লৌহজংয়ের পত্রিকার হকার গৌরাঙ্গ সাহা ধুসর স্মৃতি 

  মুনীর মোরশেদ

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩৩ |  আপডেট  : ১৯ মে ২০২৪, ১৬:৩৫

সন্ধ্যালগ্নে ধবল জ্যোৎস্নার মতো হ্যাজাকলাইটের উজ্জ্বল আলোয় স্কুল আঙ্গিনায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা আমরা শিক্ষার্থীরা দেখতে পাই পুবের চিরলপথ,খেলার মাঠ পেরিয়ে অলৌকিক মানুষের মতো ধীরলয়ে এগিয়ে আসছেন প্রধান অতিথি মহকুমা প্রশাসক হেদায়েতুল হক,সার্কেল অফিসার,প্রধান শিক্ষক সুলতান আহমেদ এবং আরও কেউ কেউ।সজ্জিত তোরণ দিয়ে প্রবেশ করে তাঁরা।আমরা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে,মুহুর্মুহু করতালি আর প্রশংসাসূচক শ্লোগান দিয়ে তাঁদের বরণ করি।অতিথিরা সরাসরি চলে যান প্রধান শিক্ষকের কক্ষে।আমরা পারফর্মাররা প্রবেশ করি ক্লাস থ্রি'র শ্রেণিকক্ষে,যেটি নির্ধারিত ছিল গ্রিনরুম রূপে।যে রুম দিয়ে পারফর্মাররা প্রবেশ করবে মূল মঞ্চে।

গ্রিনরুমে ঢুকে আমি বিস্মিত হই লৌহজংয়ে একমাত্র সংবাদপত্রের হকার গৌরাঙ্গ সাহাকে দেখে।যিনি রূপসজ্জার যাবতীয় উপকরণ টেবিলে সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন।গৌরাঙ্গ সাহা যে একজন মেকআপ ম্যান আমি তা জানতাম না।শুধু আমি কেন,সবাই জানে গৌরাঙ্গ সাহা একজন রসিক হকার।দিঘলীবাজারের সন্নিকটে ঐতিহাসিক গান্ধীর মাঠ লাগোয়া তাঁর বাড়ি।তাঁর বাড়ি লাগোয়া লৌহজংয়ের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আফসারউদ্দিন বেপারীর বাড়ি।

রাজধানী ঢাকা থেকে লৌহজংয়ে লঞ্চযোগে একদিন পর পৌঁছাত দৈনিক পত্রিকা।ঢাকা থেকে লৌহজং পৌঁছাতে সময় লাগত আট ঘণ্টা।তামাম লৌহজং থানায় সংবাদপত্রের একমাত্র হকার গৌরাঙ্গ সাহা।একটি সুসজ্জিত সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে বিশেষ কায়দায় লাগানো লাল রঙের কাঠের বাক্সে সংবাদপত্রগুলো ভাঁজ করে রাখা হতো।বাক্সের চারপাশে লেখা আজাদ, মর্নিং নিউজ, ইত্তেফাক ও সংবাদ-এর নাম।পত্রিকাগুলোর গ্রাহক থানার বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং দুটি হাইস্কুল এবং স্বল্প সংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তি।আমাদের ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলে প্রথমদিকে রাখা হতো বাংলা দৈনিক আজাদ ও ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ। পরের দিকে এ দুটি দৈনিকের জায়গায় স্হান পায় ইত্তেফাক ও অবজারভার।

মানুষকে আকর্ষণ করার এক সম্মোহনী শক্তি ছিল গৌরাঙ্গ সাহার।নিজের সজ্জিত সাইকেলে চড়ে তিনি যখন তাঁর নির্ধারিত গ্রাহকদের কাছে সংবাদপত্র পৌঁছে দিতে যেতেন তখন তাঁর পরিধানে থাকত মোটা কাপড়ের একটি কালো হাফপ্যান্ট,গায়ে ইন করা লাল শার্ট, মাথায় লালটুপি।মুখে লালচোঙ্গা লাগিয়ে আকর্ষণীয় কায়দায় 'খ-ব-র' 'খ-ব-র' ধ্বনি তুলে সাইকেল চালাতে চালাতে তিনি ছুটতেন দিঘলীবাজার থেকে পাঁচ মাইল দূরের হলদিয়াবাজার অবধি।এমনকি কখনও কখনও হলদিয়াবাজার ছাড়িয়েও ছুটে যেতেন শিমুলিয়াবাজার।যে রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে তিনি যেতেন তাঁর বিশেষ ধ্বনির শব্দে শিশরা ছুটে আসত সে-পথে।তাঁকে দেখে কী যে আনন্দ পেতো শিশুরা।আমি নিজেও ছিলাম সে আনন্দের ভাগী।

সে যাই হোক,আমার মতো বালকের মাথায় হ্যাট দেখে গৌরাঙ্গ সাহা নিশ্চিত হন যে, আমি একজন পারফর্মার।আমি 'নবাবপুরের নবাব' নামে একটি ছড়া পাঠ করব জেনে তিনি আমার মুখাবয়বে পাউডারের হালকা প্রলেপ এবং একটি চিকন কৃত্রিম গোঁফ লাগিয়ে দেন।

ঠিক আধঘণ্টা পর শুরু হয় অনুষ্ঠান।মঞ্চে আরোহণ করেন প্রধান অতিথি মহকুমা প্রশাসক হেদায়েতুল হক,সার্কেল অফিসার(উন্নয়ন) ও প্রধান শিক্ষক সুলতান আহমেদ।

নেপথ্যে বেজে ওঠে হারমোনিয়ামের সুর।সাধন স্যার গেয়ে ওঠেন রবীন্দ্রসঙ্গীত 'হে ক্ষণিকের অতিথি...'।মঞ্চের দু'পাশ থেকে পঞ্চম শ্রেণির আসিয়া বেগম,চতুর্থ শ্রেণির গুলশান আরা বন্যা এবং আরও একজন গানের অনুরণনে মালা হাতে ধীরলয়ে প্রবেশ করতে করতে অতিথিদের গলায় মালা পরিয়ে দেয়।

এই আসিয়া বেগম আমার বোন গুলশান আরা বন্যা'র একক্লাস সিনিয়র হলেও তারা ছিল প্রাণের সখী।সাধন স্যার আসিয়ার নাম দিয়েছিলেন লতা আর বন্যার নাম দিয়েছিলেন পাতা।লতা-পাতার মতোই নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাদের।অথচ পরের বছর,আসিয়া বেগম যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী, সেই ১৯৬৫ সালে কোনো এক বর্ষায় আসিয়া বেগমের বিয়ে হয়ে যায়।সেদিন সখী হারিয়ে আমার নিকট-অগ্রজ বন্যা একাকী আকুল হয়ে কেঁদেছিল। খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন কনকসার গ্রামের নওয়াব আলী খলিফার কন্যা আসিয়া বেগম।বাল্যবিয়ে হলেও পড়ালেখায় হাল ছাড়েননি। পর্যায়ক্রমে এসএসসি, এইচএসসি এবং স্মাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের অফিসার হয়েছিলেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত