২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই : লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল

  লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৩, ১৬:২৩ |  আপডেট  : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:২০

২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস। ২০১৭ সালে এই দিবসটি জাতীয় দিবস হিসেবে মহান জাতীয় সংসদে ও পরবর্তীতে মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়। ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২৫ মার্চ কালোরাতে তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির আনন্দ ও বেদনার এক সংমিশ্রিত ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশ স্বাধীন ও মুক্তির আন্দোলনে উত্তাল হতে শুরু করে। মার্চের প্রথম দিকে জয়দেবপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্তির সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে বীর জনতার প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। এই সশস্ত্র প্রতিরোধে পাকিস্তান সৈনিকদের গুলিতে মনু খলিফা, হুরমত, নিয়ামত ও কানু মিয়া শাহাদাৎ বরণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এটাই ছিল বাঙালি জনতার প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। এই দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব দ্বিতীয় ইষ্ট রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করতে গাজীপুরে আসছে, এ কথা শুনে গাজীপুরের জনগণ সড়কে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে। এই সময় বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব ঢাকা ফেরার পথে গাজীপুরের বিক্ষুপ্ত জনগণের বাধার সম্মুখীন হন। ফলে গাজীপুরের বীর জনতা ও পাকিস্তানি সৈনিদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। এই খবর দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা বাংলায় শ্লোগান উঠে “জয়দেবপুরের পথ ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। যা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরই নির্দেশে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক এমপি এর নেতৃত্বে ১৯ মার্চ গাজীপুরের বীর জনতা প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হককে স্বাধীনতা পদক ২০১৯ এ ভুষিত করা হয়েছে। এই জন্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়া, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু এবং সবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুন শোকাবহ লোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল বীরত্বপূর্ণ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরদিনের জন্যে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কমলাপুর, সদরঘাট, প্রভৃতি এলাকায় নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা শুরু করে। ৭১ এর ২৫ মার্চে গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকান্ডই ছিলো না এটা ছিল মূলতঃ বিশ্ব মানবতার জন্যে এক কলংকজনক জঘন্যতম গণহত্যা। ৭১’র পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার দিনটি জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিবসটি ২০১৭ সাল থেকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

অষ্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধুমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী নয় মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল সেই বর্বর ইতিহাসকে।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চের রাত সম্পর্কে লিখেছেন সে রাতে ৭০হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় আরো ৩০ হাজার মানুষকে। ঢাকার ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। তবে ক্রমবর্ধমানভাবে সমগ্র পূর্বপাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘরবাড়ি। দোকান-পাট লুট করে ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশানভূমি। পাইকারিভাবে এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানী জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানী সেনারা কুখ্যাত অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে নিরীহ বাঙ্গালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিলো আওয়ামীলীগসহ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

পাকিস্তানী হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসনের ২৪নং বাড়িতে। এই বাড়ির নীচে দুপায়ে গুলিবিদ্ধ দুই মা তাদের শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সিড়ি বেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। হানাদাররা ভেবেছিলো অন্য কোন দল হয়তো অপারেশন শেষ করে গেছে। তাই তারা এই বাড়িতে ঢুকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রাণে বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, তাদের বাড়ির নিচে আর একজন অবাঙালি অধ্যাপক থাকলেও তিনি ২৫ মার্চের আগে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। শুধু তাই নয়-বিশ্ববিদ্যালয় আবসিক এলাকার সব অবাঙালি পরিবার তাই করেছিলেন। এই থেকে ধারণা করা যায় ২৫ মার্চের এই হত্যাযজ্ঞের পূর্বাবাস অবাঙালিরা জানতো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডি বাসা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে বিজয় ছিনিয়ে এনে এ দেশের বীরজনতা বুঝিয়ে দিল, ঐক্য ও ত্যাগ থাকলে বুলেট আর কামান দিয়ে কোনো জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনে যে শহীদেরা আত্মত্যাগ করেছেন, নিজেদের প্রাণবাজি রেখেছিলেন যে মুক্তিযোদ্ধারা, গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের স্মরণ করি। যে সব দেশ ও গোষ্ঠী মহানমুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্য করেছে তাঁদের জানাই কৃতজ্ঞতা।

আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই বারবার চলে আসে বঙ্গবন্ধুর কথা। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনায় তিনি যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তেমনি যুদ্ধের শুরুতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ. ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে এবং ৯ মাসের যুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রেরণা ও শক্তির উৎস।

২০১৭সাল থেকে বাংলাদেশ ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে এবং দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্যে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়। এই দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে বিশ্বের সকল নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান ও সহানুভুতি জানানো হবে। ২৫মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্যে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের আন্তর্জাতিক তৎপরতার কারণে দীর্ঘ ৫২ বছর পরও বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। তবে বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করায় দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত