শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাধারণ এক অগ্রযাত্রার গল্প
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২১, ১৫:৫২ | আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:৩২
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে চারদিকে শত নেতিবাচক খবরের মাঝেও প্রবৃদ্ধিতে আশা জাগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। জিডিপির অগ্রগতিতে অনেক আগেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলার পর করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে গত বছর ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ ভারতকেও পেছনে ফেলেছে। মাত্রই কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের মাথাপিছু আয় এখন ২৮০ ডলার কম। ভারতের মতো একটা বিশাল অর্থনীতির দেশকে অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে টপকে যাওয়া অবশ্যই বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন। তদুপরি, গতবছর আইএমএফের আউটলুকে ভারতকে পেছনে ফেলার পর বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু বাংলাদেশের উত্থানের প্রশংসা করে বলেছিলেন- এমার্জিং ইকোনমির যে কোন দেশের এগিয়ে যাওয়া ভালো সংবাদ। কিন্তু মনে রাখতে হবে মাত্র ৫ বছর আগেও জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল।
অথচ ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি’ -১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। অন্যদিকে, ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন লন্ডন থেকে 'বাংলাদেশ দ্যা টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট' নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়ে তারা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যে কোন দেশই উন্নতি করতে পারবে।’ আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এককালের সেই পেছনের সারির দেশটিই আজ পূর্ণতার পথে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছে।
করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ধুঁকছে তখনও বাংলাদেশ রেকর্ড ৫ দশমিক ২শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। চলতি অর্থ বছরে তা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে গত ৩ জুন বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছেন। বর্তমান বিশ্বে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণ ও কার্যাবলী নিয়ে রীতিমত গবেষণা হচ্ছে এখন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে যে দেশটির এক কোটিরও বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার কারণে তারাই এখন মিয়ানমার থেকে ভয়ে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে পারছে। তাছাড়া সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বাংলাদেশ। যেভাবে ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেটি সাধারণত দুর্বল অর্থনীতির দেশকে দেয়া হয়। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ ও মাইলফলক হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্যা নিউজ ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত ‘এইড ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক নিবন্ধে বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা আবিদ হাসান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশংসা করে সম্প্রতি লিখেছেন, ২০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এটি ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হবে। তিনি আরও লিখেছেন, পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে ২০৩০ সালের দিকেই হয়তো বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সুপারিশ অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ সব উন্নত দেশের অর্থনীতি যেখানে দিশাহারা ও গতিহীন, সব দেশে যেখানে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে- সেখানে বাংলাদেশ কোন জাদুমন্ত্রবলে উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে, সমগ্র বিশ্বের কাছে এটাই এখন বিস্ময়ের কারণ। মূলত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করোনার বাজে প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত রেখেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদের হার কমিয়ে, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারে বিধিনিষেধ শিথিল করে দেশীয় শিল্পকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে দ্রুতই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। এই বিষয়ে বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদরাও গতবছর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বড় মাপের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা এবং নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও অর্থনীতি খুলে দেওয়ার মতো সরকারের সাহসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করছে।
মূলত, গত এক যুগে শেখ হাসিনার শাসনামল বাংলাদেশের এ বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উত্থানে মূল ভূমিকা পালন করছে। এ সময়কালে দেশের অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে গেছে, তিনগুণেরও বেশি বড় হয়েছে জিডিপি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন নতুন রেকর্ড অর্জন করেছে। ছাড়িয়েছে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। নির্মাণ হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে হয়েছে বিস্ময়কর উন্নয়ন। এর ফলে দ্যা ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম স্থান দখল করেছে। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাছে বাংলাদেশের এ সাফল্য বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে আছে। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। যারা একদিন এই দেশকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিল, তারাই আজ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ যে আজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব সূচকই তার সাক্ষ্য বহন করছে।
এই বিষ্ময়কর উত্থানের কারণে বাংলাদেশকে এখন ‘এশিয়ান টাইগার’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচ্চকিত প্রশংসা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসে। সেই নিবন্ধে করোনা মোকাবেলায় শেখ হাসিনার ওই সময়ের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলা হয়, করোনা মোকাবেলায় এগুলো এমন উদ্যোগ যা যুক্তরাজ্য তখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, সিঙ্গাপুরের অগ্রযাত্রার সাথে তার তুলনা চলে। এক যুগ আগের বাংলাদেশের সাথে বর্তমান বাংলাদেশের তুলনা করলেই পার্থক্যটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এসময় মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে সক্ষমতা। স্বপ্নের মেট্রোরেল হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এইচএসবিসি’র সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, বর্তমানে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ যেখানে বাংলাদেশের পেছনে থাকবে। অন্যদিকে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউবিএস জানিয়েছে, উন্নয়নের বর্তমান ধরা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৫০ সালে ১২তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
সিঙ্গাপুর স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল আগে সে দেশের নেতা লি কুয়ান ইউ মালয়েশীয় পার্লামেন্টে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা ছোট দেশ হতে পারি, সম্পদহীন হতে পারি, কিন্তু আমরা একদিন সিলোনের (শ্রীলঙ্কার পূর্ব নাম) মতো সমৃদ্ধিশালী দ্বীপরাষ্ট্র হব’। সেই সিঙ্গাপুরের বর্তমান অবস্থান সবার জানা। শ্রীলঙ্কার চাইতে প্রায় চার গুণ বড় তাদের অর্থনীতি। বাংলাদেশও শেখ হাসিনার গত এক যুগের শাসনামলে এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। বেশকিছু সামাজিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনীতির সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। মাত্র এক যুগ আগেও যে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় দ্বিগুণ ছিল, তারাও পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এক সময়ের কথিত 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আজ বিশ্ব দরবারে উদীয়মান অর্থনীতির রোল মডেল যার নেতৃত্বে, কৃতিত্ব তো সেই 'ক্যারিশমাটিক' নেত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে হবেই।
মর্তুজা হাসান সৈকতঃ প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত