মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস জাতীয়ভাবে পালন করা উচিত
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৩, ১১:০৩ | আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:২১
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। এই দিন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে জয়দেবপুরে বীর জনতা পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিলেন। এই সশস্ত্র প্রতিরোধে পাকিস্তান সৈনিকদের গুলিতে মনু খলিফা, হুরমত, নিয়ামত ও কানু মিয়া শাহাদাৎ বরণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এটাই ছিল বাঙালি জনতার প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ।
গাজীপুরের তৎকালীন নাম ছিলো জয়দেবপুর। ভাওয়াল রাজবাড়ীতে অবস্থান ছিল তৎকালীন পাকবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। ১৯ মার্চ সকালে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব এক কোম্পানী সৈন্যসহ জয়দেবপুর সেনানিবাসে উপস্থিত হন। এ সময় এ রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করা হবে এমন সংবাদে পাকিস্তানীসেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে গাজীপুরের মুক্তিকামী সর্বস্তরের জনতা।
তারা রাজবাড়ী সড়কে তৈরী করে দূর্ভেদ্য অবরোধ। রেলস্টেশন থেকে মালগাড়ির একটি ওয়াগন এনে রাস্তা বন্ধ করে দেন। সংগ্রাম পরিষদের ডাকে রাস্তায় রাস্তায় ব্যাড়িকেড দেয় বীর জনতা। পাকবাহিনী জয়দেবপুর বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে পৌঁছালে জনতা তাদের কাছ থেকে ৪টি চাইনিজ রাইফেল ও একটি স্টেনগান কেড়ে নেয়। হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালায়। জবাবে মরহুম কাজী আজিম উদ্দিন মাস্টারের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে পাল্টা গুলি চালানো হয়। সেদিন পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিকামী জনতার লড়াইয়ে তিনজন নিয়ামত আলী, মনু খলিফা ও হুরমত আলী শহীদ হন।
এদিকে জয়দেবপুর, বটতলা ব্যাড়িকেট ভেঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার পথে পাক সৈন্যরা চান্দনা চৌরাস্তায় শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখানে পাকসেনারা নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় ভোগরা গ্রামের সাহসী যুবক ফুটবলার হুরমত আলী এক পাকসেনার রাইফেল ছিনিয়ে নিতে গিয়ে অপর একসেনার গুলিতে শহীদ হন। কানু বীরসহ অনেকে আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কানুবীর।
এই সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা বাংলায় স্লোগান উঠে “জয়দেবপুরের পথ ধরো— বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। যা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি এর নেতৃত্বে এই সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে গাজীপুরের বীর জনতা অংশগ্রহণ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশ স্বাধীন ও মুক্তির আন্দোলনে উত্তাল হতে শুরু করে। মার্চের প্রথম দিকে জয়দেবপুরে গঠন করা হয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হককে এই পরিষদের অ্যাকশন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়।
১৯ মার্চ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের শহীদদের আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরই নির্দেশে ১৯ মার্চ বীর জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হাওয়ার এতো বছর পরও এই দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে না। এই দিবসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয়ভাবে পালন করা উচিত। তাহলে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস আরো সমৃৃদ্ধ হবে। প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে শহীদ এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের যথাযথ সম্মান দেয়ার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথম সশস্ত্র প্ররোধ আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক। ১৯ মার্চের বীরত্বকে অমর রাখতে ১৯৭২—৭৩ সালে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় একটি ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়। জাগ্রত চৌরঙ্গী নামে এই ভাষ্কর্য মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে গাজীপুরে সংগঠিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের চেতনার আলোকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় এই ভাষ্কর্য।
১৯ মার্চ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধকে চিরঞ্জীব রাখতে গাজীপুরে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।
প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দানসহ মুক্তিযুদ্ধে ৯মাস বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেন। কাজেই আ.ক.ম. মোজাম্মেল হককে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা “বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা উচিত।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হককে স্বাধীনতা পদক ২০১৯ প্রদান করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।
বাঙালি জাতির ইতিহাসের একটি বড় অর্জন গাজীপুরের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা জরুরী। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস ১৯ মার্চকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয়ভাবে পালন করা উচিত। এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত