মাদারীপুরের প্রধান দুটি নদের পাড় কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্তরা : ভাঙ্গন আতঙ্কে গ্রামবাসী

  শফিক স্বপন, মাদারীপুর

প্রকাশ: ৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫৫ |  আপডেট  : ৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:২৫

মাদারীপুরের প্রধান দুটি নদ আড়িয়াল খা ও কুমার নদের পাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। মাদারীপুর জেলায় এ দুটি নদের কমপক্ষে ২০টি স্থানের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে । প্রতিদিন রাতের আঁধারে ও ভোরে অবৈধভাবে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে তারা। এতে করে ঐ সব গ্রামের মানুষ ফসলি জমি হারানোসহ নদীভাঙ্গণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। স্থানীয়রা একাধিকবার প্রশাসনকে জানালেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেয়া যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাচখোলা ইউনিয়নের উত্তর মহিষেরচর গ্রামের আড়িয়াল খা নদের পার থেকে স্থানীয় আবু চৌকিদারের ছেলে ইলিয়াজ চৌকিদার তার নিজস্ব লোকজন নিয়ে রাতের আধারে আবার কখনও ভোর ৫ টা থেকে সকাল ৮ পর্যন্ত মাটি কেটে ট্রলারে করে নৌপথেই সেই মাটি নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তার নিজস্ব জমি থেকে মাটি কাটলেও পরবর্তীতে স্থানীয় মো. খলিল চৌকিদার, মো. বাবুল চৌকিদারের জমি থেকেও মাটি কাটা হয়েছে। তারা ইলিয়াজ চৌকিদারকে মাটি কাটতে না বলেও তা শোননি। এদিকে নদের পাড়ে মাটি কেটে গর্ত হবার কারণে পাশেই কাদের সরদারের লাউ, লাল শাখ, টমেটো, করোল্লাসহ তার সবজির বাগান ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও পাশেই মিন্টু সরদারের বসতবাড়িটিতে হুমকির মধ্যে আছে। এখনই মাটি কাটা বন্ধ না হলে পুরো গ্রামটি নদীভাঙ্গণের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
আরো জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাচখোলা ইউনিয়নের উত্তর মহিষেরচরের আড়িয়াল খা নদের পাড়ে ২টি স্থানে, একই ইউনিয়নের কাতলা বাহেরচরে ২টি স্থানসহ মাদারীপুর জেলায় কমপক্ষে ২০টি স্থানে নদীর মাটি কেটে চুরির একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে আরো আছে মাদারীপুর সদর উপজেলার রাজারচর, পখিরা, তিন নদীর মুখ, চর কালকিনি, চর হোগলপাতিয়া, চর ব্রাহ্মন্দীসহ আরো একাধিক স্থান। এসব স্থানগুলো থেকে রাতের অন্ধকারে ড্রেজার মেশিন আবার কোথাও কোদাল দিয়েও মাটি কেটে তা ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর এই মাটিগুলো বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে ইটভাটায়।

মাদারীপুর সদর উপজেলা পাচখোলা ইউনিয়নের উত্তর মহিষেরচর গ্রামের উত্তর মহিষেরচর শিকদার বাড়ি জামে মসজিদের ঈমাম মাওলানা আলমগীর শিকদার বলেন, আমাদের এই গ্রামে স্থানীয় ইলিয়াজ চৌকিদার রাতের আধারে আড়িয়াল খা নদের পাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় ইলিয়াজ আমাকে নানা ধরণের হুমকি দিয়েছে। এমনকি আমার চোখ তুলে ফেলারও হুমকি দিয়েছে।

মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা ইউনিয়নের মহিষেরচর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুজ্জামান সাইফ বলেন, আমরা এই ব্যাপারটি বহুবার প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু তবুও মাটি চুরি থামানো যায়নি। প্রতিদিনই রাতের আধারে তারা ট্রলারে করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রামের আড়িয়াল খা নদের ৪ থেকে ৫টি স্থানে এভাবেই মাটি কাটা হচ্ছে। এটা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে এই পুরো গ্রামটি হুমকির মধ্যে পড়বে।

আরেক বাসিন্দা মিন্টু সরদার বলেন, প্রতিদিন রাতেই এখান থেকে মাটি চুরি করে নিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি সব নদীগর্ভে চলে যাবে। আমরা এর প্রতিকার চাই।

একই এলাকার কাদের সরদার বলেন, আমার ফসলি জমির পাশে থেকেই মাটি কাটা হয়েছে। আমার জমিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাই আমার জমিও হুমকির মধ্যে আছে। তাছাড়া পাশে আরো আছে ইরি ধানের ক্ষেত। তাও হুমকির মধ্যে আছে।

স্থানীয় মো. বাবুল চৌকিদার বলেন, আমার প্রায় তিন কড়া জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে গেছে ইলিয়াস চৌকিদার। তাকে না বলেও তিনি তা শোনেন না।

আরেক ভুক্তভোগী খলিল চৌকিদার বলেন, আমার জমি থেকেও মাটি কেটে নিয়ে গেছে। রাতের আধারে মাটি চুরি হয়ে যায়। আর আমাদের এলাকায় এগুলো করছে ইলিয়াজ চৌকিদার। তাই এখনি এগুলো বন্ধ না হলে নদের পাড়ের ফসলি জমিগুলো এক সময় নদী গর্ভে চলে যাবে।

স্থানীয় শাজাহান চৌকিদার বলেন, আমার জমির পাশ থেকেও মাটি কাটা হয়েছে। এতে করে আমার ফসলী জমি হুমকির মুখে আছে।

নাম না প্রকাশে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মাঝে মাঝে প্রশাসনের অভিযান চললে তা সাময়িক প্রভাব ফেলে। এতে করে কয়েক দিন বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে আবার আগের মতোই অবৈধ মাটি তোলা শুরু হয়। তাই এই কাজে জোড়ালো ও টেকসই উদ্যোগ না নিলে স্থানীয়রা বিরাট ক্ষতির মুখে পড়বেন।

মাদারীপুরের স্থানীয় আইনজীবী আবুল হাসান সোহেল বলেন, নদী থেকে মাটি তোলা মানে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। এতে নদীর ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ক্রমান্বয়ে নদীভাঙন বাড়ে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চরাঞ্চলগুলো মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে। পাশাপাশি স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহল ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার। অবৈধ মাটি খনন বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এই মাটি কাটা বন্ধ করতে হবে।

মহিষেচর এলাকার অভিযুক্ত ইলিয়াজ চৌকিদার বলেন, আমি অনেক আগে মাটি কেটেছিলাম। কিন্তু এখন আর মাটি কাটি না। যখন দেখেছি মাটি কাটলে অন্যের ক্ষতি হয়, তখন থেকে আর এই কাজ আমি করছি না।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক আফসানা বিলকিস বলেন, ইতিমধ্যেই এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা একাধিকবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। যারা নদীর মাটি কাটছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত