সেক্যুলার বঙ্গবন্ধু

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৪ |  আপডেট  : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২১

“ ... বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। …”  

বোধকরি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামো তৈরির প্রাথমিক স্বীকৃতি। সরকারিভাবে স্বীকৃত এই কথাগুলো বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে শাসনতন্ত্রের খসড়া অনুমোদনকালে। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন– “ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। ”

অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতার শুদ্ধতম অনুরাগী। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই ব্যক্তিজীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ধর্মানুরাগী। মূলত বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে ব্যক্তিজীবনকে পরিচালিত করেননি বলেই বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়। যদিও বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বিশেষ করে “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” থেকে  জানা যায়, কৈশোরে তিনি যেমন দেখেছেন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি; তেমনি দেখেছেন সাম্প্রদায়িক আচরণ। এমনকি জীবনে প্রথমবার যে ঘটনায় তিনি জেল খেটেছেন, সেই ঘটনায় ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন প্রভাব। এরকম পরিস্থিতিতে যে মানুষটি বেড়ে উঠেছেন, তার মধ্যে  সাম্প্রদায়িক মনোভাব থাকাই ছিল স্বাভাবিক।

কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কালো থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার বন্ধু। বাংলার হাজার বছরের জাতিগত সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যকে তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের আত্মার মাঝে। তার চোখে মুসলিম বাঙালি দরিদ্র আর মধ্যবিত্তের ওপর হিন্দু জমিদার, উচ্চবিত্তদের নিপীড়ন থেকে মুক্তির উপায়ই ছিল বাঙালি মুসলমানের অধিকার সংগ্রাম। দেশ বিভাগের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক যে দ্বিজাতি তত্ত্বকে তিনি সমর্থন করেছিলেন, সেই তত্ত্বের মাঝে তিনি থেকে প্রচ্ছন্নভাবে চেষ্টা করেছেন অসাম্প্রদায়িক আবহ ধরে রাখার। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইতে তিনি বলেন,

“‘ভারতবর্ষে মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষে হিন্দুরাও মুসলমানকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে।”

 এমনকি ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রচারণা রয়েছে অনেকের (বিশেষ করে কিছু ভারতীয় ইতিহাসবিদের) মাঝে। কিন্তু সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায় না। ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকালে কলকাতার অলিতে-গলিতে তরুণ শেখ মুজিব ছুটেছেন একজন মানবিক নেতা হিসেবে। উদ্ধার করে হিন্দু পরিবারকে হিন্দু এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন কখনও, অন্যদিকে মুসলমান ছাত্রদের হোস্টেলে গিয়ে তাদের খবর নিয়েছেন।

মুসলিম লীগের ঘরানায় বিকাশ পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন। তিনি সাহচার্য পেয়েছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মহান নেতার। ফলে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ও অপপ্রয়োগ ওনার কাছে যেমন দৃশ্যমান ছিল; তেমনি মানুষের রাজনৈতিক চাহিদাকে অনুধাবন করার মতো অসাধারণ গুণ বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন। উনি বুঝতেন “ধর্মনিরপেক্ষতা” আর “মুসলমান-বাঙালি”-এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম ফারাক আছে সেটুকু। আর সেই সঙ্গে উনি জানতেন “ধর্মনিরপেক্ষতা”র ধারণাকে কারা রাজনৈতিক অপপ্রচারের জন্য “ধর্মহীনতা”র মোড়কে প্রচার করতে চায়। একই সাথে চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কমিউনিজম আর সেক্যুলারিজমের মাঝের সম্পর্কগুলো।

বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজমের প্রকাশ

অনেকেই বলে থাকে স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গবন্ধু সেক্যুলারিজমের কথা বলেন নাই। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সুসংগঠিত করার জন্য অন্য দেশের পরামর্শে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে যুক্ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫৫ সালে নিজেদের রাজনৈতিক দলের নাম “আওয়ামী মুসলিম লীগ” থেকে পরিবর্তন করে “আওয়ামী লীগ” করা হয়। “মুসলিম” শব্দটি রাজনৈতিক দলের নামে থেকে বাদ দিয়ে সকল ধর্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়; এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহান নেতা সেই সময়ে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক।

পরবর্তীকালে ১৯৬৬ উত্থাপিত ছয় দফা দাবিতে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেক্যুলারিজমের কোনও কথা বলেননি। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ছয় দফা ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি– যেখানে দ্বিজাতি তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে কথা বলা হলো সমাধিকারের। পরবর্তীকালে ১৯৬৯-এ বঙ্গবন্ধু যখন “বাংলাদেশ”-এর ধারণা দেন; উনি পরিষ্কার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। অবশ্য ১৯৭০-এর নির্বাচনের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন, কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনও আইন করা হবে না। অনেক বিশ্লেষক বলতে চান, বঙ্গবন্ধু সেক্যুলারিজমের ধারণা থেকে সরে আসেন। লক্ষ্য করতে হবে সেই সময়েও জনসংখ্যার বিপুল অংশ মুসলিম। সেজন্য নির্বাচনি ইশতেহারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকা প্রয়োজন যে  পবিত্র কোরআন ও সুন্নায় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলি পরিপন্থি কোনও আইন আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করবে না। এছাড়া সেই সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং এক ধরনের প্রোপাগান্ডা ছিল যে আওয়ামী লীগের জয়লাভ দেশকে হিন্দু রাজ্যে পরিণত করবে। এরকম অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকেই প্রকাশ করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে বেতার-টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন,“আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে যে আমরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। আমরা কেবল সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘমন্ত্রে। ইসলামের প্রবক্তা সেজে যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে।”

রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে অনেকেই অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্র”। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন মওদুদী ধারণার অনুসারীরা মত্ত ছিল অপপ্রচারে। “নেই কোনও পক্ষ যার, সেই নিরপেক্ষ” এই যুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদীরা ব্যাখ্যা দেয়, “নেই কোনও ধর্ম যার সেই নিরপেক্ষ”। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা ধর্মহীনতা বলে প্রচার করে।

তাদের এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার বঙ্গবন্ধু বলেন, “বিগত ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জোচ্চুরি বেইমানি, অত্যাচার, খুনখারাপি, ব্যভিচার এই বাংলার মাটিতে অহরহ চলছে। ধর্ম অতি পবিত্র। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কিউ বলে এতে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। বরং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।”
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা করেন, যার ফলে স্বাধীনতাবিরোধী অনেকে মুক্তি পায়। পরবর্তীতে তারা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। সেই সময়ে জামায়াত ও মুসলিম লীগ নিজেদের পরিচয়ে মাঠে না নামলেও তারা নিষ্ক্রিয় ছিল না। তথাকথিত  ওয়াজ-নসিয়ত ও ধর্মীয় জলসার মাধ্যমে তারা সংগঠিত হতে থাকে। এবং এসব ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয় দৃষ্টি ও উদারতা পরবর্তীকালে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে।

আপাদমস্তক ধর্মানুরাগী বঙ্গবন্ধু খুব সূক্ষ্মভাবে আলাদা রেখেছেন রাষ্ট্র পরিচালনা আর ব্যক্তিজীবনের অনুশীলনকে। একজন মুসলিম হিসাবে তিনি যেমন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন, তেমনি নিশ্চিত করেছেন অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার। বঙ্গবন্ধুর এই নীতির সাথে মদিনা সনদের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। মদিনা সনদে বলা হয়েছিল, প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম অনুশীলনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন বঙ্গবন্ধু যে সেক্যুলারিজমের কথা বলেছিলেন তা ছিল পশ্চিমা সেক্যুলারিজম থেকে অনেক আলাদা। পশ্চিমা সেক্যুলারিজম রাষ্ট্রকে ধর্মবিষয়ক যেকোনও বিষয়কে উৎসাহ প্রদান করতে নিরুৎসাহিত করে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে প্রতিহত করা। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে এক ধর্মের সামনে অন্য ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। এর ফলে যে ধর্মীয় হানাহানির সৃষ্টি হয় তার সাক্ষী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মানসপটে আঁকা ছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চিত্র। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিশ্চিহ্ন করতে হবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে।

সৌজন্যে: বাংলা ট্রিবিউন 
লেখক: ব্লগার ও তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত