টিপ কান্ডের জড়িত পুলিশের সাথে ছিল বাজারের ব্যাগ, স্ত্রী নয়

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৫ এপ্রিল ২০২২, ২২:৪৮ |  আপডেট  : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০:১৮

টিপ পরা নিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দারকে হেনস্তার ঘটনা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ভুক্তভোগীর অভিযোগের পর দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশও। শিক্ষিকার দেওয়া মোটরসাইকেলের নম্বর ধরে পুলিশ অভিযুক্তকে খুঁজে বের করেছে। নাজমুল তারেক নামের ওই কনস্টেবল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের [ডিএমপি] প্রটেকশন বিভাগে কর্মরত। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে এ ঘটনা তদন্তে এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে কমিটিও।

ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তারেকের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে। দুই বছর আগেও তার জীবনাচরণ ভিন্ন ছিল। তিনি গান-বাজনায় মেতে থাকতেন। তবে সম্প্রতি তিনি মুখে বড় দাড়ি রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। অনুমতি নিয়ে বড় দাড়ি রাখেন। এছাড়া সাময়িক বরখাস্ত এ কনস্টেবল চাকরিজীবনে বেপরোয়া আচরণের জন্য তিনবার শাস্তির মুখে পড়েছেন। যার মধ্যে দুবার গুরুদণ্ড এবং একবার লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ [ডিএমপি]। এবার তার গুরুদণ্ড হলে আগামী পাঁচ-ছয় বছর পদোন্নতি হবে না। একই সঙ্গে বেতন কর্তন এবং ইনক্রিমেন্ট আটকে যেতে পারে।

নাজমুলের দাবির সঙ্গে মিলছে না সিসিটিভির দৃশ্য

পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেককে চিহ্নিত করার পর তাকে দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ওইদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন কনস্টেবল নাজমুল তারেক। তবে তার বর্ণনার সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়া দৃশ্য মিলছে না।

নাজমুল দাবি করেছেন, সেদিন বাসা থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন নাজমুল। সঙ্গে তার স্ত্রীকেও নিয়ে যান তিনি। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ব্যাপক যানজটের কারণে ফার্মগেটের পূর্বপাশ দিয়ে না গিয়ে আনন্দ সিনেমা হলের সামনে যান তিনি। মোটরসাইকেলে বসা তার স্ত্রীর পা ওই শিক্ষিকার গায়ে লাগে। পরে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়।

তবে সাময়িক বরখাস্ত কনস্টেবল নাজমুলের জবাবে ঘটনার পূর্ণ বর্ণনা শুনে তদন্ত কর্মকর্তারা শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁও জনতা হাউজিংয়ের বাসা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করেন। তবে তাতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে কোনো সময়ই তার স্ত্রী ছিলেন না।

সময়মতো ডিউটি করতেন না কনস্টেবল নাজমুল

টিপ পরা নিয়ে শিক্ষিকাকে হেনস্তার অভিযোগ পাওয়ার পর ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগ ও তেজগাঁও বিভাগ যৌথভাবে টানা দুদিন কাজ করে কনস্টেবল নাজমুল তারেককে শনাক্ত করে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ও মাথায় সাদা টুপিওয়ালা ওই ব্যক্তি নাজমুল তারেক বলে নিশ্চিত করে পুলিশ।

নাজমুল তারেক যশোরের একটি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১১ সালে কনস্টেবল পদে নিয়োগ পান তিনি। সর্বশেষ আট মাস ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগে কাজ করছেন। তবে নাজমুলের বিরুদ্ধে বরাবরই অভিযোগ- তিনি সময়মতো ডিউটি করেন না। এ কারণে তিনি শাস্তির মুখেও পড়েছেন।

হঠাৎ পাল্টে যান নাজমুল তারেক

বছর দুয়েক আগেও গান-বাজনা ও আনন্দ-ফুর্তি করে দিন কাটাতেন কনস্টেবল নাজমুল। মুখে ক্লিন শেভ। নিয়মিত নামাজ পড়তেও দেখা যেতো না তাকে। তবে এক-দেড় বছর আগে থেকে তার মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পান সহকর্মীরা। দাড়ি রাখা শুরু করেন নাজমুল। এমনকি দাড়ি বড় রাখার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিললে মুখে লম্বা দাড়ি রাখেন তিনি।

সহকর্মীদের ভাষ্য, গান-বাজনা পুরোপুরি বাদ দিয়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন নাজমুল। আচার-আচরণেও দৃশ্যমান পরিবর্তন চোখে পড়ে। সহকর্মীদের সঙ্গে খোশগল্প বা কথাবার্তা অনেকটাই কমিয়ে দেন তিনি।

মোটরসাইকেলের মালিকানা নাজমুল তারেকেরই

ঘটনার দিন যে মোটরসাইকেলটি নাজমুল তারেক চালাচ্ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেক গণমাধ্যমে পুলিশের সূত্রে বরাতে বলা হয়, মোটরসাইকেলটির মালিকানা কনস্টেবল নাজমুল তারেকের নয়। ওই মোটরসাইকেলটি চোরাই। এমন অভিযোগ ওঠার পর মোটরসাইকেলটির মালিকানার বিষয়টি তদন্ত করে ডিএমপি।

তবে ডিএমপির তদন্তে উঠে এসেছে, ওইদিন যে মোটরসাইকেল নাজমুল তারেক চালাচ্ছিলেন, তার বৈধ মালিকানা তারই। যাচাই করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

যা বলছেন ডিএমপি কমিশনার

ঘটনার পর থেকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে পুলিশ। এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সব সময় নজর রাখছেন।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনা ব্যাপক আলোচনা-সমালোচানর জন্ম দিয়েছে। ফলে পুলিশও বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও করা হয়েছে। তদন্ত নিয়ে শতভাগ বিশ্বাসযোগ্যতা যেন থাকে এবং গাফিলতির অভিযোগ না ওঠে, সেজন্য ওই অভিযুক্ত কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ তদন্তে আন্তরিক এবং গাফিলতির সুযোগ নেই, এটা এরই মধ্যে প্রমাণিত।’

শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘তবে যিনি ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন, তাকে প্রমাণ করতে হবে। আমাদের ইনকোয়ারি কমিটি কাজ করছে। পুলিশ প্রটেকশন বিভাগের একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এবং তেজগাঁও বিভাগের একজন সহকারী কমিশনারকে [এসি] এ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’

‘কনস্টেবলের সঙ্গে তার স্ত্রী থাকার কথাটি অবান্তর’

অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবলকে চিহ্নিত ও সাময়িক বরখাস্ত করা এবং তদন্ত কমিটি করায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা ড. লতা সমাদ্দার।

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর লিখিতভাবে থানায় অভিযোগ করেছিলাম। এরপর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমার পাশে থাকার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনকেও ধন্যবাদ। অভিযোগের পর তারা দ্রুত অভিযুক্তকে শনাক্ত করেছেন এবং চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন।’

মোটরসাইকেলে বা ঘটনাস্থলে ওই কনস্টেবলের স্ত্রী থাকার যে কথাটি আসছে, তা মিথ্যা বলে দাবি করেন ড. লতা সমাদ্দার। তিনি বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি, ঘটনার সময় উনি (অভিযুক্ত পুলিশ) ছাড়া অন্য কেউ ছিলেন না। এমনকি বাগবিতণ্ডার ঘটনা সমাধানে আশপাশের কেউ এগিয়েও আসেননি। তার স্ত্রীর উপস্থিত থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ অবান্তর এবং হাস্যকর।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীর ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে, পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুষ্ঠু বিচার করবে বলে বিশ্বাস করি। জানতে পেরেছি, ওই পুলিশ সদ্যস্যের বাসা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কোনো নারী তার মোটরসাইকেলে ছিলেন না। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।’

লতা সমাদ্দার বলেন, ‘সেদিন ঘটনাটি ঘটেছিল সম্পূর্ণ অতর্কিত। আমি পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিলাম। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে, সেটাই প্রত্যাশা করছি।’

অভিযোগ প্রমাণিত হলে বড় শাস্তি

ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘ঘটনার অভিযোগ ওঠার পর থেকে পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত ও অভিযুক্তকে শনাক্ত করেছে। পুলিশ তদন্তে আন্তরিক। এখানে গাফিলতির সুযোগ নেই। ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুতই পুরো ঘটনা উন্মোচিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘নাজমুল আগেও শাস্তির মুখে পড়েন। চাকরিজীবনে তিনি এ পর্যন্ত তিনবার শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। এবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বড় ধরনের শাস্তি হতে পারে। ডিএমপির বিভাগীয় ব্যবস্থায় যদি গুরুদণ্ড হয়, তাহলে আগামী পাঁচ-ছয় বছর তার পদোন্নতি আটকে যেতে পারে।’

তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘নাজমুল তারেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। তদন্তকাজে যার যার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন, সবার সঙ্গেই কথা বলবো।’

গত ২ এপ্রিল রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার পথে হেনস্তার শিকার হন ড. লতা সমাদ্দার। তিনি অভিযোগ করেন, হেঁটে কলেজের দিকে যাওয়ার সময় হুট করে পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই বাজে গালি দেন তাকে। ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তির গায়ে পুলিশের পোশাক ছিল। ঘটনার প্রতিবাদ জানালে একপর্যায়ে তার পায়ের ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান ওই ব্যক্তি।

পরে এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত