদানের পর তার জাদুকরি নেতৃত্ব গুণাবলিতে বঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও লীগের তরুণ নেতাকর্মীরা তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। যার প্রভাব পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকায়ও বিস্তৃত হয়। এর মূল কারণ ছিল ঢাকার নবাব বাড়ির সন্তানরা বঙ্গীয় মুসলিম লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা থাকলেও, সাধারণ মানুষের সাথে তাদের কোনো সহজাত যোগাযোগ ছিল না। সমাজের অভিজাত শ্রেণি নবাব জমিদাররা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করতেন। বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একক প্লাটফর্ম হিসেবে মুসলিম লীগের বাইরে তাদের বিকল্প ভাবনার অবকাশ ছিল না। এর পিছনে ছিল হিন্দুদের বর্ণবাদী মনোভাব ও দীর্ঘমেয়াদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাবে পূর্ববঙ্গে মুসলিম সমাজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তারা মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিল। পূর্ববঙ্গের তরুণ নেতা-কর্মীদের সোহরাওয়ার্দী-ঝোঁক ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গের চিফ মিনিস্টার হওয়ায় তিনি অত্র অঞ্চলের একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ঢাকার নেতৃস্থানীয় লীগ কর্মীদের কলকাতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ঢাকায় মুসলিম লীগের দুটি ধারা বিদ্যমান ছিল। তার একটি অংশ পরিচালিত হতো ঢাকার ইসলামপুরসহ নবাব বাড়িতে। যারা নাজিমুদ্দিনপন্থি মুসলিম লীগার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দীপন্থি মুসলিম লীগারদের অফিস ছিল ১৫০ মোগলটুলি। শামসুল হক-শওকত আলী প্রমুখ তরুণ লীগ নেতারা এই অফিস পরিচালনা করতেন।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে কলকাতার প্রায় সকল পূর্ববঙ্গীয় যুব-তরুণ নেতারা ১৫০ মোগলটুলি লীগ অফিসে জড়ো হতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তাদের নেতৃত্বে প্রথমে ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

পক্ষান্তরে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ভারত বিভাজনের পর তিনি তড়িঘড়ি করে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে ১৯৪৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। অতঃপর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল ছিলেন।

খাজা নাজিমুদ্দিন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। এই দক্ষতায় তিনি বাংলার মুসলমানদের অগ্রসরমান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। খাজা নাজিমুদ্দিন যখন পূর্ব বাংলার চিফ মিনিস্টার তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন।

পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি খণ্ডিত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। খাজা নাজিমুদ্দিন একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলা ভাষাবিদ্বেষী নেতা ছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হন। তার এই মনোভাবের কারণে ঢাকার সাধারণ মানুষ মুসলিম লীগবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। তাদের আশার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলন করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এই দলের প্রধান সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান অতি দ্রুততার সাথে পুরান ঢাকার অলি-গলি-মহল্লায় ঘুরে প্রতিবাদী মুসলিম কর্মীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন এবং জনমনে এর ব্যাপক সাড়া পরিদৃষ্ট হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তার জাদুকরি যোগ্যতায় হয়ে ওঠেন ঢাকাবাসীর আপনজন। ঢাকাবাসী তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে।

ঢাকায় আওয়ামী লীগের সূচনালগ্ন ও দুঃসাহসিক কর্মকা-ের বিবরণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধৃত করা হলো :

এই সময়ে আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটে আমাদের কর্মীর মধ্যে (১৯৪৭ সাল)। আমাদের যে মিল্লাত প্রেসটা ছিল- সেটা হাশিম সাহেব পরিচালনা করতেন। কথা উঠল, প্রেসটা কি করা যায়? হাশিম সাহেব পূর্বেই দেনা হয়ে পড়েছেন বলে একটা রঙিন মেশিন বিক্রি করে দেন, তাতে দায়দেনা শোধ হয়ে যায়। তিনি শামসুল হক সাহেবকে ঢাকা থেকে ডেকে নিয়ে বললেন, “কলকাতার কর্মীরাও অনেকে ঢাকা চলেছে, আমি পাকিস্তানে যাব না। তোমরা প্রেসটা ঢাকায় নিয়ে একে কেন্দ্র করে দলটা ঠিক রাখ, আর কাজ চালিয়ে যাও।” শামসুল হক সাহেব আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজি হলেন, ঢাকার লীগ অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রেসটি বসানো হবে। মিল্লাত কাগজ চলবে, আমরা এক একজন এক একটা বিভাগের ভার নেব। শামসুল হক সাহেব ঢাকায় এসে সবকিছু ঠিক করে কলকাতা গেলেন। হাশিম সাহেব আবার কলকাতার কর্মীদের বললেন, “তোমরা তো কলকাতায় থাকলে, তোমাদেরই বোধহয় প্রেসটা থাকা দরকার। কারণ, হিন্দুস্তানে তোমরা কিইবা করবা! যাদের বাড়ি পাকিস্তানে পড়েছে তাদের আর প্রয়োজন কি, পাকিস্তান তো হয়েই গেছে।” কলকাতার কর্মীরা বলে বসল, ঠিকই তো কথা। যখন হক সাহেব এই কথা শুনলেন, কিছুই না বলে ফিরে এলেন। আমি তখন হাশিম সাহেবের কাছে বেশি যাই না। কারণ, তিনি আমাকে শহীদ সাহেবের সমর্থক বলে বিশ্বাস করতেন না, আর আমিও শহীদ সাহেবের সাথে তাঁর ব্যবহার সমর্থন করি না। একে আমি বিশ্বাসঘাতকতা বলতাম। (পৃষ্ঠা-৭৯)

আব্বা, মা ও রেণুর কাছে কয়েকদিন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে (১৯৪৭ সাল) ঢাকা এলাম। পূর্বে দু’একবার এসেছি বেড়াতে। পথ ঘাট ভাল করে চিনি না। আত্মীয়স্বজন, যারা চাকরিজীবী, কে কোথায় আছেন, জানি না। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের কর্মীদের সভা ডেকেছেন শামসুল হক সাহেবÑ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে। আমাকে খবর দিয়েছেন পূর্বেই। তাই কয়েকদিন পূর্বেই এসে হাজির হতে হল। ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করলাম, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে পৌঁছে দিতে। দেখলাম, রসিক গাড়ওয়ান মোগলটুলী লীগ অফিস চেনে। আমাকে বলল, “আপনি লীগ অফিসে যাইবেন, চলেন সাব আমি চিনি।” শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কিযে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত। তিন-চার দিন পরেই কনফারেন্স হবে। বহু কর্মী এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। অনেকেই মোগলটুলীতে উঠেছে। শামসুল হক সাহেব বললেন, “জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় কনফারেন্স করব? সরকার না-কি এটাকে ভাল চোখে দেখছে না। আমাদের কনফারেন্স যাতে না হয় সেই চেষ্টা করছে এবং গোলমাল করে কনফারেন্স ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে।” আমি বললাম, “এত তাড়াতাড়ি এরা আমাদের ভুলে গেল হক সাহেব।” হক সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, “এই তো দুনিয়া!”

বিকালে হক সাহেব (শামসুল হক) আমাদের নিয়ে বসলেন- কনফারেন্সে কি করা হবে সে সম্বন্ধে আলোচনা করতে। একটা যুব প্রতিষ্ঠান গঠন করা দরকার, যাতে তরুণ কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে না যান। আমি হক সাহেবকে বললাম, “যুব প্রতিষ্ঠান একটা করা যায়, তবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত হবে কি না চিন্তা করে দেখেন। আমরা এখনও মুসলিম লীগের সভ্য আছি।” হক সাহেব বললেন, “আমরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ছি না।” হক সাহেব খুবই ব্যস্ত, হল ঠিক করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসানাত সাহেবের বাড়িতে কনফারেন্স হবে ঠিক হল। তিনি রাজি হলেন, আর কেউই সাহস পেলেন না আমাদের জায়গা দিতে।

কনফারেন্স শুরু হল। জনাব আতাউর রহমান খান ও কামরুদ্দিন সাহেবও এই কনফারেন্স যাতে কামিয়াব হয় তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কামরুদ্দিন সাহেবের সাথে আমার পূর্বেই পরিচয় ছিল। আতাউর রহমান সাহেবের সাথে এই প্রথম পরিচয় হয়। প্রথম অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে সাবজেক্ট কমিটি গঠন হল। আমাকেও কমিটিতে রাখা হল। আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও যোগদান করেছে। তারা তাদের মতামতও প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রথমে ঠিক হল, একটা যুব প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে, যে কোন দলের লোক এতে যোগদান করতে পারবে। তবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে যতখানি দূরে রাখা যায় তার চেষ্টা করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানকে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করেÑ যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল, কিন্তু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন দলটা বলল, আরও প্রোগ্রাম নেওয়া উচিত, যেমন অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম। আমরা বললাম, তাহলে তো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে। (পৃষ্ঠা-৮৩, ৮৫)

‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগে’র নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ করা হয়েছে। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই জেনারেল সেক্রেটারি রইলেন। ঢাকায় কাউন্সিল সভা না করে অন্য কোথাও তাঁরা করলেন গোপনে। কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র নয়, ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল, আর হয় নাই। আমরা ঐ কমিটি মানতে চাইলাম না। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নয়। আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন, আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান করা দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল, সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হল।

প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই। আমরা ‘মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসও করা হল। শওকত মিয়া টেবিল, চেয়ার, আলমারি সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। তাকে না হলে, আমাদের কোন কাজই হত না তখন। আমরা যে কয়েকজন তার সাথে মোগলটুলীতে থাকতাম, আমাদের খাওয়া থাকার ভার তার উপরই ছিল। মাসে যে যা পারতাম, তার কাছে পৌঁছে দিতাম। সেই দেখাশোনা করত। (পৃষ্ঠা-৮৮, ৮৯)

দিনটা আমার ঠিক মনে নাই। তবে ঘটনাটা মনে আছে ১৯৪৮ সালের ভিতর হবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। তখন ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব সহ-সভাপতি ছিলেন হলের (এখন সৈয়দ নজরুল সাহেব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমি জেলে থাকার জন্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।)। শহীদ সাহেবের বক্তৃতা এত ভাল হয়েছিল যে, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতেন তারাও ভক্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে মন্ত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বা হলের কাছেও যেতে পারতেন না। শহীদ সাহেব যখন পরে আবার ঢাকায় আসলেন তখন কতগুলি সভার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কায়েম থাকে। প্রথম সভার জায়গা ঠিক হল টাঙ্গাইল। স্টিমারে মানিকগঞ্জ হয়ে যেতে হবে, পথে আরও একটা সভা হবে। শামসুল হক সাহেব সভার বন্দোবস্ত করেছিলেন। শহীদ সাহেব প্লেন থেকে ঢাকায় নেমে সোজা বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ ছিলেন, তাঁর বাড়িতে আসলেন। সেখানেই দুপুরবেলা খেলেন। সন্ধ্যায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়বে। মওলানা ভাসানী ও আমি সাথে যাব। আমরা শহীদ সাহেবকে নিয়ে জাহাজে উঠলাম। মওলানা সাহেবও উঠেছিলেন। জাহাজ ছয়টায় ছাড়বার কথা, ছাড়ছে না। খবর নিয়ে জানলাম, সরকার হুকুম দিয়েছে না ছাড়তে। প্রায় দুই ঘণ্টা জাহাজ ঘাটে বসে রইল। কাদের সর্দার, জনাব কামরুদ্দিন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। রাত আটটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিআইজি পুলিশ শহীদ সাহেবের হাতে একটা কাগজ দিলেন, তাতে লেখা, ‘তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে পারবেন না।’ তবে যদি কলকাতা ফিরে যান, সরকারের আপত্তি নাই। তিনি ঢাকায় যে কোনো জায়গায় থাকতে পারেন তাতেও আপত্তি নাই। শহীদ সাহেব জাহাজ ছেড়ে নেমে আসলেন, আমিও তার মালপত্র নিয়ে সাথে সাথে এলাম। কোথায় থাকবেন? আর কেইবা জায়গা দেবেন? কোন হোটেলও নাই। বেগম আনোয়ারার সাহস আছে, কিন্তু তাঁদের বাড়িটায় জায়গা নাই। আতাউর রহমান, কামরুদ্দিন সাহেবের বাড়িরও সেই অবস্থা। কামরুদ্দিন সাহেব ক্যাপ্টেন শাহজাহান ও তাঁর স্ত্রী বেগম নূরজাহানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন, কারণ তাঁদের বাড়িটা সুন্দর এবং থাকার মত ব্যবস্থাও আছে। বেগম নূরজাহান (এখন প্রফেসর) বললেন, “এ তো আমাদের সৌভাগ্য। শহীদ সাহেবকে আমি বাবার মত ভক্তি করি। আমাদের বাড়িতেই থাকবেন তিনি, নিয়ে আসুন।” সেইদিন এই উপকার বেগম নূরজাহান না করলে সত্যিই দুঃখের কারণ হত। পাকিস্তান সত্যিকারের যিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেই লোকের থাকার জায়গা হল না। দুই দিন শহীদ সাহেব ছিলেন তার বাসায়, কি সেবাই না ভদ্রমহিলা করেছিলেন, তা প্রকাশ করা কষ্টকর। মেয়েও বোধহয় বাবাকে এত সেবা করতে পারে না। ক্যাপ্টেন শাহজাহানও যথেষ্ট করেছেন। দুই দিন পরে শহীদ সাহেবকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে জাহাজে তুলে দিলাম। আমি সাথে যেতে চেয়েছিলাম এগিয়ে দিতে। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, “দরকার নাই। আর লোকজনও আহে আমার অসুবিধা হবে না।” আমি বিছানা করে সকল কিছু গুছিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে গেলে বললেন, “তোমার উপরও অত্যাচার আসছে। এরা পাগল হয়ে গেছে। শাসন যদি এইভাবে চলে বলা যায় না, কি হবে!” আমি বললাম, “স্যার, চিন্তা করবেন না, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। আর সে শিক্ষা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি।” (পৃষ্ঠা-১০৮, ১০৯)

(১৯৪৮ সাল) কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? আর একজন ঢাকার পুরানা লীগকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান সহযোগিতা করছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থবল ও জনবল দুইই ছিল। এডভোকেট আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান এবং আনোয়ারা খাতুন এমএলএ সহযোগিতা করছিলেন। আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, “আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।

কিছুদিন পূর্বে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব ‘গণআজাদী লীগ’ নাম দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন, কিন্তু তা কাগজপত্রেই শেষ। যা হোক, কোথায়ও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। শুধু কর্মীরা না, অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আল্লামা মওলানা রাগীব আহসান, এমএলএদের ভিতর থেকে জনাব খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান ও হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া এবং বিভিন্ন জেলার অনেক প্রবীণ নেতাও যোগদান করেছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির আদেশ এল। বাইরে থেকে আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। বাহাউদ্দিন আমাকে চুপি চুপি বলে, “মুজিব ভাই, পূর্বে মুক্তি পেলে একটা মালাও কেউ দিত না, আপনার সাথে মুক্তি পাচ্ছি, একটা মালা তো পাব।” আমি হেসে দিয়ে বললাম, “আর কেউ না দিলে তোমাকে আমি মালা পরিয়ে দিতাম।” জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত। তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেও সালাম করলাম। সাথে সাথে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল। জেলগেটে এই প্রথম ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হল। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, “হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়।” হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, “চল, এবার শুরু করা যাক।” পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়। (পৃষ্ঠা-১২০, ১২১)

আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব তাতে যোগদান করেছিলেন। একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হল। আমরা কাজ করা শুরু করলাম। শওকত মিয়া বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিল। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পূর্বে একটা জনসভা আওয়ামী লীগ আরমানিটোলা ময়দানে ডেকেছিল। মওলানা ভাসানী সেই প্রথম ঢাকায় বক্তৃতা করবেন। শামসুল হক সাহেবকে ঢাকার জনগণ জানত। তিনি বক্তৃতাও ভাল করতেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ যাতে জনসভা না করতে পারে সে জন্য মুসলিম লীগ গু-ামির আশ্রয় গ্রহণ করে। যথেষ্ট জনসমাগম হয়েছিল, সভা যখন আরম্ভ হবে ঠিক সেই মুহূর্তে একদল ভাড়াটিয়া লোক মাইক্রোফোন নষ্ট করে দিয়েছিল এবং প্যান্ডেল ভেঙে ফেলেছিল। অনেক কর্মীকে মারপিটও করেছিল। ঢাকার নামকরা ভীষণ প্রকৃতির লোক বড় বাদশা বাবুবাজারে (বাদামতলী ঘাট) থাকে। বড় বাদশার লোকবল ছিল, তার নামে দোহাই দিয়ে ফিরত এই সমস্ত এলাকায়। তাকে বোঝান হয়েছিল, আওয়ামী লীগ যারা করেছে এবং আওয়ামী লীগের সভা করছে তারা সবাই ‘পাকিস্তান ধ্বংস করতে চায়’- এদের সভা করতে দেওয়া চলবে না। বাদশা মিয়াকে লোকজন জোগাড় করে সভা ভাঙবার জন্য পাঁচশত টাকা দেওয়া হয়েছিল।

বাদশা মিয়া খুব ভাল বংশের থেকে এসেছে, কিন্তু দলে পড়ে এবং ঢাকার হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় শরিক হয়ে খারাপ রাস্তায় চলে গিয়েছিল। দাঙ্গা করে অনেক মামলার আসামিও হয়েছিল। সভায় গোলমাল করে সে চলে গেলে ঐ মহল্লার বাসিন্দা জনাব আরিফুর রহমান চৌধুরী তার কাছে গিয়ে বললেন, “বাদশা মিয়া, আমাদের সভা একবার ভেঙে দিয়েছেন। আমরা আবার সব কিছু ঠিক করে সভা আরম্ভ করছি। আপনি আমাদের কথা প্রথমে শুনুন, যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলি বা দেশের বিরুদ্ধে বলি তারপরে সভা ভাঙতে পারবেন।” চৌধুরী সাহেবের ব্যবহার ছিল অমায়িক। খেলাফত আন্দোলন থেকে রাজনীতি করছেন। দেশের রাজনীতি করতে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বরিশালের উলানিয়ার জমিদারি বংশে। বাদশা মিয়া তার দলবল নিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সভার বক্তৃতা শুনতে লাগল। কয়েকজন বক্তৃতা করার পরে বাদশা মিয়া প্লাটফর্মের কাছে এসে বলল, “আমার কথা আছে, আমাকে বলতে দিতে হবে।”কে তাকে বাধা দেয়, বলতে গেলে আরমানিটোলা ময়দান তার রাজত্বের মধ্যে। বাদশা মিয়া মাইকের কাছে যেয়ে বলল, “আমাকে মুসলিম লীগ নেতারা ভুল বুঝিয়েছিল আপনাদের বিরুদ্ধে। আপনাদের সভা ভাঙতে আমাকে পাঁচশত টাকা দিয়েছিল, এ টাকা এখনও আমার পকেটে আছে। আমার পক্ষে এ টাকা গ্রহণ করা হারাম। আমি এ টাকা আপনাদের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।” এ কথা বলে টাকাগুলি (পাঁচ টাকার নোট) ছুঁড়ে দিল। সভার মধ্যে টাকাগুলি উড়তে লাগল। অনেকে কুড়িয়ে নিল এবং অনেক ছিঁড়ে ফেলল। বাদশা মিয়া আরও বলল, “আজ থেকে আমি আওয়ামী লীগের সভ্য হলাম, দেখি আরমানিটোলায় কে আপনাদের সভা ভাঙতে পারে?” জনসাধারণ ফুলের মালা বাদশা মিয়ার গলায় পরিয়ে দিল। জনগণের মধ্যে এক নতুন আলোড়নের সৃষ্টি হল। মুসলিম লীগ গু-ামির প্রশ্রয় নিয়েছিল একথা ফাঁস হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগের সভা ভাঙতে টাকাও দিয়েছিল একথাও জনগণ জানতে পারল। যদিও এতে তাদের লজ্জা হয় নাই। এই গু-ামির পথ অনেক দিন তারা অনুসরণ করেছে যে পর্যন্ত না আমরা বাধ্য করতে পেরেছি তাদের তা বন্ধ করতে। তারা ঠিক করেছিল, বিরুদ্ধ দল গঠন করতে দেওয়া হবে না। তারা যে জনসমর্থন হারাচ্ছে, কেন তার সংশোধন না করে তারা বিরুদ্ধ দলের উপর নির্যাতন শুরু করল এবং গু-ামির আশ্রয় নিল? (পৃষ্ঠা-১২১, ১২২)

আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম এবং আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভা ডাকলাম। কারণ তখন খাদ্য পরিস্থিতি খুবই খারাপ। লোকের দুরবস্থার সীমা নাই। মওলানা সাহেব সভাপতিত্ব করলেন। আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব ও আমি বক্তৃতা করলাম। মুসলিম লীগ চেষ্টা করেছিল গোলমাল সৃষ্টি করতে। বাদশা মিয়া আমাদের দলে চলে আসায় এবং জনগণের সমর্থন থাকায় তারা সাহস পেল না। এতবড় সভা এর পূর্বে আর হয় নাই। বিরাট জনসমাগম হয়েছে। জনসাধারণ ও ঢাকার লোকের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। আর আমরা যারা বক্তৃতা করলাম সকলেই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের ‘রাষ্ট্রের দুশমন’ বললে জনগণ মানতে রাজি ছিল না। কারণ আমরাই প্রথম কাতারের কর্মী ছিলাম। (পৃষ্ঠা-১২৮, ১২৯)

মওলানা ভাসানী এই সভায় ঘোষণা করলেন, “জনাব লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসছেন অক্টোবর মাসে, আমরা তার সাথে খাদ্য সমস্যা ও রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যদি তিনি দেখা না করেন আমাদের সাথে, তাহলে আমরা আবার সভা করব এবং শোভাযাত্রা করে তার কাছে যাব।” কয়েকদিন পরেই আমরা কাগজে দেখলাম, লিয়াকত আলী খান ১১ই অক্টোবর ঢাকায় আসবেন। মওলানা সাহেব আমাকে টেলিগ্রাম করতে বললেন, যাতে তিনি ঢাকায় এসে আমাদের একটা ডেপুটেশনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মওলানা সাহেবের নামেই টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছিল। জনাব শামসুল হক সাহেব একটু ব্যস্ত ছিলেন, কারণ তার বিবাহের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমাকেই পার্টির সমস্ত কাজ দেখতে হত। যদিও তার সাথে পরামর্শ করেই করতাম। তিনি আমাকে বললেন, “প্রতিষ্ঠানের কাজ তুমি চালিয়ে যাও।” এই সময় একজনের অবদান অস্বীকার করলে অন্যায় করা হবে। বেগম আনোয়ারা খাতুন এমএলএ প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট কাজ করতেন। দরকার হলে টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতেন। আতাউর রহমান সাহেবকে ডাকলেই পাওয়া যেত। তিনি পূর্বে রাজনীতি করেন নাই এবং রাজনৈতিক জ্ঞানও তত ছিল না। লেখাপড়া জানতেন, কাজ করার আগ্রহ এবং আন্তরিকতা ছিল। জেলায় জেলায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থকরা আওয়ামী লীগে যোগদান করতে শুরু করল। এই সময় কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কলকাতা ত্যাগ করে করাচি চলে গিয়েছেন। মানিক ভাই ঢাকা এসে পৌঁছেছেন প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। তিনিও এসে মোগলটুলীতে উঠেছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সামান্য কিছু কাপড় ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসতে পারেন নাই। ভারত সরকার তাঁর সর্বস্ব ক্রোক করে রেখেছে। অনেকে শুনে আশ্চর্য হবেন, শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি, ভাড়া করা বাড়ি। তিনি করাচিতে তার ভাইয়ের কাছে উঠলেন, কারণ তাঁর খাবার পয়সাও ছিল না। (পৃষ্ঠা-১২৯)

তবে আবদুল কাদের সর্দার আমাদের অর্থ দিয়েও সাহায্য করছিলেন। তাঁর অর্থবল ও জনবল দুইই ছিল। ঢাকার খাজা বংশের সাথে জীবনভর মোকাবেলা করেছেন। গরিবদের সাহায় করতেন, তাই জনসাধারণ তাকে ভালবাসত। আমরা এখনও জেলা কমিটিগুলি গঠন করতে পারি নাই। তবে দু’একটা জেলায় কমিটি হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ভিতরেই আমরা সমস্ত জেলায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব ঠিক করেছি। ছুটি থাকলেই আমরা সমস্ত জেলায় বের হব। সাড়া যা পাচ্ছি তাতে আমাদের মধ্যে একটা নতুন মনোবলের সৃষ্টি হয়েছিল।

নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান মওলানা সাহেবের টেলিগ্রামের উত্তর দেওয়ারও দরকার মনে করলেন না। আমরা জানতে পারলাম তিনি ১১ই অক্টোবর ঢাকায় আসবেন। তিনি প্রেস রিপোর্টারদের কাছে বললেন, “আওয়ামী লীগ কি তিনি জানেন না।”

আমরা ১১ই অক্টোবর (১৯৪৯ সাল) আরমানিটোলা ময়দানে সভা আহ্বান করলাম। আমাদের একটা মাইক্রোফোন ছিল, যখন আমাদের কর্মীরা সভার প্রচার করছিল ঘোড়ার গাড়ি করে নবাবপুর রাস্তায়, তখন বেলা তিনটা কি চারটা হবে, একদল মুসলিম লীগ কর্মীÑ গু-াও বলতে পারা যায়, আমাদের কর্মীদের মেরে মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়ে যায়। একটা ঘোড়ার গাড়িতে মাত্র তিনজন কর্মী ছিল। কোন আইনশৃঙ্খলা দেশে নাই বলে মনে হচ্ছিল। কর্মীরা এসে আমাকে খবর দিল মোগলটুলী আওয়ামী লীগ অফিসে। আমি আট-দশজন কর্মী নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমাদের কর্মীরা কয়েকজনের মুখ চিনতে পেরেছে, কারণ পূর্বে একসাথেই কাজ করেছে। আমি বললাম, “এ তো বড় অন্যায়। চল, আমি এদের কাছে জিজ্ঞাসা করে আসি আর অনুরোধ করি মাইক্রোফোনটা ফেরত দিতে। যদি দেয় ভাল, না দেয় কি করা যাবে! থানায় একটা এজাহার করে রাখা যাবে।” আমার সাথে ছাত্রলীগের নূরুল ইসলাম, আর চকবাজারের নাজির মিয়া এবং আবদুল হালিম আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ওদের অফিসে রওয়ানা হলাম। কারণ, আমি খবর নিলাম ওরা ওখানেই আছে। কো-অপারেটিভ ব্যাংকের উপর তলায়ই তারা ওঠাবসা করে। আমি সেখানে পৌঁছে দেখলাম, ওদের কয়েকজন দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। আমি ইব্রাহিম ও আলাউদ্দিনকে চিনতাম, তারাও মুসলিম লীগের কর্মী ছিল আমাদের সাথে। বললাম, “আমাদের মাইক্রোফোনটা নিয়েছ কেন? এ তো বড় অন্যায় কথা! মাইক্রোফোনটা দিয়ে দাও।” আমাকে বলল, “আমরা নেই নাই, কে নিয়েছে জানি না। নূরুল ইসলামের কাছ থেকেই কেড়ে নেবার সময় এরা উপস্থিত ছিল। নূরুল ইসলাম বলল, “আপনি তো দাঁড়ান ছিলেন, তখন কথা কাটাকাটি চলছিল।”

এই সময় ইয়ার মোহাম্মদ খান, হাফিজুদ্দিন নামে আরেকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে নিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। আমি ইয়ার মোহাম্মদ সাহেবকে ডাক দিলাম এবং বললাম ঘটনাটা। ইয়ার মোহাম্মদ খান সাহেব ঢাকার পুরানা লোক। বংশমর্যাদা, অর্থ বল, লোকবল সকল কিছুই তাঁর আছে। তিনি বললেন, “কেন তোমরা মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়েছ, এটা কি মগের মুল্লুক।” এর মধ্যে একজন বলে বসল, “নিয়েছি তো কি হয়েছে?” ইয়ার মোহাম্মদ হাত উঠিয়ে ওর মুখে এক চড় মেরে দিলেন। হালিমও এক ঘুষি মেরে দিল। পিছনে ওদের অনেক লোক লুকিয়ে ছিল, তারা আমাদের আক্রমণ করল। হালিম ওদের কাছ থেকে ছুটে ওর মহল্লার দিকে দৌড় দিল লোক আনতে। প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরীর মালিক হুমায়ুন সাহেব বের হয়ে ইয়ার মোহাম্মদ খানকে তার লাইব্রেরীর ভিতরে নিয়ে গেলেন। এরা বাইরে বসে গালাগালি শুরু করল। আমিও রিকশা নিয়ে ছুটলাম আওয়ামী লীগ অফিসে, সেখানেও আমাদের দশ-বারজন কর্মী আছে। ওরা ঠিক পায় নাইÑ আমি যখন চলে আসি, না হলে আমাকেও আক্রমণ করত। হাফিজুদ্দিন রিকশা নিয়ে ইয়ার মোহাম্মদ খান সাহেবের মহল্লায় খবর দিল। সাথে সাথে তার ভাই, আত্মীয়স্বজন মহল্লার লোক যে যে অবস্থায় ছিল এসে হাজির হল। ভিক্টোরিয়া পার্কে হালিমও তার মহল্লা থেকে লোক নিয়ে হাজির হল। যারা এতক্ষণ ইয়ার মোহাম্মদ খানকে গালাগালি করছিল কে কোথা দিয়ে পালাল খুঁজে পাওয়া গেল না।

খাজা বাড়ির অনেক লোক এদের সাথে ছিল। একজন মন্ত্রীও উপরের তলায় বসে সব কিছু দেখছিলেন, তাঁর দলের কীর্তিকলাপ। আমি এসে দেখলাম, পুলিশ এসে গেছে। ইয়ার মোহাম্মদকে নিয়ে এরা শোভাযাত্রা করে মহল্লায় যেয়ে মুসলিম লীগ অফিস আক্রমণ করল। কারণ লীগ অফিস রায় সাহেবের বাজারেই ছিল। কয়েকজন গু-া প্রকৃতির লোক এই মহল্লায় ছিল। গু-ামি করত, ছাত্রদের মারত টাকা খেয়ে। তাদের ধরে নিয়ে মহল্লায় বিচার বসল। ঢাকার মহল্লার বিচার ছিল, মসজিদে নিয়ে হাজির করত এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে মারা হত-এটিই হল এদের কোর্টকাচারী। রায় সাহেবের বাজার দিয়ে কোন ছাত্র শোভাযাত্রা বা আমাদের কর্মীদের দেখলে আক্রমণ এবং মারপিট করা হত। অনেক কর্মী ও ছাত্রকে মার খেতে হয়েছে। এই দিনের পর থেকে আর কোনোদিন এই এলাকায় কেউ আমাদের মারপিট করতে সাহস পায় নাই। (পৃষ্ঠা-১৩০, ১৩১)

ইয়ার মোহাম্মদ খানও এরপর থেকে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন। তাতে আমাদের শক্তিও ঢাকা শহরে বেড়ে গেল। আমিও মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে একদল যুবক কর্মী সৃষ্টি করলাম। এই সময় সমসাবাদ ও বংশালের একদল যুবক কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করল। সমসাবাদও আরমানিটোলা ময়দানের পাশেই ছিল। আরমানিটোলার সভার বন্দোবস্ত এখন এরাই করতে শুরু করে। ফলে মুসলিম লীগ শত চেষ্টা করেও আর গোলমাল সৃষ্টি করতে পারছিল না আমাদের সভায়।

১১ই অক্টোবর (১৯৪৯ সাল) আরমানিটোলায় বিরাট সভা হল। সমস্ত ময়দান ও আশপাশের রাস্তা লোকে ভরে গেল। শামসুল হক সাহেব বক্তৃতা করার পর আমি বক্তৃতা করলাম। মওলানা পূর্বেই বক্তৃতা করেছেন। আমি শেষ বক্তা। সভায় গোলমাল হবার ভয় ছিল বলে ভাসানী সাহেব প্রথমে বক্তৃতা করেছেন। ভাসানী সাহেব আমাকে বললেন, শোভাযাত্রা করতে হয় সেইভাবে বক্তৃতা কর। আমি বক্তৃতা করতে উঠে যা বলার বলে জনগণকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম, “যদি কোন লোককে কেউ হত্যা করে, তার বিচার কি হবে?” জনগণ উত্তর দিল, “ফাঁসি হবে।” আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “যারা হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর কারণ, তাদের কি হবে?” জনগণ উত্তর দিল, “তাদেরও ফাঁসি হওয়া উচিত।” আমি বললাম, “না, তাদের গুলি করে হত্যা করা উচিত।” কথাগুলি আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। তারপর বক্তৃতা শেষ করে বললাম, “চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্ব বাংলার লোক কি চায়!”

শোভাযাত্রা বের হল। মওলানা সাহেব, হক সাহেব ও আমি সামনে চলেছি। যখন নবাবপুর রেলক্রসিংয়ে উপস্থিত হলাম, তখন দেখলাম পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বন্দুক উঁচা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আইন ভাঙবার কোনো প্রোগ্রাম করি নাই। আর পুলিশের সাথে গোলমাল করারও আমাদের ইচ্ছা নাই। আমরা রেল স্টেশনের দিকে মোড় নিলাম শোভাযাত্রা নিয়ে। আমাদের প্ল্যান হল নাজিরাবাজার রেললাইন পার হয়ে নিমতলিতে ঢাকা মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে আবার আরমানিটোলা ফিরে আসব। নাজিরাবাজারে এসেও দেখি পুলিশ রাস্তা আটক করেছে, আমাদের যেতে দেবে না। তখন নামাজের সময় হয়ে গেছে। মওলানা সাহেব রাস্তার উপরই নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। শামসুল হক সাহেবও সাথে সাথে দাঁড়ালেন। এর মধ্যেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। আর জনসাধারণও ইট ছুঁড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচ মিনিট এইভাবে চলল। পুলিশ লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসছে। একদল কর্মী মওলানা সাহেবকে কোলে করে নিয়ে এক হোটেলের ভিতরে রাখল। কয়েকজন কর্মী ভীষণভাবে আহত হল এবং গ্রেফতার হল। শামসুল হক সাহেবকেও গ্রেফতার করল। আমার উপরও অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুশ হয়ে একপাশের নর্দমায় পড়ে গেলাম। কাজী গোলাম মাহাবুবও আহত হয়েছিল, তবে ওর হুঁশ ছিল। আমাকে কয়েকজন লোক ধরে রিকশায় উঠিয়ে মোগলটুলী নিয়ে আসল। আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। কেউ বলে, গুলি লেগেছে, কেউ বলে গ্যাসের ডাইরেক্ট আঘাত, কেউ বলে কেটে গেছে পড়ে যেয়ে। ডাক্তার এল, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করল। ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল, কারণ বেদনায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। প্রায় ত্রিশজন লোক গ্রেফতার হয়েছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল হক বিএসসি, আবদুর রব ও রসুল নামে আরেকজন কর্মী মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিল। তারাও গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিল। আমার আত্মীয়, ফরিদপুরের দত্তপাড়ার জমিদার বংশের সাইফুদ্দিন চৌধুরী ওরফে সূর্য মিয়া আমার কাছেই ছিল এবং আমাকে খুব সেবা করল। সে রাত দুইটা পর্যন্ত জেগে ছিল। এমন সময় মোগলটুলীর আমাদের অফিস, যেখানে আমি আছি, পুলিশ ঘিরে ফেলল এবং দরজা খুলতে বলছিল। লোহার দরজা, ভিতরে তালাÑ খোলা ও ভাঙা এত সহজ ছিল না। সাইফুদ্দিন চৌধুরী আমাকে, কাজী গোলাম মাহাবুব ও মফিজকে ডেকে উঠাল এবং বলল, “পুলিশ এসেছে তোমাদের গ্রেফতার করতে।”

আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, ইনজেকশন নিয়ে, তখন ভাসানী সাহেব খবর দিয়েছিলেন, আমি যেন গ্রেফতার না হই। আমার শরীরে ভীষণ বেদনা, জ্বর উঠেছে, নড়তে পারছি না। কি করি, তবুও উঠতে হল এবং কি করে ভাগব তাই ভাবছিলাম। শওকত মিয়া আগেই সরে গেছে। রাস্তাঘাট তারই জানা। তিনতলায় আমরা থাকি, পাশেই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তিনতলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে পড়তে হবে। দুই দালানের ভিতরে ফারাকও আছে। নিচে পড়লে শেষ হয়ে যাব। তবুও লাফ দিয়ে পড়লাম। কাজী গোলাম মাহাবুব ও মফিজও আমাকে অনুসরণ করল। সাইফুদ্দিন রাজনীতি করে না, তাকে কেউ চিনে না। সে একলাই থাকল। আমরা যখন ছাদ থেকে নামছি তখন পাশের বাড়ির সিঁড়ির উপর একটা বালতি ছিল। পায়ে লেগে সেটা নিচে পড়ে গেল। আর বাড়িওয়ালা চিৎকার করে উঠল। আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পুলিশ দরজা ভাঙতে ব্যস্ত, এদিকে নজর নাই। আমরা বস্তি পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ব এমন সময় পুলিশও দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছে। আমাদের মৌলভীবাজারের ভিতর ঢুকতে হবে। তিনজন পুলিশ এই রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল। একবার তিনজন হেঁটে এপাশে আসে, আবার অন্যদিকে যায়। আমরা যখন দেখলাম, তিনজন হেঁটে সামনে অগ্রসর হচ্ছে তখন পিছন থেকে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। ওরা বুঝতে পারল না। মৌলভীবাজার পার হয়ে আমরা এগিয়ে এসে এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। রাতটা সেখানেই কাটালাম। ভোরে ওদের দুইজনকে বিদায় দিলাম। কারণ, ওদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নাই। সামনে পেলে গ্রেফতার করতে পারে। আমি আবদুল মালেক সর্দারের মাহুতটুলির বাড়িতে রইলাম। সেখান থেকে আমি পরের দিন সকালে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। তার স্ত্রী বেগম নূরজাহান আমাকে ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। তিনি রাজনীতি করতেন না। আমি আহত ও অসুস্থ, কোথায় যাই- আর কেইবা জায়গা দেয় তখন ঢাকায়! ভদ্রমহিলা আমার যথেষ্ট সেবা করলেন, ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ আনালেন।

দুই দিন ওখানে ছিলাম। আইবির লোকেরা সন্দেহ করল, আমি এ বাড়িতে থাকতে পারি, কারণ প্রায়ই আমি এ বাড়িতে বেড়াতে আসতাম। দুইজন আইবি অফিসার এদের। এখানে এসেছে রাত আটটায়। ঠিক এই সময় একজন কর্মী সেখানে উপস্থিত হয়ে বেগম নূরজাহানকে জিজ্ঞাসা করতে যাবে আমি কোথায়-আইবি অফিসারদের দেখে তার মুখের ভাব এমন হয়ে গেল যে, তাদের আর বুঝতে বাকি রইল না, আমি কোথায় আছি! আমি কিন্তু পাশের ঘরেই শুয়ে আছি আর এদের আলাপ শুনছি। বেগম নূরজাহান খুবই চালাক ও বিচক্ষণ। তিনি ওদের চা খেতে দিয়ে আমাকে ডেকে দোতলা থেকে নিচে নিয়ে গেলেন এবং বললেন অবস্থাটা। আমি বললাম, “একটা চাদর দেন।” কারণ, আমার একটা পাঞ্জাবি। ও লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ভাগ্য ভাল, ভদ্রমহিলা নিজেই দিনে এই দুইটাকে ধুয়ে দিয়েছিলেন। চাদর এনে আমাকে নিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। আমি বেরিয়ে আসলাম। আইবিরা তখনও বাড়িতেই বসে আছে। এই অফিসারদের দুইজন গার্ডও বাইরে পাহারা দিচ্ছিল, আমি বুঝতে পারলাম। তাদের চোখকেও আমার ফাঁকি দিতে হল। (পৃষ্ঠা-১৩১, ১৩২, ১৩৩, ১৩৪)

(১৯৫০ সাল) আমরা মুন্সিগঞ্জে নেমে মীরকাদিম হেঁটে আসলাম। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার একটু পূর্বে নৌকায় নারায়ণগঞ্জ রওয়ানা করলাম। সন্ধ্যার পরে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে রিকশা নিয়ে সোজা খান সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালাম। জোহা সাহেব খবর পায় নাই, তার ছোট ভাই মোস্তফা সরোয়ার তখন স্কুলের ছাত্র। আমাকে জানত। তাড়াতাড়ি জোহা সাহেবকে খবর দিয়ে আনল। আমরা ভিতরের রুমে বসে বসে চা-নাশতা খেলাম। খান সাহেবের বাড়ি ছিল আমাদের আস্তানা। ক্লান্ত হয়ে এখানে গেলেই যে কোনো কর্মীর খাবার ও থাকার ব্যবস্থা হত। ভদ্রলোকের ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু প্রাণটা ছিল অনেক বড়। জোহা সাহেব এসেই ট্যাক্সি ভাড়া করে আনল, আমাদের তুলে দিল। শওকত মিয়ার জন্য একটু দেরিও করেছিলাম। আমরা ঢাকায় রওয়ানা করার কয়েক মিনিট পরে শওকত মিয়াও নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছাল এবং আমাদের চলে যাবার খবর পেয়ে আবার ঢাকায় ছুটল। আমরা পথে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে রিকশা নিয়ে মোগলটুলী পৌঁছালাম। দেখি আমাদের মালপত্র পৌঁছে গেছে। শওকত মিয়াও এসে পৌঁছে গেছে। শওকত মিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মুজিব ভাই, কি করে লাহোরে পৌঁছালেন, আর কি করে ফিরে এলেন, বলুন শুনি।” আমি বললাম, “প্রথমে বলেন, মওলানা সাহেব ও হক সাহেব কেমন আছেন? কে কে জেলে আছে। আওয়ামী লীগের খবর কি?” শওকত মিয়া যা বলল তাতে দুঃখই পেলাম, কিন্তু অখুশি হলাম না।

আওয়ামী লীগে যে ভদ্রলোকদের মওলানা সাহেব কার্যকরী কমিটির সভ্য করেছি। তাদের মধ্য থেকে প্রায় বার-তেরজন পদত্যাগ করেছেন ভয় পেয়ে। যাঁরা অনেক দিন পুরানা নেতা ছিলেন, তাঁরা শুধু পদত্যাগই করেন নাই, বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করেছেন যাতে গ্রেফতার না হতে হয়। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব সদস্য হওয়ার পরপরই একদিন মওলানা সাহেবও আমাদের সাথে আলাপ করলেন এবং বললেন, “আমি আর্থিক অসুবিধায় আছি। এডভোকেট জেনারেলের চাকরিটা নিচ্ছি। আমার পক্ষে রাজনীতি সক্রিয় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আপাতত আমি সদস্য থাকব না। তবে আমার দোয়া ও সমর্থন রইল।” আমরা তাঁর অসুবিধা বুঝতে পারলাম। তিনি কষ্ট করে সভায়ও একদিন এসেছিলেন। এই সময় দেখা গেল আওয়ামী লীগে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আলী আহমদ খান এমএলএ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান, নারায়ণগঞ্জের আবদুল আউয়াল, আলমাস আলী ও শামসুজ্জোহা এবং আমি ও আরও কয়েকজন রইলাম, যাদের নাম আমি মনে করতে পারছি না।

শওকত মিয়া আমার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছে। রাতে সেখানে কাটালাম। দিনে ঘরে থাকি, রাতে সকলের সাথে দেখা করি। কি করা যায় সেই সম্বন্ধে পরামর্শ করি। মানিক ভাই মোগলটুলীতেই আছেন, কি করবেন, ঠিক করতে পারছেন না। আবদুল হালিমও আমাকে কয়েকদিন রাখল ওর বাড়িতে। কয়েকজন ভদ্রলোক ওয়াদা করেছিলেন কিছু টাকা বন্দোবস্ত করে দিবেন। একদিন রাতে হঠাৎ আমার এক বন্ধু বড় সরকারি কর্মচারীর বাড়িতে পৌঁছালাম, আমাকে দেখে তো অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। তিনি আমাদের অবস্থা জানতেন, তাঁর সহানুভূতিও ছিল আমাদের উপরে। তাড়াতাড়ি চলে এলাম, এভাবে পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছা হল না, আর ভালও লাগছিল না। আমি আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিনকে বললাম, তোমাদের কাছেই থাকব। তারা তখন আলী আমজাদ খান সাহেবের পুরানা বাড়ি খাজে দেওয়ানে নিচের তলায় থাকত। আমি চলে আসলাম ওদের কাছে। দিনভর বই পড়তাম, রাতে ঘুরে বেড়াতাম। ঠিক হল, আরমানিটোলা ময়দানে একটা সভা ডাকা হবে। আমি সেখানে বক্তৃতা করব এবং গ্রেফতার হব। যখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, দু’একদিনের মধ্যে সভা ডাকা হবে, দুপুরবেলা বসে আছি, দেখি পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছে। দুইজন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সাদা পোশাক পরে ভিতরে আসছেন। আমি যে ঘরে থাকি, সেই ঘরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। আমি বললাম, ভিতরে আসুন। তারা ভিতরে আসলে বললাম, “কয়েকদিন পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষায় আছি। বসুন, কিছু খেয়ে নিতে হবে। এখন বেলা দুইটা, কিছুই খাই নাই। খাবার আনতে গেছে।”

হামিদ খাবার আনতে গিয়েছিল হোটেল থেকে, পুলিশ দেখে খাবার নিয়ে ভেগে গেছে। ভদ্রলোকেরা কতক্ষণ দেরি করবে? হামিদ যখন আর আসছে না, জালালও বাইরে গেছে, কখন ফিরবে ঠিক নাই তাই আলী আমজাদ খান সাহেবের বড় ছেলে হেনরীকে খবর দিলাম। হেনরী ছুটে এসেছে। আমি যে কিছুই খাই নাই, একথা শুনে বাড়িতে যেয়ে খাবার নিয়ে আসল। কিছু খেয়ে নিলাম। হেনরীর ছোট ভাই শাহজাহান, বোধহয় সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, সেও এসেছে এবং তার মামুকে গালাগালি করতে শুরু করেছে। তার মামা এই বাড়ির দোতলায় থাকত। শাহজাহান বলতে লাগল, “আর কেউ পুলিশকে খবর দেয় নাই, মামাই দিয়েছে। বাবা বাড়িতে আসুক ওকে মজা দেখাব।” শাহজাহান আমাকে খুব ভালবাসত, সময় পেলেই আমার কাছে ছুটে আসত। আমি যখন পুলিশের গাড়িতে উঠে চলে যাই, শাহজাহান কেঁদে দিয়েছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। শাজাহানের ঐ কান্নার কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই। পরে খবর পেয়েছিলাম, ওর মামাই টাকার লোভে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিল। আলী আমজাদ সাহেব ও আনোয়ারা বেগম ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আমাকে লালবাগ থানায় নিয়ে আসল। দুইজন আইবি অফিসার আমাকে ইন্টারোগেশন করতে শুরু করল। প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সে পর্ব চলল। আমি বললাম, “আওয়ামী লীগ করব। আমি লাহোর গিয়েছিলাম কি না? কোথায় ছিলাম? কি কি করেছি? ঢাকায় কবে এসেছি? বাড়িতে কতদিন ছিলাম? ভবিষ্যতে কি করব? সোহরাওয়ার্দী সাহেব কি কি বলেছেন? এইসব প্রশ্নে যে কথা বলার সেইটুকু বললাম, যা বলবার চাই না সে কথার উত্তর দিলাম না। আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখাল এবং সন্ধ্যার পরে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। রাতে আমাকে থানায় রাখল। জালাল আমার সুটকেস ও বিছানা থানায় পৌঁছে দিল। সন্ধ্যার পরে আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, আতাউর রহমান খান সাহেব, আমার বিয়াই দত্তপাড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী এমএলএ আমাকে দেখতে থানায় এসেছিলেন। রাতে জনাব সিদ্দিক দেওয়ান, বোধহয় তখন ইন্সপেক্টর ছিলেন, বাড়ির থেকে বিছানা, মশারি এনে দিলেন। আমার বিছানাও এসে গিয়েছিল, কোনো অসুবিধা হয় নাই। তিনি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মচারী আমার সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন, যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তার দিকে সকলেই নজর দিয়েছিলেন। (পৃষ্ঠা-১৬৫, ১৬৬, ১৬৭)”

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত