'মুজিব একটি জাতির রূপকার'

  কেশব মুখোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ১০:৩৭ |  আপডেট  : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:১৫


(কিছু অনুভব)
""""""""""'''''''''''''''"""""


বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে, তাঁর ম্যুরাল (Mural) প্রতিকৃতি আক্রান্ত হয়েছে, কোথাও পোস্টার দিয়ে, মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে, প্রতিকৃতি  । কোথাও তাঁর স্ট্যাচু বা ভাস্কর্য  ভাঙা হয়েছে । এসব ঘটেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ যখন শাসন ক্ষমতায় এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী !

রাজধানীর ঢাকায় সরকারবিরোধী অবস্থানে 'আমি রাজাকার' লেখা পোস্টার নিয়ে যুবক- যুবতীদের  অবস্থান করতে দেখা গেছে  । অবশ্য সম্প্রতি এর বিপরীতে দেখা গেল আশাপ্রদ পোস্টার, 'যতবার তোরা রাজাকার হবি, আমরা ততবার  মুক্তিযোদ্ধা হবো'। 

এই পটভূমিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র  'মুজিব / একটি জাতির রূপকার' তৈরির কাজ সম্পূর্ণ  হয়ে মুক্তির দিন গুণছে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন, ভারতের স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল (Shyam Benegal) । ইতোমধ্যে প্রদর্শিত  ছবির Trailer নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা / সমালোচনা । বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনেতা আরিফিন শুভ-র নির্বাচন সঠিক  কি না, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে  । বইয়ের মলাট বা ভূমিকা পড়ে যেমন বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে সার্বিক আলোচনা সম্ভব নয়,  তেমনি কোনো চলচ্চিত্রের Trailer দেখে ছবিটি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করাও ঠিক নয়।

'মুজিব / একটি জাতির রূপকার' ছবির পরিচালক শ্যাম বেনেগাল তাঁর প্রথম ছবি 'অঙ্কুর' (হিন্দি) নির্মাণ করেন ১৯৭৩ সালে । অনেকের মতে 'অঙ্কুর' তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি । পরবর্তী সময়ে ওই মানের ছবি তিনি আর নির্মাণ করতে পারেনি । তাঁর পরিচালনায় নির্মিত  নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু-র জীবনীভিত্তিক ছবি (Netaji / The forgotten Hero) নিয়েও নানান সমালোচনা হয়েছে, আছে । অবশ্য কোনো শিল্পই হয়তো সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় ।

সত্যজিৎ রায়ের অনুরাগী এই পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। শ্যাম বেনেগালের  কোনো লেখায় বা সাক্ষাৎকারে পড়ে ছিলাম ১৯৫৫ সালে 'পথের পাঁচালী'  যখন কলকাতায় মুক্তি পায়, তখন তরুণ শ্যাম বেনেগাল ছিলেন কলকাতায় । পথের পাঁচালী সম্পর্কে শুনে তিনি ছবিটি দেখতে যান । বাংলা ভাষা জানা না থাকায় ছবির সংলাপ তিনি বুঝতে পারেননি । তা সত্ত্বেও ছবিটি তাঁর এত ভালো লাগে যে, তিনি সেই সময় ১০/১২ বার 'পথের পাঁচালী' দেখেন ।

শ্যাম বেনেগাল আমাদের দেশের একজন প্রথম সারির চিত্রপরিচালক । 'মুজিব / একটি জাতির রূপকার' ছবির কাজ শুরু পূর্বে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তারপরেও বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক ছবি নির্মাণে তিনি উপযুক্ত ব্যক্তি কি না, তা নিয়ে একজন সাধারণ বাঙালি বা দর্শক হিসেবে আমার কিছুটা আশঙ্কা যে রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । সেই আশঙ্কা  'মুজিব/একটি জাতির রূপকার' ছবির Trailer দেখে দূর না হয়ে বজায় আছে বইকী ।

চিত্রপরিচালায় দক্ষতাই চলচ্চিত্রের পর্দায় বঙ্গবন্ধুর চিত্র যথার্থভাবে তুলে ধরার প্রশ্নে, শেষ‌ কথা হতে পারে না । পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বঙ্গবন্ধু  একটি দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছেন । কিন্তু তিনি শুধু বাংলাদেশের মানুষের আবেগ নন, সমগ্র বাঙালি জাতির আবেগের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে আছে ।
  


ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের রাজনৈতিক দর্শনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি চেতনার উৎসমূলে অবস্থান করে তিনি বলেছেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'।

ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম লিগের যে আন্দোলন, দলের যুব- ছাত্র নেতা হিসেবে তাতে সক্রিয় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী সময়ে সেই মানুষ কীভাবে নানা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে, ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করেছিলেন, তা শুধু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস পাঠের দ্বারা সম্পূর্ণ জানা বা উপলব্ধি করা সম্ভব নয় বলেই মনে করি ।

এর জন্য প্রয়োজন বাংলা ও বাঙালি সত্তার চর্চা ও অনুশীলন । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়,  'এই যে বাংলাদেশ ইহার মৃত্তিকা, ইহার জল, ইহার বায়ু, ইহার আকাশ, ইহার বন, ইহার শস্যক্ষেত্র লইয়া আমাদিগকে সর্বতোভাবে বেষ্টন করিয়া আছে ------'।  বাংলার মাটি, জলবায়ু, নদ-নদী, জনগণের জীবনযাপন  ইত্যাদি বিষয় বা ভাবনা - চিন্তা পরিচালকের হৃদয় -মনে ক্রিয়াশীল না থাকলে, তাঁর পক্ষে বঙ্গবন্ধু চরিত্রের সার্বিক চিত্ররূপ তুলে ধরা সম্ভব হবে কি - না প্রশ্ন থেকে যায় ।

এই প্রসঙ্গে নানা সময়ে বলা সত্যজিৎ রায়ের একটি অনুভবের কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করি ।  দেশ-বিদেশ থেকে নানা সময়ে নানা অনুরোধ সত্ত্বেও, সত্যজিৎ রায় বাংলা ভাষা এবং বাংলার পটভূমির বাইরে কোনো ছবি পরিচালনা করতে আগ্রহী ছিলেন না। বিভিন্ন সময়ে নানা জায়গার  নানা অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন । কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, যে ভাষা তাঁর সম্পূর্ণ আয়ত্তে নেই এবং যে সমাজ - প্রকৃতিকে তিনি পরিপূর্ণভাবে জানেন না, সেই পটভূমিতে কোনো ছবি পরিচালনা করতে তিনি অক্ষম। তেমন ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে তিনি খেই হারিয়ে ফেলবেন ।

যতদূর মনে পড়ে, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ঢাকার পল্টন ময়দানে সত্যজিৎ রায়কে  দেওয়া এক গণসংবর্ধনা সভায়ও তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন ।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং মৌলানা আজাদ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ ডব্লিউ মাহমুদ প্রায় তিন দশক আগে আমাকে বলেছিলেন, '... বাংলা ভাষা জানলেই রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এরজন্য প্রয়োজন বাঙালি হওয়া । তবে শুধু বাঙালি হলেই হবে না, যার মধ্যে বাঙালিত্ব নেই তিনিও রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মে পৌঁছাতে অক্ষম । বাঙালিত্বকে যিনি হৃদয়ে ধারণ করেন, তাঁর পক্ষেই সম্ভব রবীন্দ্রনাথের গানকে হৃদয়ে গ্রহণ করা এবং গানের মর্মে পৌঁছানো ।  কারণ বাঙালিত্ব এবং রবীন্দ্রনাথ অভিন্ন ।'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কেও কথাটা সমান সত্য বলে মনে করি ।

২৫ মে ২০২২, কলকাতা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত