করোনার ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত আমরা

  মো. জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২১, ১৪:৫৫ |  আপডেট  : ২৮ মার্চ ২০২৪, ০১:৪২

গত বছর (২০২০) ফেব্রুয়ারি মাসে মহামারি করোনার (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কথা প্রথম জানতে পারি। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান সিাটি থেকে এর উৎপত্তি। বলা হলো বাদুরের স্যুপ খেয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সংক্রমিত হয় ভাইরাসটি। তারপর বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১৮ কোটিরও বেশি মানুষ, মৃত্যুবরণ করেছে ৪০ লাখ ৮৩ হাজার। আর বাংলাদেশে মারা গেছে ১৭ হাজার ২৭৮ জন, শনাক্ত ১০ লাখ ৭১ হাজার ৭৭৪ জন ।(১৫ জুলাই, ২০২১ পর্যন্ত। ক্রমেই এ সংখ্যা বাড়ছে।

করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সমাজে পড়েছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। গত প্রায় দেড় বছর ধরে মানুষ ব্যবসা-বানজ্যি করতে পারছে না, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। থাকায় লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনশ্চিয়তা। কাজের অভাবে শ্রমজীবী মানুষের না খেয়ে থাকার অবস্থা। সরকারি সাহায্য যে আসেনি তা নয়। তবে সেগুলোর বিলি-বন্টনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বরাবরের মতোই। মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের পরিবারে সংসার খরচ, চিকিৎসাব্যয় বেড়েছে । করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসায় তারা সঞ্চয় ভাঙ্গতে বাধ্য হয়েছে। আটকে গেছে বিবাহযোগ্য সন্তানদের বিয়ে-শাদি। সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ প্রায়। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উপায় নেই। যোগাযোগ যা হয় তা মোবাইল ফোনে।
 
২৬ মার্চ ২০২০ থেকে অতিপ্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাইনা। বাজারেও যেতে দেয় না স্ত্রী-কন্যারা। স্বপ্ন, মিনাবাজারে ফোন করে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যন্য পণ্য আনতে হয়। ফলে এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে এক ধরনের অসহায় অস্থিরতা বাসা বেঁধেছে মনে। পৃথিীবটা যেন ছোট হয়ে ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জীবন হয়ে পড়েছে একঘেয়ে। টিভি দেখতেও ভালো লাগে না। কোনো ভাল খবর নেই। শুধু করোনায় মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির খবর। যা শুনলে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। মোবাইল ফোনে কল এলে ধরতে ভয় পাই। এই বুঝি করোনার থাবায় কোনো স্বজন-প্রিয়জনের চলে যাবার খবর এলো!।
    
নিজে সাবধানে থেকে আত্মীয়-স্বজন সুহৃদদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে যাই নিয়মিত। কিন্তু এত সাবধানে থাকার  পরেও আমার পরিবারও সংক্রমণের ছোবলমুক্ত থাকতে পারেনি। করোনা কেড়ে নিয়েছে আমার  ছোটভাইয়ের স্ত্রী, ফুফাতো বোনসহ অগণিত আপনজন, সুহৃদ, সহকর্মীকে। কাছের সেই মানুষগুলোকে হারিয়ে বেদানায় ভারাক্রান্ত আমার হৃদয়। মনের দিক দিয়ে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। হৃদয়ে সৃষ্টি হচ্ছে এক গভীর ক্ষত। এ ক্ষত নিয়ে কয়দিন বাঁচব বলতে পারিনা। ক্ষণে ক্ষণেই মনে হয় জীবন কত ঠুনকো। ফিরোজ সাঁইর গানটি কানে বাজে- ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইবে রং তামাশা, চক্ষু মুদিলে, হায় রে দম ফুরাইলে’। কত নিমর্ম সত্য গানের এ কথাগুলো! আজ যার সাথে ফোনে কথা বলি, দুদিন পরে শুনি সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। এত মৃত্যু, এত লাশের বোঝা বয়ে চলা যে কত কঠিন বলে বোঝানো যাবে না।

করোনার থাবায় স্বজন পরিচিতজনের শতাধিক মানুষকে হারিয়েছি।  যাদের মৃত্যু আমার মনে বেদনার গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। দিনপঞ্জীতে টুকে রেখেছি অনেকের নাম। যেতে পারিনি তাদের জানাজা নামাজ ও দাফনে। টেলিফোন করে খোজঁ খবর নিয়েছি। পরিচিতজন, আত্মীয় -স্বজন ও সুহৃদ যাদের হারিয়েছি তাদের কয়েকজনের  নাম এখানে উল্লেখ করছি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ। মোস্তাফিজুর রহমান, হোগলাগাঁও, শ্রীনগর (আমেরিকা প্রবাসী),  ড. আনিসুজ্জামান ( জাতীয় অধ্যাপক), আজাদ রহমান (প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক), মোরশেদুল আলম (ব্যবসায়ী), মোঃ আলাউদ্দিন (বাঘড়া, শ্রীনগর), ড. নিত্যানন্দ দাস (কৃষিবিদ, লৗহজং) ইঞ্জিনিয়ার শহিদুল ইসলাম মাশুরগাঁও, শ্রীনগর  (বীর মুক্তিযোদ্ধা)  মোহাম্মদ নাসিম (বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী) শেখ মোঃ আবদুল্লাহ (ধর্ম প্রতিমন্ত্রী) মঞ্জুর আলী (বীর মুিক্তযোদ্ধা, প্রবাসী )  ড. মুজিবুর রহমান খান (এমডি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক), কামাল লোহানী (প্রখ্যাত সাংবাদিক), রেহেনা বেগম রানু (ফুফাতো বোন)  আমির হোসেন (লৌহজং),  বিথীকা রায় বসু চৌধুরী (কলকাতা) লতিফুর রহমান (চেয়ারম্যান, ট্রান্সকম গ্রুপ)    অধ্যাপক আবদুর রহমান (গাদীঘাট), নঈম বিশ্বাস (কামারগাঁও)  বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন তালুকদার (ছড়াকার আলম তালুকদার), সাহেরা খাতুন (রাজনীতিক) কুমকুম (লৌহজং),   তাজুল ইসলাম খান (বেজগাঁও), নুরুল ইসলাম বাবুল (শিল্পপতি), লক্ষণ পোদ্দার (শ্রীনগর), কফিল উদ্দিন মাঝি (বেজগাঁও), বিমল পোদ্দার মিন্টু (কলকাতা), এ কে এম আমানুল ইসলাম চৌধুরী (বাড়ৈখালি), নাসিরউদ্দিন (মুক্তিযাদ্ধা) শ্রীনগর, আলাউদ্দিন আলী (সঙ্গীত পরিচালক) রুমা আখতার (ছোটভাই হাশেম-এর স্ত্রী), এস এস দাস পুরকায়স্থ (ব্যাংকার), মিসেস গাজী আবু সাঈদ (জশলদিয়া) জিয়াউদ্দীন তারিক আলী (ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর) নওশেরুজ্জামান, মুন্সীগঞ্জ ( স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম) শাহজাহান খান (সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, কোলা, সিরাজদিখান) শেখ তরিকুল ইসলাম (শেখ সিরাজের ছোটভাই দেউলভোগ, শ্রীনগর)। নিজামুল হুদা শাহিন শিকদার পাটাভোগ, শ্রীনগর (প্রবাসী),  সৈয়দ কামাল হাসান (কৃষি ব্যাংক) অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম (এটর্নী জেনারেল), শ্রী দশরথ তরফদার, মানিকগঞ্জ ( ডিজিএম, কৃষি ব্যাংক), মো. তাসের আলী, বীরতারা (মুক্তিযোদ্ধা) আনোয়ারুল হক শিকদার (খোকামিয়া), শ্রীনগর, ফজলুর রহমান (আরধীপারা, শ্রীনগ), নিতাই কর, শ্রীনগর (কৃষিব্যাংক), দিলীপ দাস, ষোলঘর (কৃষিব্যাংক),  এ কে এম আব্দুল বারী, কুকুটিয়া (প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক) খোন্দকার মুনিরুজ্জামান, (সাংবাদিক, সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ) শরিফুল ইসলাম (ডিজিএম, কৃষি ব্যাংক), সাধন চন্দ্র দাস (শ্রীনগর), রূপক দেবনাথ (হরপাড়া), প্রফেসর ডাঃ আব্দুল কাদের খান, বাসাইল ভোগ, (সাবেক প্রিন্সিপাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ) মিসেস এ কে এম আবদুল বারী, মাহমুদুল হাসান (ডিজিএম, কৃষিব্যাংক)  খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (সিাবেক ডেপুটী গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক) সহিদুল ইসলাম খান( দলিল লিখক), নূরুল হুদা, রাঢ়ীখাল (সাংবাদিক, সাবেক সিনিয়র সহ-নভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব), কাইয়ুম খান মিলন, রাঢ়ীখাল, (সাংবাদিক), যদু গোপাল দাস শ্রীনগর, (হেডমাস্টার)। কাজী আজিজ আরশাদ (জিএম,কৃষি ব্যাংক), মাহবুবুর রহমান (ডিজিএম,কৃষি ব্যাংক), মহিউদ্দীনআহমদ (কবুতর খোলা), এ কে এম ওয়ালিউল ইসলামখান মেদিনীমন্ডল, লৌহজং, (প্রাক্তন অধ্যক্ষ, শ্রীনগর কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) মিসেস ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন হলদিয়া, দেলোয়ার হোসেন খান  বেজগাঁও,  শ্রীনগর, সালাহউদ্দিন ঢালী (কৃষি ব্যাংকে আমার সহকর্মী), মুন্সীগঞ্জ, সিদ্দিকুর রহমান খান (মুক্তিযোদ্ধা, যুগ্ম সচিব) সাতঘড়িয়া, সহিদুল ইসলাম মৃধা বেজগাঁও (প্রবাসী), মিসেস সিদ্দিকুর রহমান সাতঘড়িয়া, মোহসিন উদ্দিন খান মাশুরগাঁও, শ্রীনগর, মো, ফরমান আলী, জুশুরগাঁও (সিনিয়র শিক্ষক) মোহাম্মদ শাহজাহান, রামপাল (বীর মুক্তিযোদ্ধা, কর কমিশনার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতি)। এ তালিকা আর কত দীর্ঘ হবে জানি না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি- হে আল্লাহ, এ মৃত্যুর মিছিল আর দেখতে চাই না। তুমি মানুষের ওপর রহমত নাজেল করো।
 
এ ছাড়াও আমার আরো বহু পরিচিত জনকে করোনায় হারিয়েছি। আমি কৃষি ব্যাংক ছাড়াও জনতা ব্যাংক ও রূপালী  ব্যাংকে ছিলাম। ২০১৬ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক হিসেবে আছি। এসব প্রতিষ্ঠানেরও বহু সহকর্মী করোনায় ইন্তেকাল করেছেন।

আমার ফুসফুসের সমস্যা বহু পুরানো। করোনা ফুসফুস শেষ করে দিয়ে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। তাই আমি খুব সাবধানে চলাফেরা করি। তারপরেও বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন থেকে সতর্কতামূলক লিফলেট ও মাস্ক বিতরণ করতে এলাকায় বহুবার যাতায়াত করতে হয়েছে।

শুধু নিজে সতর্ক হলেই হবেনা, অন্যকেও সতর্ক করতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষ করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে ততটা সচেতন নন। তাদেরকে সচেতন করা আমাদের দায়িত্ব।

আমি আপনজনদের দেখতে হাসপাতালে যাইনি, জানাজার নামাজে যাইনি। শুধু গাজী আবু সাইদের স্ত্রীর ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যারের দোয়া মাহফিলে উপস্থিত হয়েছিলাম বাসার কাছে বলে।
    
ঈদ উল আজহা উপলক্ষে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে ১৫ জুলাই থেকে। ২৩ তারিখ থেকে আবার তা কঠোর করা হবে। এ সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই আমরা সুরক্ষা পাবো। তা নাহলে সংক্রমণ কিন্তু বেড়েই চলবে। তাই আসুন, আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি । মনে রাখতে হবে, যে কোনো মৃত্যু আপনজনের কাছে মহাবেদনার। এ বেদনার যেন আর ভারী না হয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

 

লেখক: বীর মুক্তিযাদ্ধা , সাবেক ব্যাংকার।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত