শিশুশ্রম, ভয়ংকর বাস্তবতা ও পরিণতি

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০৫ |  আপডেট  : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:২১

বাংলাদেশে অধিকাংশ শিশু শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত। এই ধরনের শ্রম নিয়ন্ত্রণ এবং নিরীক্ষণ করা কঠিন। তীব্র দাবদাহ ও তীব্র গরমে যখন অতিষ্ঠ মানুষ, তখন বিপাকে পরে খেটে খাওয়া  শিশুরা। প্রচন্ড তাপদাহের কারনে খেটে খাওয়া শিশুরা কাজ করতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করে এবং হয় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।  ২০২২ সালে, সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন নং ১৩৮ কর্মসংস্থানে ভর্তির ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন এবং বাধ্যতামূলক শ্রম কনভেনশনে ২০১৪ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রোটোকল অনুমোদন করেছে। তবুও বাংলাদেশের শিশুরা সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশুশ্রম যেমন, মাছ শুকানো , ইট তৈরী, গার্মেন্টস এবং চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ইত্যাদি শ্রমে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য অনুসারে কোভিট-১৯ মহামারীর আগে বিপজ্জনক খাতে ১২.৮ লক্ষ শিশু কাজ করত, যার মধ্যে ২.৬ লক্ষ শিশু সরকারীভাবে তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কাজ করত। অর্থনৈতিক সমস্যা, মহামারীর সময় স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে অনেক স্কুল বয়সী শিশু, পোশাক এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাত সহ কারখানায় অস্থায়ী চাকরি করতে বাধ্য হয়। একটি এনজিও রিপোর্ট অনুসারে সেসময়ে ৭৫ শতাংশ শিশু তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ছেড়ে দেয় ।

শিশুরা সারাদিন কোন রকম প্রতিরক্ষামূলক উপকরণ ছাড়াই বিপদজ্জনক খাত যেমন ট্যানারি, শিপব্রেকিং, শুকনো মাছ শিল্পে কাজ করে। ফলে তারা কীটনাশক ডিডিটি (ডিক্লোরো-ডিফেনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন), লবণের সংস্পর্শে, শিপব্রেকিং সেক্টরে অ্যাসবেস্টসের মতো বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে, ট্যানারিতে তারা ভারী ধাতু, ফর্মালডিহাইড এবং অন্যান্য বিপজ্জনক পদার্থের সংস্পর্শে আসে। পোশাক শিল্পে কর্মরত শিশুরা দিনে ১৬ ঘন্টা কাজ করে । পথশিশুদের অপরাধমূলক কাজে বাধ্য করা হয় বা ভিক্ষা করতে বাধ্য করা হয় এবং দুর্বৃত্তরা ভিক্ষাবৃত্তির জন্য শিশুদের পঙ্গুও করে।  বাংলাদেশে দরিদ্র কন্যা শিশুরা বৈধ ও অবৈধ পতিতালয়ের মাধ্যমে যৌন শোষণের এবং গৃহকর্ম সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হয়। এরফলে শিশুশ্রমে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে।

শিশুশ্রম শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করে, তাদের অধিকার এবং তাদের ভবিষ্যৎ সুযোগ সীমিত করে। ফলে দারিদ্র্য ও শিশুশ্রম শিশুদের অপরাধী হেতে উৎসাহিত করে। দারিদ্র্যর কারণে শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়। পিতামাতার বেকারত্ব বা নিম্ন আয় শিশুদের কাজ করার সম্ভাবনা বাড়ায়। সামগ্রিকভাবে, শিশুশ্রম একটি উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে উঠেছে। বিপজ্জনক সরঞ্জামের মাঝে দীর্ঘ সময় কাজ করা এবং কর্মক্ষেত্রে শোষণ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়েছে। বর্তমানে শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৩৪.৫ লক্ষ শিশু, যাদের বয়স ৫-১৭ বছর।  

শিশুশ্রম শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর, তাদের শৈশব, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং আত্মমর্যাদা থেকে তাদের বঞ্চিত করে। পাশাপাশি দেশের একটি সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে ধ্বংস করে। তবে অবশ্যই, শিশুদের সমস্ত কাজ শিশুশ্রমের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না। যদি কাজটি শিশুকে স্কুলে যেতে বাধা না দেয়, তাদের অকালে স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য না করে বা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত না করে, তবে সে শ্রম শিশুর উপকারী হতে পারে। কারণ শিশুরা কাজের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন করতে পারে, কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।

শিশুরা যে জাতির সম্পদ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেকোনো জাতির ভবিষ্যৎ তার প্রজন্মদেরে উপর নির্ভর করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের দারিদ্র্যর প্রেক্ষাপটে শিশুরা বাধ্য হয় তাদের শৈশবে জীবিকার জন্য কাজ করতে। এই নিষ্পাপ শিশুদের বাস্তব জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এই নিষ্ঠুর সমাজে তাদের শৈশবকে বলি দিতে হয়। এটিও লক্ষণীয় যে ছোট বয়সের শিশুরা যখন কাজ করতে শুরু করে তখন এটি তাদের মানসিক সংকটের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। তারা অনেক জটিলতার এবং অনেকসময় শারীরিক, যৌন ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়। শিশুশ্রম শিশুদের তাদের শৈশব থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করে। শিশু শ্রমিকরা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এই বঞ্চনা তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। তারা সমাজের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা, ও আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বড় হতে থাকে। অবশেষে তারা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং এর আধিক্য এর একটি ফালাফল। কারণ যে বয়সে শিশুদের আদর পাওয়া উচিত, শিশু যখন নম্যতা, আচার-ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গি শিখবে, তখন সে পেটেয় দায়ে বা পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়। তারা কঠিন কাজ করে সবচেয়ে কম বেতন পায়। শিশুশ্রমে জড়িত শিশুদের পরবর্তী জীবনে খারাপ স্বাস্থ্য হয়। বিপজ্জনক কাজের প্রভাব গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়। ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যাকপেইন হতে পারে। এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর শিশুশ্রমের অধিক প্রভাব রয়েছে। এমন শিশুদের কাছ থেকে আমরা কীভাবে একটি গৌরবময় ভবিষ্যৎ আশা করতে পারি?

 

লেখকঃ অভিজিৎ বড়ুয়া অভি
কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত