রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১, ১৩:০৭ |  আপডেট  : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১১

করোনা মহামারীর এই দুর্যোগে প্রতিদিন মৃত্যুসংবাদ আমাদেরকে হতবিহ্বল করে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান মৃতের সংখ্যা অনাগত ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে সবার। এই বেড়ে চলা মৃত্যুর মিছিলে আগুনে পোড়া ৫২টি লাশ বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে গোটা জাতিকে। চলমান এই দুঃসময়ে এমন একটি ভয়াবহ মৃত্যুযজ্ঞের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও সেই শোকাবহ ঘটনা আমাদেরকে দেখতে হলো, শুনতে হলো স্বজনহারাদের মর্মভেদী বিলাপ।

নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড এন্ড বেভারেজের কারখানায় ৮ জুলাই সন্ধ্যায় সৃষ্ট অগ্নিকান্ডে সর্বমোট নিহত হয়েছে ৫২জন শ্রমিক। এদের সবার দেহ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা লাশগুলো উদ্ধার করলেও নারী-পুরুষ পার্থক্য করার কোনো উপায় নেই। পোড়া কংকালের ডিএনএ টেস্ট ছাড়া এদের পরিচয় উদ্ধারেরও কোনো উপায় নেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় আগুন লাগার পরই তা দ্রæত ওপরের দিকে ছড়াতে থাকে। এ সময় অনেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে ছয়তলা ভবনটির ছাদে উঠে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদেরকে মই দিয়ে উদ্ধার করেন। আহতদের চিকিৎসা চলছে স্থানীয় একটি হাসপাতাল ও ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। খবরে বলা হয়েছে, ভবনটির নিচতলায় নানা ধরনের কেমিক্যাল ও দাহ্য পদাথের্র গোডাউন ছিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। তবে, ওই ভবনে কেমিক্যালসহ ওইসব পদার্থের গুদাম ব্যবহারের কোনো অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। তাছাড়া ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না বলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ভবনটির চতুর্থতলার কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় ওই ফ্লোরের শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। তাছাড়া ভবনটির নিচতলার গেটও বন্ধ ছিল। 

মর্মান্তিক এ মৃত্যুযজ্ঞ আমাদেরকে ভারাক্রান্ত করার পাশাপাশি যে প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে তাহলো, এমন ঘটনা কি ঘটতেই থাকবে? অগ্নিকান্ডের ঘটনা আমাদের দেশে বিরল নয়,। প্রায়ই ছোটবড় অগ্নিকান্ডের খবর আমরা পাই। কয়েক বছর আগে রাজধানীর নিমতলীর অগ্নিকান্ডের বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওইসব ঘটনা থেকে আমরা কতটুকু শিক্ষা নিয়েছি? একটি ঘটনার পর তা নিয়ে হইচই-আলোচনা হয়, নানা রকম বিজ্ঞ মতামত শোনা যায়, সরকারি প্রশাসনের হুংকারও কর্ণগোচর হয়। তারপর সব সুনসান। অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যেসব নির্দেশ সরকারি দপ্তরগুলো থেকে সময়ে সময়ে জারি করা হয়, তার কতটা প্রতিপালিত হচ্ছে সে হিসেব আর রাখা হয় না। নেই কোনো নজরদারিও। যাদের দায়িত্ব এসব দখাশোনা করার, তারা কী করছেন সে হিসাব কে নেবে? আবাসিক ভবন, কারখানা কিংবা বানিজ্যিক ভবন, সব স্থাপনার ক্ষেত্রেই বিল্ডিং কোড অনুসরণ বাধ্যতামূলক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ সেসব নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করছে কী না তা দেখভালের জন্যও সরকারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। নিয়মিত পরিদর্শন করে সেসব নিরাপত্তামূলক নির্দেশনা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তা করা হয়। অবহেলা, অসতর্কতা, বিল্ডিং কোড না মানার জন্য হাশেম ফুড কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হবে সন্দেহ নেই। পাশাপাশি এসব দেখার দায়িত্ব যাদের ছিল, তারাও জবাবদিহির বাইরে যেতে থাকতে পারে না। কর্তব্যে অবহেলার জন্য ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। 

নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলেছে হাশেম ফুড কর্তৃপক্ষ। সরকারের পক্ষ থেকেও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর কি কোনো ক্ষতিপূরণ হয়? একটি জীবনের দাম কি পৃথিবীর সম্পদ দিয়েও মেটানো সম্ভব? যে জীবনপ্রদীপগুলো আগুনে পুড়ে নিভে গেল সেগুলো তো আর ফিরে আসবে না। তাদের স্বজনরা কিছু নগদ অর্থের মধ্যে কি স্বান্ত¦না খুঁজে পাবে।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই আমরা মন্তব্য করি- এমনটি আর না ঘটুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্যি যে, প্রতিনিয়ত একই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার দর্শী আমাদেরকে হতে হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। তবে, সে দুর্ঘটনা যাতে ভয়ংকর রূপ ধারণ না করে বা এর ক্ষয়ক্ষতি যাতে ব্যাপক না হয়, সে ব্যাপারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা পূর্বাহ্নেই গ্রহণ করা দরকার। আইনের কঠোর প্রয়োগই এ ক্ষেত্রে কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারে। 

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডিতে নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমারা গভীর সমবেদনা জানাই।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত