গল্পঃ অনন্তযাত্রা

  শাশ্বত স্বপন

প্রকাশ: ৮ মে ২০২১, ০৯:১৫ |  আপডেট  : ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫

(১)
‘রোজাদাররা ওঠো--, সেহরীর সময় অইছে...।’ দিঘলী বাজারের পাহাড়াদারদের চিৎকারে, দরজা বা দোকানের ঝাপের আওয়াজে, কারো না ওঠে উপায় নেই। যারা রোজা রাখার নিয়ত করত, তারা ওঠে সেহেরী খেয়ে নামাজ পড়ত, তারপর আবার ঘুমাত। কেউ ঘুম ঘুম চোখে কোন রকম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আর যাদের রোজা রাখার নিয়ত নাই, তারা উঠে, বিরক্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ত।

কাক-জোৎস্নায় কিছু মানুষ বাজারের গলি দিয়ে হেঁটে নদীর পাড়ে চলে যায়। প্রায় প্রতিদিনই এ রকম দৃশ্য বাজারের পাহাড়াদাররা দেখে। বাজারের সাথে মরা নদী, হাঁটু জল থাকলে মাল কোছা দিয়ে সবাই পার হয়, পানি বেশি হলে নৌকা মাঝিকে ডেকে তুলে নদী পাড় হয়। নদীটি পদ্মা নদীর শাখা, চৈত্র মাসে শুকিয়ে যায়, এর দখিনে দীর্ঘ বালুচর। বালুচরের ফাঁকে ফাঁকে খুব বেশি চোখে পড়ে পিয়াজ, রসুন, ধান, নদীর কূল জুড়ে নটে আর কাশ জাতীয় ঘাসের বিশাল সীমানা। টিন-ছন-কাঁশ-মুলিবাঁশ দিয়ে ছবির মত করে গড়া চরের ঘরগুলোর চারপাশে কলাগাছ; কোথাও একটি, কোথাও দুইটি ঘর, আবার বেশ দূরে একটি-দুইটি ঘর। দিঘলী বা তার আশে পাশের গ্রাম, বাজার থেকে কেউ কাক-জোৎস্নায়, কেউ কাক-ভোরে, কেউবা ভোরের আযান শুনার পর এই বিশাল চর পায়ে হেঁটে পদ্মা নদীর উত্তর পাড়ে ভিড়ানো বাদাম তোলা নৌকাগুলোর কাছে চলে আসে, তারপর নৌকায় চড়ে ব্যবসা বানিজ্যের গল্প করতে করতে দখিন পারে শরীয়তপুরের নাওডোবা, নাওখোলা, বড়কৃষ্টনগর-এ সাপ্তাহিক হাঁটে যায়। কাক-জোৎস্নার হাট যাত্রীর সংখ্যা কম, যদিও তারা হাঁটে আগে পৌঁছে যায়, বাড়ি ফিরেও আগে আগে। কাক-ভোর বা ভোরের হাঁট যাত্রীর সংখ্যা বেশি। এদের কেউ বাদাম বিক্রেতা, কেউ বেলুন বিক্রেতা, কেউবা তিলা, বাতাসা, নিমকি, চিনি মাখানো মিষ্টি, কদমা বিক্রি করে, কেউ রোজা, কেউ বেরোজা। বেরোজা বলে রোজার মাহাত্ম বুঝে না, তা নয়; বরং বহু রোজাদারের চেয়ে এরা বহুগুনে ভাল মানুষ। কাক ভোরের হাঁট যাত্রী সোরাব মিয়া তার বানর জোড়া কাঁধে নিয়ে বালু চরে হাঁটছে। বানরদের চমৎকার নাম দিয়েছে--পুরুষ বানরটির নাম পঠিংকুমার আর মহিলা বানরটির নাম আলকাতরা পরী।

হরিদাস রায়ও প্রায় প্রতি সপ্তাহে এসব হাঁটে যায়। হাঁট থেকে প্রয়োজনীয় মালপত্র কিনে নৌকায় তোলে দেয়; কোনদিন মালের নৌকায় চড়ে আসে, নৌকার কয়েক দিন সময় লাগতে পারে জানলে সে সোরাবদের সাথেই বিকালে হাঁটা শুরু করে, রাতে বাড়ি ফিরে। মাল-পত্র দিঘলী বাজারে বিক্রি হয়। তার পূর্ব পুরুষরাও আরো বড় বড় ব্যবসা করেছে। বাজারের পূর্ব পাশে তার দোকান, একবারে গ্রাম লাগোয়া। মুদিমালের সাথে অন্যান্য মালও থাকে। কথা ও কাজে সৎ ও ধার্মিক বলে তার দোকানে ভীড় বেশি থাকে। অথচ মাস শেষে তার বিশেষ লাভ থাকে না। তবে তার ভাষায় ‘ঠাকুরের কৃপায় তার দোকান ও সংসার ভালই চলছে।’

তবে যে বিষয়টা সকলের কাছে তাকে মহৎ করেছে, তা হল, রমজান মাস আর দূর্গা পূজা এলেই হরিদাস তার মাল-পত্র কেনা দামে, কম দামে বা সামান্য লাভে বিক্রি করে। প্রতিদিন সে তার কপালে চন্দনের তিলক দিয়ে আর ধূপ জ্বালিয়ে দোকানের ব্যবসা শুরু করে। রমজান মাসে তার লোকসান হয় নয়তো কোন মতে চালান ওঠে। মাসের হিসাব শেষে লোকসান হলে সে বেশি খুশি হয়, বলে, ‘সবাই লাভবান হইছে, সবাইরে খুশি করতে পারছি, সবাই খুশি অইলেইতো ভগবান খুশি হয়।’

হরিদাসের বাড়িটা সারা বছর দেব-দেবীতে পরিপূর্ণ থাকে। তার ধর্মের প্রতি তার যেমন শ্রদ্ধা; অন্য ধর্মেও প্রতিও তার সমান শ্রদ্ধা। তার কথা--রমজান মুসলমানের পবিত্র মাস। এ মাসে বেশি লাভ করলে আল্লাহ বেজার হবেন; আর যিনি আল্লাহ তিনিই তো ভগবান।

(২)
বাজারের মন্দিরটার বেশির ভাগ খরচ তিনি দেন। তার আশির্বাদ ছাড়া, বাজারের বার্ষিক কির্ত্তন, পূজা-অর্চণা কিছুই হয় না। তার মুখ থেকে মিথ্যা কথা কেউ শুনে নাই। গ্রামের দুই পাড়ার মসজিদে নামাজীদের প্রায়ই মারামারি হয়। এক পাড়ার লোকদের অন্য পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়া নিষেধ। যদিও বা কেউ ভুল করে নামাজে যায়, সেদিনই মারামারি লাগে। বিশ পচিশ ফুট প্রস্থের খাল এর দুই দিকে দুটি বড় পাড়া। রমজান মাস আসলে প্রথম রোজার আগেই হরিদাস খাল পাড়ের সাঁকোটা নিজের বাড়ির বাঁশ কেটে মেরামত করে দেয়। আর ইফতারের সময় হলে তার দোকানের মুড়ি, চিড়া, বাতাসা, গুড় দিয়ে সকলে ইফতার করে। ইফতারের সময় তাকে সবাই ইফতার দেয়। সে খায়, আপন মনে হাসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ভগবান, তোমার এই চিড়া, মুড়ি, বাতাসায় যেমন তোমার ইফতার হয়, তেমনি তোমার পূজাও চলে, একই উপকরনে পূজা ও রোজা দুই-ই চলে।

এই এলাকার মুসলমান চেয়ারম্যান, চাউলের বেপারী, সংসদ সদস্যের ম্যানেজার--সবাই প্রায় হিন্দু। আর প্রত্যেকের চোখ মূল সড়কের সাথে হরিদাসের বাড়ি আর ধানী জমির উপর। মূল সড়ক নাকি একদিন বিশ্বরোড হবে। সেই হিসাবে এই বাড়ি ও আশে পাশের জমির কি দাম হতে পারে, তা নিয়ে যতটা না চেয়ারম্যান-বেপারী-এমপি ভাবে, তার চেয়ে বেশি ভাবে এদের হিন্দু ম্যানেজাররা। হরি দাসের চার কি পাঁচ পূর্বপুরুষ এই বাড়িতে বসবাস করেছে। তার পূর্বপুরুষরা তার মতই সৎ ছিল বলে গ্রামে একটা সুনাম আছে। সেই সাথে দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। দেশ বিভাগের সময় থেকে এ পাড়ার যারাই ভারতে চলে গেছে, তারা সবাই তাদের জমি-জমা সব হরিদাসের পিতা হরি আনন্দর কাছে কম দামে বিক্রি করেছে, কেউবা বিনা বিনামূল্যেও তাদের দিয়ে গেছে। কেউ অবশ্য তাদের জমি মা কালীর নামে দান করে তার কাছে রেখে গেছে। এসব জমির কোনটা কাগজে-কলমে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, কোনটা হয়নি। তবে যারা এসব করতে পারেনি, তারা গ্রামের দশজনকে ডেকে মৌখিক ভাবে হরি আনন্দকে জমি দান করেছে। দেশ ভাগের সময় হরিদাসের বয়স কুড়ি হবে। সবাই হরি আনন্দকেও ভারতে চলে যেতে উপদেশ দিয়ে গেছে। কিন্তু সে যায়নি।

পাড়ার গণেশ কাকার কথা হরির মনে পড়ে। দেশান্তর হবার আগের দিন হিন্দু-মুসলমান সবাইকে ডেকে বলতে শুরু করল, ‘আপনারা কইতে পারেন, আমরা আপনেগো কাছে কেন এসব বেচলাম না? এ পাড়ায় শত শত বছর আমরা হিন্দুরা বসবাস করতাছি, এই যে হরি আনন্দ, তার চার পুরুষ এখানে মরেছে, তাদের নামে মঠ আছে, তার পূর্ব পুরুষরাই নানা জায়গা থেকে আমাগো পূর্বপুরুষদের এখানে আনছে। এখানে অনেকের চিতা-ভস্ম আছে, মন্দির আছে। এগুলো এই পরিবারের কাছে মন্দিরের মত যত্নে থাকবে, আপনাদের কাছে যা অধর্ম। পারলে সব বিনা পয়সায় দিতাম, কিন্তু কোলকেতা গিয়ে তো কিছু করে খাইতে হবে, তাই হরি দাদার কাছে কিছু টাকা নিয়ে সাব-কবলা দলিল দিয়ে গেলাম।’ সবাই তার সাথে একমত হল। বর্তমান গ্রাম চেয়ারম্যানের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, গণেশ, তুই আমার জন্মকালের বন্ধু, তুই জাসনে, তুই হরি আনন্দদার মত সাহস নিয়ে থাক। তোদের ভিটা, মন্দির যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। আমি জিন্দা থাকতে কোন অনিয়ম অইতে দিমু না। হরিদার বাপ দাদারাই এ গ্রাম সৃষ্টি করেছে, ওদেরকে আমরা মাথায় তুলে রাখব। ওদের বাপদাদাদের সাহায্য নিয়েই আমার তিন পুরুষ তথা এ গ্রামের প্রতিটি মানুষ বেঁচে ছিল, এখনও আছে।

কাপালী বাড়ীর পশ্চিম দিকের পুকুরের জলে প্রতিদিন অস্তায়মান গোধূলীর সূর্যের ছায়া পড়ে, লাল আভায় মেঘ মাখা রং এর ছবিটা পুকুরে জলে ভাসতে থাকে। পুকুরে মাটির ঢেলা ছুড়ে ফেললে ছবিটা কাঁপতে থাকে। হরির বয়স যখন সাত কি আট, তখন থেকে সে পুকুরের জলে গোধূলীর স্থির-কম্পমান ছায়া দেখে আসছে। কাপালী বাড়ীর শেষ পুরুষ বোরজা কাপালী সবার শেষে কোলকাতা চলে যায়। হরি আনন্দর বড় ভাই নিত্য আনন্দ জমি-বসতভিটা, প্রায় ছয় একর জায়গা কিনে রাখে। নিত্য আনন্দ নিঃসন্তান, তাই সবই হরি-মোহনকে দিয়ে গেছে । কাপালী বাড়িতে আছে বিশাল বাগান, দীঘি, মঠ-মন্দির, রামপ্রসাদের আশ্রম, সবই এ পরিবার দেখা-শুনা করে। কিছু দরিদ্র মানুষকে হরি বসবাস করতে দিয়েছে। এরা নমঃশুদ্র, পেশায় মিস্ত্রী, স্বর্ণকার, কেউ মুলিবাঁশের খুচি বানায়। পূর্বের রাস্তা তাদের জমির উপর দিয়েই গেছে, রাস্তার পুর্বে তাদের সাত একরের মত ফসলী জমি, তারপর বিল। এই সম্পত্তি ঘরামী বংশের, যে উপাধী এক সময় তাদের পূর্বপুরুষের ছিল। ঘরামীরা ফসল-মাছ-বাগান-ব্যবসা নিয়েই দাপটে ছিল। এই পরিবারের কোন এক শিক্ষিত ব্যক্তি কুষ্ঠি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে আবিস্কার করে হরি আনন্দরা পূর্বে ঘরামী ছিল...। এই নিয়ে অবশ্য রায় পরিবারে কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি। ঘরামীরা সাধারনত মানুষের ঘর বানিয়ে দেয়, আমরা যাদের কাঠমিস্ত্রী বলি, ছোট চোখে দেখি। সম্ভবত এই কারণে হরির পূর্বপুরুষরা বংশের উপাধী ত্যাগ করে সম্রাট বা বৃটিশদের দেওয়া রায় উপাধী গ্রহণ করে। কেন তারা রায় বাহাদুর উপাধী পায়নি? মনে হয়,আগে খুব বড় মাপের জমিদারী ছিল না। যে বেশি খাজনা দিত বা যার প্রভাব, দাপট বেশি, যাকে দিয়ে সম্রাট বা বৃটিশরা বেশি লাভবান হত, তাদেরই তারা বেশি ভালোবাসত, বেশি সুবিধা দিত, বিরাট আয়োজনে উপাধী দিত।

দখিনে বীরেন্দ্র পালের দুই একর জায়গা, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব খুলনায় ছিল, ব্যবসা-সংসার এক জায়গায় রাখতে তারাও হরিআনন্দর বড় জ্যাঠার বড় ছেলে সামন্তর কাছে বিক্রি করেছিল। সামন্ত রায়ের পরিবারটা ছিল ঐ সময়ে মস্ত বড় জমিদার, যদিও জমিদারী প্রথা ছিল না, অনেক জমি, সম্পত্তির মালিক হলেই মানুষ জমিদার মনে করত। এরা ছিল বেশ উচ্চ শিক্ষিত পরিবার, এদের ক্লাশ কনসাস বেশ ধারালো ছিল। হরি আনন্দর তিন ভাইয়ের কাছে সব সম্পত্তি , গ্রামের সাধারন মানুষের ভাষায়, জলের দামে বিক্রি করে গেছে। সামন্তদের বাপ-দাদার মঠ এবং নিজস্ব মন্দিরের দায়িত্ব হরি আনন্দকে দিয়ে যায়, তবে দলিলে লিখা আছে এসব ধর্মীয়, পূর্বপুরুষের চিহৃ কোনভাবে হরিদের বংশ ধ্বংশ করতে পারবে না। আর সামান্য কিছু ভিটে সামন্ত রায় তাদের দরিদ্র দূর সম্পর্কের আত্নীয়-স্বজনকে দান করে যায়। দেশ ভাগের সময়ে এদের কিছু সদস্য আসাম, কিছু সিলেট, কিছু লন্ডনে চলে যায়। স্বল্প বিদ্যা আর ভিটে মাটির টান, সেই সাথে অনেক পরিবারের মঠ-মন্দির-সম্পত্তি দেখা শুনার দায়িত্ব, অনেক পরিবার তাদের আহার-বাসস্থানের জন্য এই হরিদাস রায় পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে বলে, যাই যাই করে এই পরিবারের কোলকাতা যাওয়া হয়নি। আর চলে গেলে, কে দেখবে এত সব সম্পত্তি-মঠ-মন্দির-আশ্রম । সবাই তো তার পূর্বপুরুষ বা তার কাছে বিশ্বাসের সাথে সব দিয়ে গেছে। সে কাকে দিয়ে যাবে, এত বড় গুরু দায়িত্ব নেবার মত আর তো কেউ নাই।

(৩)
হিন্দু ম্যানেজাররা হরিদাসের কাছে কিছু বলতে সাহস করে না। কারন কার বাবা হরিদাস এর বাবার কাছ থেকে কি সাহায্য নিয়েছে হরিদাস তা জানে। হাঁটে হাড়ি ভাঙ্গার ভয়ে হরিকে কেউ খেপায় না। তবে আড়ালে এরা বলে বেড়ায়, অমুক জমির মালিকানা ঠিক নাই অথবা কমল বনিক ভারতে যাবার আগে তার জমি মন্দিরের জন্য বরাদ্ধ করেছিল, তা হরিদাসের খুরতুতো বোন ভোগ দখল করে খাচ্ছে। প্রশ্ন হল, তাতে তাদের কি সমস্যা? তাদের সমস্যা হল, তারা কিছু পাচ্ছে না। একবারে পাচ্ছে না, তা বলা যাবে না। এমপি আর বেপারীর ম্যানেজারের দরিদ্র আত্নীয়-স্বজনরা হরিদাসের জমি বর্গা চাষ করে। তাদের জমিতেই থাকে। হরি ঘর শূন্য করে তাদের সাহায্য করে, তা দেখেও তাদের হিংসা হয়। তারা বুঝতে চায় না, হরি সাহায্য না করলে এই দরিদ্ররা তাদেরই ঘাড়েই চাপত। এই হিন্দু ম্যানেজারদের কুপরামর্শে এমপি, চেয়ারম্যান, প্রভাবশালী নেতারা প্রায় হরিদাসের জমি জমার খোজ খবর নেয়। কোন জমির দাম কি রকম, কি ফসল ফলে, তার পিতারা কোন জমি বর্গা চাষ করত, এসব নিয়ে কথাবার্তা বলে। সেই সাথে হরিদাস কোন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধার করেছে, কোন স্কুলে কত টাকা দিয়েছে, কোন জমিটার ভাগের বর্গা ফসল স্কুলের নামে বরাদ্ধ করেছে, এসব নিয়ে প্রশংসাও করে। তবে হরিদাস ও তার ভাই মোহনদাস মনে করে, এদের শকুন চোখ বিশাল এই বাড়িটার চারদিকে প্রতিদিন ঘুরপাক খায়। হরিদাসের পরিবারে কোন আঘাত এলে গ্রামের সবাই যে ঝাটা নিয়ে বের হবে, এটা সবাই জানে। তাই কেউ ওদের পেছনে লাগতে আসে না। হরিদাসের পরিবার স্বল্প শিক্ষিত, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া। তাদের তৃতীয় পূর্বপুরুষ ভগবান রায়, তাদের পিতাকে বলেছিলেন, সম্রাট আকবর সেনাপতি মানসিংহ, তার পুত্র- নাতীদের দিয়ে রাজ্য দখল করাতেন। 

আগেই বলেছি, হরিদাস এর পূর্বপুরুষদের উপাধী ছিল ঘরামী, তাও তিন-সাড়ে তিনশ বছর আগের কথা। কোন এক নবাব বা বৃটিশরা নাকি তাদের কর্মগুণের কারণে এ উপাধী দান করে। সেই থেকে তারা রায় উপাধীই ব্যবহার করে। কততম পুর্বপুরুষ থেকে তারা এই উপাধী ব্যবহার করে, তা তারা জানে না। যাই হোক, এ পরিবার হিন্দু ম্যানেজারদের সম্রাট আকবরের সেনাপতির সাথে তুলনা করে, বলে, এরা মানসিংহ এর বংশধর। এই বিশাল সম্পত্তি নিয়ে হরির পরিবার বিচলিত, যদিও সম্পত্তির অধিকাংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে গ্রামের লোকজনই ভোগ করে। বিশ্বরোড হলে কি সমস্যা হতে পারে, তা নিয়ে তারা ভাবতে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন আগে এমপির ম্যানেজার যোগেশ পাল মোহনকে বলেছে, দাদা কিছু জমি এমপি সাবের কাছে বিক্রি করে দেন, নিরাপত্তা পাবেন। মোহন কোন উত্তর দেয়নি বলে যোগেশ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে।

একদিন গ্রামের কিছু লোক, ভিন গায়ের কিছু মৌলবীদের হরিদাসের দোকানে নিয়ে আসে। বড় কালি মন্দিরে পাশে পুকুর, পুকুরের ঐ পারে জঙ্গলে ভরা একটা বাড়ি খালি পড়ে আছে। সেই বাড়িতে তারা মাদ্রাসা করতে চায়। হরিদাস হেসে বলে, হুজুর, আযান, উলোধ্বনি, শঙ্খধ্বনি সবই আমার কাছে একই মনে অয়, ভগবানকে খুশি করা। আমার খারাপ লাগবে না। কিন্তু মা কালীর পুজার আওয়াজ আপনাদের সমস্যা হবে না? 

পাশের গ্রামের এক ছোকরা, মাদ্রাসা থেকে সদ্য মুফতি পাশ করেছে, বলে, না কোন সমস্যা হবে না। হরি বখতিয়ারের ছেলে ওমরকে চেনে, সবাই ওকে ‘সয়তানের সয়তান, বান্দরের বান্দর’ বলে জানে। গ্রামে হেন কোন খারাপ কাজ নাই যা সে করে না। তাই বাধ্য হয়ে তার মামারা তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়। শুরুতে মাদ্রাসা থেকে সে পালাত, হুজুররা এসে তাকে নিয়ে যেত। হরি তার দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা, তুমি তো তোমার বাবাকে নিয়ে ঐ জায়গা দখল করে ভোগ করতে চাইছ, মাদ্রাসা করতে নয়। আপনেরা ঐ কবরের পাশে খালি জায়গায় মাদ্রাসা করুন। আপনাগো কোরান পড়ার শব্দ আর আযানের শব্দে মুর্দাগো সোয়াব অইবো। আমাগো জমি নিতে যদি সমস্যা না হয়, আমাগো দেওয়া টাকা নিতে নিশ্চয় সমস্যা হবে না। 

ওমর চিৎকার করে বলে, আশতাকফিরুল্লাহ্, বিধর্মীর টাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা ? 
-তাহলে পুকুর পাড়ের জমিতে কিভাবে মাদ্রাসা হবে? 
-পুকুর পাড়ের জমি তো আমার আব্বার অইত, যদি দাদাজান তারে দিয়া যাইত। আপনে তো ভাল লোক, কম দামে আমার আব্বারে এই জমি দিয়া দেন। আমরা মাদ্রাসা বানামু।
--ঠিক আছে, তোমার আব্বারে আমার কাছে পাঠাইয়া দিও, তার সাথেই কথা হবে।


(৪)
ইতিহাসে ময়লা ভাসে বলে নিন্দুকেরা বলে বেড়ায়। আসলেই মিথ্যা নয়, ময়লা ভাসে। ওমর সেই ময়লা নিয়ে আজ হরিদাসের দোকানের সামনে। দেশ ভাগের আগে সোমেন দত্তের ছেলে নরেন দত্ত পাশের গ্রামের এক মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে মুসলমান হয়, কেউ বলে ইসলাম ধর্মের গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে মুসলমান হয় এবং চল্লিশ দিনের চিল্লায় যায়। নিন্দুকেরা বলে, চিল্লা নয়, মাইয়া নিয়া ভাগা দিছে। তারপর পদ্মার শাখা নদীতে অনেক ঘোলা পানি গড়িয়েছে। হরিদাসের বাবা হরি আনন্দ নরেনকে অনেক বুঝিয়েছে। না, সে লতীফাকে ত্যাগ করতে পারবে না। তারপর প্রায় দশ-বারো বছর নরেন কোথায় ছিল, কেউ জানে না। এর মধ্যে আরেক ঘটনা ঘটে। কে বা কারা যেন নরেনের বোনটাকে রাতের আধারে নিয়ে গেছে। সোমেন দত্ত হরির বাবাকে সাথে নিয়ে যাতে থানা-পুলিশের জামেলা না করে, তাই গ্রামের দুইটি ছেলে ঘটনার একদির পর হরিআনন্দের বরাবর লেখা নরেনের বোন লাকীর একটা চিঠি আর দেলোয়ারকে লেখা কিছু প্রেমপত্র দিয়ে যায়। পুত্র-কন্যা শোকে নরেনের মা মারা যায়। দেশ ভাগের পরে সোমেন তার সব সম্পত্তি হরির বাবার কাছে বিক্রি করে। তবে হরি আনন্দ মারা যাওয়ার আগে হরিকে বলে গেছে সোমেনকে দেওয়া তার শপদ, ‘তোমার জমি আমি কিনলাম, কিন্তু তোমাকে কথা দিলাম, তোমার পুত্র-কন্যা যদি নিজ ধর্মে ফিরে আসে, অথবা নরেন যদি কাগজে কলমে লিখে দেয়, সে তার বাপদাদার মন্দির, মঠ ধ্বংশ করবে না বা কারো কাছে এই জমি বিক্রি করবে না, তবে আমি সব ফেরত দিব।’ ‘ দাদা, যদি নরেন নিজ ধর্মে ফিরে আসে, আমি তোমার সব টাকা ফেরত দিব।’ নরেন ছিল সোমেনের একমাত্র জীবিত পুত্র, আরো তিন পুত্র নানা রোগে মারা গেছে। সোমেন নরেনকে খুবই ভালোবাসত। হরি বাবার কাছে শুনেছে, সোমেন স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিল, তার দেশ প্রেম হরি আনন্দর চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু স্ত্রী শোক, পুত্র-কন্যার কাহিনী তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। তারপর গ্রামের মানুষের কাছে শুনা গেল, নিজ ধর্মে ফিরে আসতে চেয়েছে বলে নরেনকে কারা যেন মেরে ফেলেছে, আবার এও শুনা গেল লাকী আত্নহত্যা করেছে, কেউ বলে ভাই-বোন এক জায়গায়ই থাকে। কোন কথা সত্য, তা বুঝার উপায় নেই। তবে বর্তমান চেয়ারম্যানের বাবা রফিক শেখ হরি আনন্দকে বলেছে, দাদা, লাকী মেয়েটি সত্যিই আত্নহত্যা করেছে, নরেনের কোন হদিস আমরা জানি না।

হরি আনন্দ বি. এ পাশ ছিল। টাকা-পয়সা-জমি-জমা বিষয়াদি ভালো বুঝত। কিন্তু নানা জামেলায় হরিদাস ছয়-সাত ক্লাশের বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। বাপ-দাদা আর সমাজ থেকে সে যা শিখার শিখেছে। তবে সে বেশ ঠান্ডা মাথার লোক। ওমরকে বলে দিয়েছে, তোমার বাবা কোথায় আছে, তাকে আসতে বলো। তার সাথে কথা হবে। 
ঘটনা সত্যি। একদিন রাতের বেলা এক মৌলভী উঠানে নয়, ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে, একা। কে একজন বলল, উনি হরি বাবুর সাথে কথা বলতে চায়। রমজানের দশ এগারো রোজা শেষ হয়েছে। মূল রাস্তায় মুসল্লীরা তারাবী পড়ে যে যার বাড়ি যাচ্ছে। হরি মৌলভীর সামনে দাঁড়ায়,

--দাদা
--বখতিয়ার!
--আমি নরেন। আমাকে নরেন বলবেন
নরেন অনেকক্ষণ মা-বাবার স্মৃতি নিয়ে কাঁদল। হরি বাড়ির সবাইকে ঘরে চলে যেতে বলল। পুকুরের পাড় দিয়ে হেঁটে গল্প করতে করতে হরি নরেনকে নিয়ে তার জন্ম ভিটায় এলো। কেউ বসবাস করে না বলে জঙ্গলে ভরে গেছে ওদের উঠান। মোহন বলে, জঙ্গলেভরা ভাঙ্গা ঘরে সাপ আছে। মোহন বাজার থেকে বাড়ি গিয়ে সব শুনে এখানে চলে। ওদের পূর্বপুরুষের মঠ, মন্দিরে গিয়ে নরের চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কান্নার আওয়াজ অনেকদূর চলে গেছে। সকালে হয়তো হরিকে এ কান্নার আওয়াজ নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে।
মোহন আর নরেন সমবয়সী, এক সাথে স্কুলে যেত, খেলত, নৌকা চড়ে অনেকদূর চলে যেত। মোহন আসাতে সে তার কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না। মায়ের চিতা মন্দিরে বসে আবার কাঁদতে লাগল, মা তুমি আমার জন্য মরেছ, আমার পাপের শেষ নাই। রাত প্রায় ভোর হয়ে এলো।
মোহন বলছে, নরেন, সেহেরীর সময় হয়েছে।
--আমার বোন নিজ ধর্মে, মা-বাবার কাছে চলে আসতে চেয়েছে বলে ওর জামাই ওকে ফাঁসি দিয়ে মেরেছে। আমিও বার কয়েক চেষ্টা করেছি...। আমি তো লতিফাকে ভালবেসেছি, ধর্মকে নয়। 
--তবে আগে আসনি কেন?
-- মোহন, আমি কোন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলাম না। আমার বাবাও না। ধর্ম বিশ্বাস করতে গিয়ে, খোদাকে খুঁজতে গিয়ে কিছুই পাইনি। মা-বাবাকে কষ্ট দিয়ে, মাকে, হত্যাই বলব, আমিই তো মেরেছি, যে পাপ আমি করেছি, কোন ধর্ম চর্চা করে তার মোচন হবে, তা আমি চাই না। আমি প্রায়শ্চিত্ত চাই।
--কবে তোর এরকম উপলব্দি হল, আগে জানালি না কেন?
-- হরিদা, ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবান সব একই । আমি তোমাদের মাঝে, তোমার মাঝে যে ঈশ্বর থাকে, তাকে বাদ দিয়ে, নিজ ভাষার, নিজ জাতের, নিজের সমাজের ঈশ্বর বাদ দিয়ে একবারে আলাদা জাতের বিদেশী ঈশ্বর, বিদেশী ধর্ম নিয়ে কোন শান্তি পাইনি। আমার মন সর্বদা এই মন্দিরে পড়ে থাকত। বড় হুজুরকে বললে, বলত, খোদাকে ডাক সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন আমার মত ধর্মান্তরিত এক হুজুর বলল, ফিরে যা, দশ পনের বছরে যখন হল না, ফিরে যা। সমাজ গ্রহণ না করলে, আর তুই না পারলে, কোন মাজারে পড়ে থাকিস। কারণ ওখানে সব ধর্মের মানুষ প্রার্থণা করে, হয়তো অনেকটা স্বস্তি পাবি । 
--নরেন, নিজ ধর্মে ফিরে এলে তোকে ধর্মান্ধরা মেরে ফেলবে।
--আমার ছেলেই কথিত মহৎ কাজটি সবার আগে করবে। সে আমাকে কাফের মনে করে। আফগানিস্তানে কারা যেন তাকে নিয়ে গেছে, ফিরেছে দুই বছর পর। আরো কোথায় কোথায় যেন গিয়ে সে ট্রেনিং দিয়ে এসেছে। ওর মার কাছে শুনলাম, কারা যেন ওর মাকে বলে গেছে, তোমার ছেলে জামাতী ইসলামী পাকিস্তানে নাম লিখিয়েছে। কেউ বলে সে জঙ্গি হয়ে গেছে।
--বাবা বলেছে, তুমি ফিরে আসলে, সব যেন তোমাকে ফিরিয়ে দেই।
--না, এ সম্পত্তির মর্যাদা আমার মরার পরে থাকবে না। আমার দূরসম্পর্কের এক ভাই আছে, খুব কষ্টে আছে, পরিবার নিয়ে প্রায়ই মাজারে যায়। যদি বলেন, ওকে আপনার কাছে আসতে বলি।
--নরেন আমাদের বিশাল সম্পদ, তোমার বাবা এ সম্পত্তি আমার বাবাকে উইল কইরা দিয়ে গেছে। জমিদারী প্রথা নেই, মানুষের আচার আচরণে মনে হয়, আমরা হইয়া গেছি এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এত সম্পদ আমাদের জন্য বোঝা । তোমারটা তোমার কাছে দিতে পারলে বোঝা কমে, অন্যকে দিলে বোঝা কমবে না, শান্তি পাব না। 
--আপনারা যত দিন জীবিত আছেন, আপনাদের জিম্মায় থাকবে। দূর সম্পর্কের আত্নীয়কে শুধু বসবাস করতে দিবেন। আর একটা অনুরোধ, জঙ্গলে ভরে আছে, দয়া করে, বাবা-মা বেঁচে থাকতে যা যা করেছে, আমার আত্নীয়কে দিয়ে তা করাবেন। যখন আপনারা থাকবেন না বা জমি নিয়ে যদি কোন জামেলা হয়, তাহলে আমি যদি না থাকি, ওমরের মাকে নিয়ে স্কুল অথবা দুরের কলেজকে সব দান করবেন। হ্যাঁ, ওমরের মা বলবে, এ জমির উপর নরেন ওরফে বখতিয়ারের কোন দাবী নাই।

(৫)
বেশ কিছু দিন ধরে এলাকার মানুষের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা ভর করছে। ঢাকা শহরের অবস্থা ভাল না। রাতে নাকি গোলাগুলি হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গেছে। দেশে সামরিক শাসন জারী হয়েছে। পাকিস্থানী ম্যালেটারীরা দেশ নাকি দখল করবে। দেশ ভাগের আগে পরে হরি হিন্দু-মুসলমানের রায়ট দেখেছে। দেশ ছেড়ে যায়নি। এবার কেন জানি আগের চেয়ে বেশি ভয় করছে। বাজারের দোকানপাট প্রতিদিন খুলে না। কারা যেন মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। তাকে না জানিয়ে তার পাড়ার জোয়ান ছেলেরাও যোগ দিচ্ছে। পরে তাকে জানানো হচ্ছে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তাকে জানিয়ে গেল, ‘দাদা, আপনাদের কিচ্ছু হবে না। আমরা আপনাদেরকে রক্ষা করব, ইসলামী রাষ্ট্রে আপনারা আমাদের পবিত্র আমানত কিন্তু একটা কথা, আপনার পরিবারের কেউ যেন মুক্তিদের সাথে না যায়।’ দেশ ভাগের সময়ও এ রকম ‘পবিত্র আমানত’ কথাটি হরি শুনে নাই।

প্রতিদিন হরি-মোহনের কাছে খুব খারাপ সংবাদ আসতে থাকে। তাদের কাছের আত্নীয়-স্বজনদের পাকিস্তানী ম্যালেটারী-রাজাকাররা মেরে ফেলেছে। এই গ্রামের দু’জন মহিলাকে রাতের আঁধারে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে হরি তা জানালে বলে, আওমিলিগের লোকজন এই কাজ করে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আর আমাগো ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। হরি তুমি জান, ঐ দুই মহিলার স্বামী মুক্তিতে যোগ দিছে।

মুক্তি বাহিনীতে হরিদের পরিবারের লোকজনও যোগ দিচ্ছে। হরি শুরুতে বারণ করলেও এখন আর করে না। দিন দিন ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। পাঁচ-ছয় পুরুষের ভিটা, এত সম্পদ, এত পরিচিত মানুষ জন, তার গ্রাম--এসব ছেড়ে পালাতে হবে, বাইরের লোকই নয়, তার পরিবারের লোকজনও তাকে পালাতে বলছে। বয়স নয়, কি যেন এক আতংক তাকে আজকাল ঘুমাতে দেয় না।

এ পাড়ার প্রতিটি ঘরের লোকজন সারারাত পালা করে পাড়া পাহাড়া দেয়। একদিন রাতে নরেন হরিদাসের উঠানে এসে হাজির। রাস্তা থেকে তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, কোন উত্তর দেয় না। আবার তাকে খারাপ লোকও মনে হয় না। কয়েকজন তাকে জড়িয়ে ধরেছে, মাজারের খাদেম বা অতি ভক্তরা ( কেউ বলে পাগল) যে শত তালি দেওয়া কাপড় পরে, নরেনও সে রকম কাপড় পড়েছে। দাদা বা মোহন ছাড়া সে কারো কাছে পরিচয় দিবে না। হরি সারারাত বিছানায় গড়িয়েছে, একটুও ঘুম হয়নি। নির্ঘুম চোখে বাইরে এসে দেখে এক পাগল মস্তান।
-কি চাই, মস্তান ভাই, ক্ষূধা লেগেছে? এই উনাকে খেতে দাও।
-দাদা, ওদেরকে দূরে সরে যেতে বলেন
--কে তুমি? আমার মাথা ঠিক নেই, তোমাকে চিনতে পারছি না।
--নরেন
হরির মাথায় যেন বাজ পড়ল। গত বছর তাকে যে হুজুর বেশে দেখেছিল, সেই বেশ নেই।
-- তোমরা দূরে যাও। তুমি কি নিজ ধর্মে ফিরে এসেছ?
--দাদা, আমি বহর বাগদাদী মাজারের খাদেম। ধর্মে ফিরে আসার বিধান তো নেই, দাদা।
ব্রিটিশদের সাথে লিয়াজো করে, আইন করে রাজা রামমোহন সতীদাহ বন্ধ করেছে, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করেছে। আপনারা, আপনাদের পূর্বপুরুষরা চাইলে ধর্মে ফিরে আসার বিধান চালু করতে পারতেন।
--আইন হয়তো করা যেত, হিন্দু সমাজ তা মানতো কি?
--সতীদাহ, বিধাব বিবাহ ঐ সময়ে অধিকাংশ হিন্দুরাই মানতে চায়নি। সতীর স্বর্গে যাওয়া রাজা রাম মোহন বন্ধ করেছে। কত অপবাদ তাদেরকে শুনতে হয়েছে। এখন কিন্তু সতীদাহ হয় না, বিধবা বিবাহ হচ্ছে।
-- নরেন, ধর্মে ফিরে আসার প্রচলন হবে। তুমি আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না। তুমি কি কারনে এসেছ?
--দেশের পরিস্থিতি ভাল না। মোহন কোথায়?
-- বর্ডারে পাঠিয়ে দিয়েছি।
--দাদা, আপনিও চলে যান, ওমরের মা কইল, ওমর পাকিস্থানী সৈন্য নিয়ে এ গ্রামে কাল ভোরে কিবা সকালে আসবে। আপনার পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতি দেখলে আপনাদের বাঁচতে দিবে না, আবার আপনারা সবাই উপস্থিত থাকলেও... ওদের বিশ্বাস নেই।এখানকার শান্তি কমিটির চেয়াম্যানকে ওমর হাত করে ফেলেছে। আপনারা স্বেচ্ছায় ওদের জমি লিখে না দিলে কাউকে বাঁচতে দিবে না। পুরো এলাকাটা মাদ্রাসা বানাবে। দেশ স্বাধীন হলে সব পাবেন। চলে যান, দাদা...

পাড়ার লোকজন নরেনের কথা বিশ্বাস না করলেও হরি করেছে। হরি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল, যা আগে কেউ এরকম কাঁদতে দেখেনি, এমনকি মা-বাবা মরার সময়ও না। গতবারের রমজানে সে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারলেও এবারের রমজানের শুরুতে তাকে জন্মভিটা ছেড়ে পালাতে হচ্ছে।

(৬)
‘রোজাদারেরা ওঠো--, সেহরীর সময় অইছে...।’ এ রকম আহবান সারা জীবন সে শুনতে পেয়েছে, বিশেষ করে যেদিন দোকানে ঘুমাত। এই রাতে হরি শুনতে পেল না। গ্রামে কারো ঘরে ঘুম থেকে উঠার শব্দ, সেহেরীর খাওয়ার শব্দ সে শুনতে পেল না। কাক-জ্যোৎন্সা । দিঘলী বাজারের পাহাড়াদারের চিৎকার, দরজা বা দোকানের ঝাপের আওয়াজ কিছুই শুনতে পেল না। সবাই পালিয়েছে, কেউ কি রোজা রাখে না? আজ অবশ্য নিয়ত না করেই হরির পুরো পরিবার রোজা। না খেয়েই তারা ঘর থেকে বের হয়েছে। সবাই হয়তো সময়ের আগেই রোজা ভেঙ্গে ইফতার করবে কিন্তু হরি করবে না, সে আজ না খেয়েই থাকবে। এরকম অনেক রোজাই সে করেছে আল্লাহকে খুশি করার জন্য, কারণ যে আল্লাহ সেইতো ভগবান। সবাই মনে করত, হরি উপাস আছে কিন্তু উপাসে ফল-ফলাদি খাওয়া যায়, রোজা রাখলে ইফতার এর আগ পর্যন্ত কিছু খাওয়া যায় না। হরি ইফতারের আগে কিছুই খেত না। তার ইফতার খাওয়া দেখলে মনে হতো সেই প্রকৃত রোজদার। কেউ কেউ এ বিষয়টা জানত কিন্তু আলোচনা করত না। বাজারের সবাই হরিকে ভাল জানত। এই রোজায় সে ইফতারের নানান খাবার হাঁট থেকে কিনেছে। হরি ভাবছে, আর একদিন সময় পেলে নাওডোবা হাট থেকে কেনা সব ইফতারী মাল মুসল্লিদের কাছে বিলিয়ে দেওয়া যেত। হরি বড় দোকানের ঝাপে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ডাকতে লাগল, নিতুন, শংকর, মোসলেম, উঠ। আরো কয়েকবার আঘাত করেও কোন লাভ হল না। নিচে তাকিয়ে দেখে তালা দেওয়া। জ্যোৎস্নায় আলোয় ঝাপ-তালা-গলি কিছুই সে ভালভাবে চিনতে পারছে না। 

অবিশ্বাস চোখে বলল, দেখ তো, এটা আমাদের দোকান কিনা? সবাই হ্যাঁ বলার পর নিজের মনে বলে উঠল, পালিয়েছে, সবাই পালিয়েছে। মালগুলো বাইরে রাখলে সবাই ইফতারে খেতে পারত। হরি নদী পথের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল। তার পা চলতে চাইছে না। স্ত্রী-পুত্র-ভাতিজা-ভাতিজি-আত্নীয়-স্বজন--এদের অনুরোধে সে চলছে, বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। কে যেন বলছে,‘ হরি যাসনে, ফিরে আয়, তুই চলে গেলে আমাদের কি হবে?’ হ্যাঁ, বাবা, ঠাকুরদাদাই তো ডাকছে। স্ত্রীকে বলছে, ‘সবিতা, তুমি কি বাবার ডাক শুনতে পাও।’ ‘না, চল, তাড়াতাড়ি নদী পার হতে হবে।’ হরিকে সবাই যেন ধাক্কা দিয়ে নিয়ে চলেছে। বাজারের সাথে শুকনো নদী, এক গিঁড়া জল। হরি দেখে তার অন্তরে প্রবাহিত নদীর মত এ নদীও শুকিয়ে গেছে। নদী পার হলেই দখিনে দীর্ঘ বালুচর। বালুচরের ফাঁকে ফাঁকে খুব বেশি চোখে পড়ে পিয়াজ, রসুন, ধান, নদীর কূল জুড়ে নটে আর কাশ জাতীয় ঘাসের বিশাল সীমানা। টিন-ছন-কাঁশ-মুলি বাঁশ দিয়ে ছবির মত করে গড়া চরের ঘরগুলোর চারপাশে কলাগাছ, কোথাও একটি, কোথাও দুইটি ঘর, আবার বেশ দূরে একটি-দুইটি ঘর। এরা যেন ছবি, এদের কোন ভয় নেই। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর বাদুরের পাখা ঝাপটানি চরের রাতের পরিবেশকে ভুতুরে করে দেয়। চরে কলাগাছ বেশি বলেই বাদুরের ওড়াওড়ি চোখে পড়ে।

পরিবারের ছোট বাচ্চারা হাসছে। পঠিংকুমার আর আলকাতরা পরীকে তারা চিনে। সোরাব মিয়া বানরদের নিয়ে চর পার হচ্ছে। হরি কাক-জ্যোৎন্সায় বাড়ি থেকে বের হলেও কাক-ভোর বা ভোরের হাঁট যাত্রীরা তাদেরকে অতিক্রম করে চলেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দেশের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাদাম বিক্রেতা রফিক বলল, ‘কাকা সপরিবারের বানিজ্যে যাচ্ছেন?’ ‘হ্যাঁ রে রফিক, রাজবাড়িতে আমাদের আত্নীয়-স্বজন থাকে , ওদেরকে ওখানে রেখে পরদিন নাওখোলার হাঁট ধরব।’ সোরাব মিয়া বলছে, ‘চাচা, এবার ঈদে কিন্তু আমার পঠিংকুমাররে ধুতি-পায়জামা আর আলকাতরা পরীরে বেনারশী শাড়ী দিবেন, আপনে কইছিলেন। এবার ওদের নিকা দিব।’ বাদাম বিক্রেতা সাত্তার বলে উঠে, কও কি সোরাব ভাই, জামাতী হুজুররা জানলে, তোমার আলকাতরা পরীরে তুইললা ম্যালেটারীগো কাছে লইয়া যাইব, বেশরীয়তি কাজ-কাম, অহনো নিকা দেও নাই, এক লগে থাকে কেমনে? সবাই ওর কথা শুনে হাসতে শুরু করল। 

হরি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দিঘলী বাজারটা ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেল। সারা জীবনের স্মৃতি, তার শিশুকাল-স্কুল-বাজার-বাড়ি-মন্দির-পুকুরঘাট-ফসলের মাঠ সব চোখের জলে ভাসছে। সে যেন, ঐ মাটির সাথে লেগে থাকা অংশ। এরা যেন, তাকে সেই মাটি থেকে খাবলা দিয়ে নিয়ে এসেছে। পূর্ণিমার শেষ রাত, তারাগুলো মিটি মিটি জ্বলছে, চাঁদও চলেছে তাদের সাথে। অথচ এত ফকফকা চাঁদনী রাতেও হরি চোখে কিছু দেখতে পায় না। সে স্ত্রীকে বলেই চলেছে, সবিতা, সামনে সব অন্ধকার, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, হাঁটতেও পারছি না। সবাই হরিকে ঘিরে কাঁদতে শুরু করল। হরি যেন, স্বপ্নের হাত ধরে ঘোর অমাবশ্যার অন্ধকার রাতে বঙ্গভুমির পাঁচ পুরুষের ভিটা ছেড়ে দিগন্তবিহীন বালুপথে ভেসে চলেছে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত