আড়িয়ল বিল রক্ষা করুন
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:০৮ | আপডেট : ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:১১
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ৯ সেপ্টেম্বর দেশের প্রাচীন ও বিখ্যাত জলাশয় আড়িয়ল বিল পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিল আমাদের জাতীয় সম্পদ, এ বিল রক্ষা করতে হবে। এখন থেকে এই বিলে কোনো আবাসন কোম্পানিকে ড্রেজার লাগিয়ে ভরাট করতে দেওয়া হবে না। এ সময় তাঁর সঙ্গে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানও ছিলেন।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দেশের পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা এবং পরিবেশবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে এসেছেন। এ লড়াই করতে গিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের রোষানলেও তাঁকে পড়তে হয়েছে। তাই ‘রাইট পারসন অ্যাট রাইট পজিশন’ সূত্রের যথার্থতা প্রমাণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রিজওয়ানা হাসানকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর দেশবাসীর মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। তারা মনে করছে, দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় এবার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আড়িয়ল বিলে মাটি ভরাট বন্ধ এবং আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের ঘোষণা তারই প্রতিফলন। বিশেষ করে আড়িয়ল বিলে আবাসন কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন বন্ধের যে ঘোষণা উপদেষ্টা দিয়েছেন, তাতে দেশের সচেতন ব্যক্তি, বিশেষ করে বিক্রমপুরবাসী আশান্বিত।
দেশের ঐতিহ্যবাহী এই বৃহৎ জলাশয় আড়িয়ল বিল মুন্সিগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলার শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটা ‘আড়িয়ল বিল’ আবার ‘আইড়ল বিল’ নামেও পরিচিত। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বিস্তীর্ণ এই এলাকা একসময় গঙ্গা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গমস্থল ছিল। ভূপ্রাকৃতিক বিবর্তনে উল্লিখিত নদ-নদীদ্বয় গতিপথ পরিবর্তন করলে এই এলাকা একটি আবদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। এর চারপাশে গড়ে ওঠে মনুষ্যবসতি। দৈর্ঘ্যে এটা প্রায় ২৬ কিলোমিটার, প্রস্থে ১২ কিলোমিটার। আয়তন ১৩৬ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এই বিল উত্তরে ধলেশ্বরী ও দক্ষিণে পদ্মা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। বর্ষায় এই বিল পরিণত হয় এক বিশাল জলাধারে। তখন ছোট-বড় অসংখ্য নৌযান এই বিলের বুক চিরে চলাচল করে। অনেকে আসেন নৌভ্রমণে। শুকনো মৌসুমে এই বিলে পানি থাকে না। তখন এটা হয়ে ওঠে শস্যক্ষেত্র। লাউ, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, খিরাই, মরিচ, সরিষা ইত্যাদির চাষ হয়। আড়িয়ল বিলের বৃহদাকার ও সুস্বাদু মিষ্টিকুমড়ার সুখ্যাতি রয়েছে। কোনো কোনোটির ওজন ৫০-৬০ কেজিও হয়। শীতের সময় পুরো বিল পরিণত হয় সবুজ ও হলুদের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপে। আর বর্ষাকালের সকালে এই বিলে ঊর্ধ্বাকাশের নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে অজস্র শাপলা ফুল। বিলের সেই শাপলা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে এলাকার কয়েক শ দরিদ্র পরিবার। প্রাকৃতিক এই জলাধার বিখ্যাত দুটি কারণে। প্রথমত, এখানে প্রচুর পরিমাণে মাছ উৎপন্ন হয়। বিলের মাঝে জমি খনন করে তৈরি করা বড় বড় দিঘি, যেগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ‘ডেঙ্গা’ বলা হয়, তাতে উৎপাদন হয় মিঠাপানির প্রচুর সুস্বাদু মাছ। আড়িয়ল বিলের কই মাছের প্রসিদ্ধি গোটা দেশে। দ্বিতীয়ত, এখানে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপন্ন হয়। এ জন্য আড়িয়ল বিলকে বলা হয় লাখ লাখ মানুষের অন্নের জোগানদাত্রী। ফলে বিক্রমপুরবাসীর সঙ্গে এই বিলের গড়ে উঠেছে আত্মিক সম্পর্ক। আর সে জন্যই ঐতিহ্যবাহী এই বিলের ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপই এলাকাবাসী মেনে নিতে পারে না। যেমন মানতে পারেনি এখানে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সরকারি উদ্যোগকে।
কারোরই ভুলে যাওয়ার কথা নয়, মাত্র ১৪ বছর আগে সেই উদ্যোগ নিয়েছিল সদ্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য আড়িয়ল বিলকে নির্বাচিত করে ভূমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু করা হয়েছিল। সেটা ছিল প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি আড়িয়ল বিলকে সমূলে ধ্বংসের এক অপরিণামদর্শী আয়োজন। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জমির উচ্চমূল্য দেওয়াসহ নানা রকম প্রলোভন দেখানো হয়েছিল এলাকাবাসীকে। এমনকি পরিবেশ বিনষ্টকারী আবাসন ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খ্যাত তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান বলেছিলেন, ‘আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর হলে এলাকার জমি “হীরায়” পরিণত হবে।’ তাঁর সেই ছেলে-ভোলানো কথায় এলাকাবাসী কর্ণপাত না করে কীভাবে আড়িয়ল বিল ধ্বংসের চক্রান্ত প্রতিহত করা যায়, তার উপায় খুঁজতে থাকে। কিন্তু স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে বাধা দেওয়া বা প্রতিহত করা ছিল একরকম দুঃসাধ্য। সরকারের সেই আয়োজন ব্যর্থ করে দিতে তার বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভূত হয়। আমরা সরাসরি সেই আন্দোলনে অংশ নিলে সরকার সেটাকে ‘বিএনপির দেশের উন্নয়নবিরোধী তৎপরতা’ আখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও দমন করার পদক্ষেপ নিতে পারে—এ আশঙ্কায় নেপথ্যে থেকেই আন্দোলনে ভূমিকা রাখার মনস্থ করি। আমরা জনগণকে এটা বোঝাতে সক্ষম হই যে, দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকা সত্ত্বেও আরেকটি বিমানবন্দর তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর (সাবেক) পিতার নামে বিমানবন্দর নির্মাণ এবং সেটাকে কেন্দ্র করে নতুন রাজধানী ‘বঙ্গবন্ধু সিটি’ স্থাপনের পরিকল্পনা। এরপর আড়িয়ল বিলের জমিসমূহের মালিক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রথম সারিতে রেখে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় ‘আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটি’ নামে। অন্যদিকে ঢাকায় আরেকটি কমিটি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই ডা. ফখরুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে। এ দুই কমিটির উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন, সভা-সেমিনার, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ হতে থাকে।
২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি ছিল আড়িয়ল বিল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি। ওই দিনই বর্তমানে বন্ধ থাকা একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘কবিগুরুর সামান্য ক্ষতি ও আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর’ শিরোনামে আমার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে আমি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার কাশীর রাজমহীষী করুণার শীত নিবারণের জন্য দরিদ্র প্রজাদের পর্ণকুটির জ্বালিয়ে দেওয়ার উদাহরণ দিয়ে বলি যে, দেশের প্রয়োজনে নয়, বরং শেখ হাসিনা তাঁর পিতার নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য হাজার হাজার একর ফসলি জমি ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছেন। নিবন্ধটি আন্দোলনকারীদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। ওই দিন আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বানচাল করার জন্য সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিলে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এর ফলে একজন পুলিশ সদস্য দুঃখজনকভাবে নিহত ও বহুসংখ্যক মানুষ আহত হন। জনতার প্রবল প্রতিরোধে সরকারের বোধোদয় ঘটে এবং আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তার পরও বিক্রমপুরবাসীর স্বস্তি ছিল না। কেননা, ২০১৮ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে রাতের ভোটের এমপি মাহী বি চৌধুরী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের। তাঁর এই জনবিরোধী আহ্বান জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে। তবে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণে থাকায় সরকার আর সেদিকে পা বাড়ায়নি।
বিমানবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিল হলেও নতুন উপদ্রব শুরু হয়। বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি এই বিলের জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভূমি ব্যবসা শুরু করে। তাদের করালগ্রাসে আড়িয়ল বিলের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখনো আড়িয়ল বিলের দিকে তাকালে শাপলা ফুল ফুটে থাকার মতো শত শত সাইনবোর্ড চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বিক্রমপুরবাসী যখন সন্দেহ-শঙ্কার দোলাচলে দুলছিল, তখনই উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তাঁর যুগান্তকারী ঘোষণাটি দিলেন। তবে ঘোষণাই যথেষ্ট নয়, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। দেশবাসী আশা করে, ধ্বংসের হাত থেকে আড়িয়ল বিল রক্ষায় সরকার সেই পদক্ষেপ নেবে।
লেখক: মহিউদ্দিন খান মোহন
সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত