সাভার সরকারি কলেজ মাঠে অবৈধ বাণিজ্য মেলা হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য

  ছোলেমান মোল্লা

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৫:০৬ |  আপডেট  : ৩ মে ২০২৪, ০৬:১১

হাইকোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে সাভার সরকারি কলেজ মাঠে একজন অবাঙালির নেতৃত্বে শুরু করা একটি অবৈধ বাণিজ্য মেলা থেকে একটি চক্র প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জেলা—উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় পুলিশ এবং সাভার সরকারি কলেজ কতৃর্পক্ষ এ ব্যাপারে নির্বিকার। অফিসিয়াল অনুমতির তোয়াক্কা না করে আয়োজিত ঐ মেলায় কোন রকম বাধা ছাড়াই গত ২৫ দিন ধরে জন প্রতি ১০ টাকা হারে প্রবেশ মূল্যে প্রতিদিন ২০—২৫ হাজার মানুষের সমাগম ঘটছে। শুক্র ও শনিবার উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই থাকছেনা।  

জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই চালুকরা অনুমেয় ৩০ কোটি টাকা বাজার মূল্যের সাভার কলেজ মাঠের ওই মেলাটির আয়োজক গণচেতনা নামের কথিত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আটকেপড়া পাকিস্তানীদের একজন জয়নাল আবেদীন লালু নামের অবাঙ্গালী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁত বস্ত্র ও হস্তশিল্প মেলা, ২০২৩ নামে চলমান এই মেলার জন্য কোন কর্তৃপক্ষেরই অনুমতি নেই। প্রযোজ্য কোন শর্তও সেখানে মানা হয়নি। অথচ ইতোপূর্বে ঐ একই মাঠে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাভার প্রেসক্লাব—স্মার্ট আই, গোপালগঞ্জ—জলিরপাড় ক্ষুদ্র—কুটির শিল্প ও বাজারজাত করণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম শীর্ষক অনুষ্ঠানমালাসহ বাঙালির গৌরবের বিষয় বিজয়মেলা অনুষ্ঠানের অনুমতির আবেদন করেছিল। তাদের আবেদনে কয়েকজন মন্ত্রী—এমপি’র সুপারিশ সত্ত্বেও জেলাপ্রশাসন তা নাকচ করে দেয়। সে সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মেলা করায় হাইকোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কথা বলে সেসব আবেদন না মঞ্জুর করে তা নথিজাত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণ দেখিয়ে সাভার প্রেসক্লাব ও স্মার্ট আই’র যৌথ উদ্যোগে বিপুল ব্যয়ে গড়ে তোলা বর্তমানে চলমান মেলাটির একই জায়গায় এনাম মেডিকেল সংলগ্ন তারাপুরের সাভার কলেজ মাঠের একটি ভরা মেলা গুড়িয়ে দেয়া হয়। ২০১৫ সালেমিরপুর সেনপাড়া পর্বতা স্কুল মাঠসহ অনেক স্থানেই অনুরূপ ঘটনা ঘটে। অথচ “এনাম মেডিকেল মাঠ”—এর নামে মেলার প্রচারণার আড়ালে সেই সাভার কলেজ মাঠেই একজন অবাঙালির নেতৃত্বে অবাধে চলছে“ তাঁত বস্ত্র ও হস্তশিল্প” নামের বাণিজ্য মেলা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২২ জুন, ২০২২ তারিখের পরিপত্র অনুযায়ী যেকোন মেলা তা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, সেখানে বিক্রয় বা বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকলে তা বাণিজ্য মেলা হিসেবেই গণ্য হবে। এ ধরনের মেলার জন্য আয়োজককে জেলার চেম্বার অব কমার্সের সম্মতিপত্র, ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট, আয়কর সনদ, মেলার সময়কালের ব্যপ্তি অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ফি জমা দেয়ার ব্যাংক চালানসহ জেলা প্রশাসকের শর্তসাপেক্ষ অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে কোন ধরনের মেলা করার ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের ২৫ জুন হাইকোর্টের একটি মামলার রায়ে বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি জে এন দেব চৌধুরীর দ্বৈত বেঞ্চ নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। তার আগে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পরে ২০২২ সালের ২৯ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের ৫ এর চ ধারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে কোন ধরনের মেলা না করার বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এসব নিষেধাজ্ঞার কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই কথিত গণচেতনা গত ৬মার্চ থেকে সাড়ম্বরে সাভার সরকারি কলেজ মাঠে“ তাঁতবস্ত্র ও হস্তশিল্প মেলা” নামের প্রায় ৩০ কোটি টাকা বাজার মূল্যের এই বাণিজ্য মেলাটি চালু করে।

কথিত গণচেতনা অত্যন্ত সচেতনভাবে এই মেলা আয়োজনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। সাভার সরকারি কলেজের মাঠ ব্যবহারের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের শর্তসাপেক্ষ একটি প্রাথমিক অনুমতি থাকলেও হাইকোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে মেলার প্রধান দুই ফটকে মেলার নাম এবং স্থান উল্লেখের প্রচলিত বিষয়টি সুচতুরভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রকৃত সত্য আড়াল করে প্রচারপত্রে স্থানের নাম বলা হচ্ছে“ এনাম মেডিকেল মাঠ”। এ ছাড়া মাইকিং, ইউটিউব প্রচার, ব্যানার এবং ১০ টাকা দামের প্রবেশ পত্রের কোথাও মেলার প্রকৃত স্থানের উল্লেখ নেই। এলাকার দরিদ্র তাঁতিদের জীবন—মান উন্নয়নে মানবিক বিবেচনায় মেলার অনুমতির আবেদন করা হলেও চলমান মেলার চরিত্র আবেদনের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রকৃত অর্থে মেলাটি তার একক মালিকানাধীন। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের ৫—এর ছ ধারার বিশেষ অবমাননা।
হাইকোর্ট এবং দুই মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধ আরোপের কারণে এনাম মেডিকেল সংলগ্ন সাভার কলেজের এই মাঠটিতে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ মেলা বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। ২০১৬ সালে সাভার প্রেসক্লাব এবং স্মার্ট আই নামের একটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এনাম মেডিকেলের পাশের সাভার কলেজের এই মাঠটিতে “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম শীর্ষক অনুষ্ঠানমালা”সহ ইতিহাস ঐতিহ্য নির্ভর বিজয় মেলা অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যয়বহুল সেই মেলাটি ভেঙে দেয়া হয়। জেলা প্রশাসন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মেলা আয়োজনে নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ করে সে সময় সাভার প্রেসক্লাব ও স্মার্ট আইয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মেলার অনুমতির আবেদন না মঞ্জুর করে নথিজাত করেন। পরবর্তীতে গোপালগঞ্জ—জলিরপাড় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকরণ সমবায় সমিতি লি: বাংলাদেশ তাঁতশিল্প শিক্ষা ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাভার উপজেলা কমান্ড কয়েক দফা ওই মাঠে মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়ে আবেদন করলেও একই কারণে জেলা প্রশাসন সে সবের অনুমতিও দেয়নি। অথচ সবাইকে তাক লাগিয়ে একজন অবাঙ্গালী মহল বিশেষের আনুকূল্য—প্রশ্রয়ে ওই মাঠে দোর্দন্ড প্রতাপে অবৈধভাবে প্রশাসনের অনুমতিবিহীন মেলাটি চালিয়ে যাচ্ছে।

৮৫ হাজার টাকা মূল্যের শতাধিক দোকান, ৮—১০লাখ টাকা মূল্যের কয়েকটি প্যাভেলিয়ন, বিনোদন সামগ্রী এবং ১০ টাকা মূল্যের দৈনিক ২—৩ লাখ টাকার প্রবেশপত্র বিক্রিসহ সামগ্রিক বেচা—কেনার গড় হিসেবে অনুমেয় ৩০ কোটি টাকা বাজার মূল্যের এই মেলা থেকে আয়োজক কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা ব্যক্তি আয় করবেন বলে মেলা সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ হিসাব কষেছেন। এতে করে সরকার বিপুল অংকের টাকা রাজস্ব হারাবে।

সাভার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, প্রফেসর মোহাম্মদ ইমরুল হাসান বলেন, তিনি তারাপুরে সাভার সরকারি কলেজের মাঠটি শর্তসাপেক্ষে ব্যবহারের প্রাথমিক অনুমতি দিয়েছিলেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেই মেলা হবে, না হলে নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুমতি না মিললেও প্রায় ১৬ দিন ধরে মেলাটি চলছে। মেলাটি“এনাম মেডিকেল মাঠে” অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে আয়োজকের প্রচারণা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ ইমরুল হাসান হো হো করে হেসে ওঠেন এবং তীব্র প্রতিবাদ করে দৃঢ়তার সাথে বলেন, নো নো ওটি এনাম মেডিকেলের নয়, সাভার কলেজের মাঠ। শর্ত ভঙ্গ করে অনুমতিবিহীন মেলাটি কিভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি খেঁাজ নিয়ে বন্ধের নোটিশ দিবেন বলে জানান।

প্রসঙ্গে স্মার্ট আই এবং গোপালগঞ্জ—জলিরপাড় ক্ষুদ্র—কুটির শিল্প উৎপাদনকারী ও বাজারজাত করণ সমবায় সমিতি লি:—এর পরিচালক মোঃ সোলেমান মোল্লাহ বলেন, বর্তমানে গণচেতনা নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে চলমান বাণিজ্য মেলাটির ঐ একই জায়গায় মেলা অনুষ্ঠানের জন্য আমরা তিন দফা আবেদন—নিবেদন করি। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মেলা করা যাবে না বলে বার বার আমাদের আবেদন নাকচ করা হয়। প্রশাসনের মৌখিক প্রতিশ্রম্নতিতে একবার মেলার সার্বিক প্রস্তুতি নিলেও পরে কোন লিখিত অনুমতি না দিয়ে বিপুল ব্যয়ে গড়ে তোলা আমাদের মেলাটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, চলমান মেলার ক্ষেত্রে এখন কি আইনের ব্যত্যয় ঘটছে না?

উল্লেখ্য সাভার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের বরাবরে ২১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে দেয়া স্থান বরাদ্দের পত্রে ১০ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে মেলা অনুষ্ঠানের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কলেজের অনুমতি প্রাপ্ত হয়েই উল্লেখিত সময় থেকে মাঠটি দখলে নিয়ে সেখানে মেলার কাঠামো তৈরি করে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর গত ৪ মার্চ থেকে মাসাধিককাল সময়ের জন্য মেলাটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছাড়াই চালুকরা হয়। সেই থেকে ঐ মাঠে কলেজের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় ছেলেমেয়েদের খেলাধূলা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯ জুন ২০২২ এর পরিপত্রের ৫ এর খ ধারায় বলা হয়েছে “কোন কারণে নির্ধারিত তারিখে মেলা আয়োজন করা সম্ভব না হলে আবেদনকারীকে পুনারায় ‘ফি’ প্রদান করে আবেদন করতে হবে এবং তা নতুন আবেদন হিসেবে বিবেচি তহবে।” গণচেতনা’র আবেদনের নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলেও জেলা প্রশাসন কিংবা কলেজ কতৃর্পক্ষের নিকট তারা নতুন কোন আবেদন কিংবা আদৌ কোন ফি প্রদান করেনি। এটিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের মারাত্মক লংঘন।

উল্লেখ্য, ৫—৬ মাস আগে কথিতগণচেতনা চট্টগ্রামের বারইয়ারহাটে একটি অবৈধ বাণিজ্য মেলা পরিচালনা করে। শর্ত পূরণ করে জেলা প্রশাসনের অনুমতিনিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই বা রচতুরতার সাথে নাম পরিবর্তন করে “বাণিজ্য মেলা” কে “সস্তাবাজার” বলে চালিয়ে এক মাসের বেশি সময়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।তারও আগে এই একই ব্যক্তি নবাবগঞ্জে অনুরূপ আরেকটি অবৈধ মেলা করেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত