অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া
বিক্রমপুরের চলিষ্ণুবিদ্যাকল্পদ্রুম
প্রকাশ: ৩ জুলাই ২০২২, ১০:৩৮ | আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:২৭
শাশ্বত স্বপন
-----------------
আজ তিনি অসুস্থ, তাকে দেখলে মনে হয়, ইতিহাসের নূহ নবীর নৌকায় তিনি তার ঘর-বসতিসহ বিক্রমপুরের সব কিছু নিয়ে চলেছেন, ঘাটে ঘাটে নৌকা থামাচ্ছেন। ইতিহাসে যেখানে যা ছিল, সেখানেই নোঙ্গর করে ঠিক জায়গা মতো সেই ইতিহাসটুকু রেখে যাচ্ছেন। আমরা সবাই তার কথা মতো ইতিহাসের ঘাটে ঘাটে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছি। শেষ ঘাটে তার গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য, মনে হলো, নূহ নবীর বিশাল বড় নৌকা ত্যাগ করে, জী্বনের সবকিছু দান করে, বিক্রমপুরের বিখ্যাত টলটল ঠাকুরের বাইচের নৌকা নিয়ে মন পবনের বৈঠা ঠেলে মন পথিক একাই চলেছেন, ঘন ঘোর অমাবশ্যার অন্ধকারে, অজানা কোনো ইতিহাসের সাগরে।
আমার বিশ্বাস, বিক্রমপুরের ইতিহাস লেখক শ্রী অম্বিকা চরণ ঘোষ, শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রী হিমাংশু মোহন চট্টোপাধ্যায়-- এদের পরেই তার নাম বিক্রমপুরের উত্তর পুরুষেরা অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
মিটফোর্ট হাসপাতালের বহির্বিভাগে চার বছরের বেশি সময় ধরে একই পদে একই রকম কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছি। তাই ভিন্ন পদে ভিন্ন স্বাদ নিতে স্বেচ্ছায় বনবাসে যাবার মত সিদ্ধান্ত নিতে থাকি। অনেক চিন্তা করে একদিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, সহকারী অধ্যাপক, চলতি দায়িত্ব নিয়ে বরিশালই যাব, কারণ ঢাকাতে চলতি দায়িত্ব সরকার দিচ্ছে না। ঢাকার বাহিরে যেতে চাই, সেটাও সহজে হচ্ছে না। বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ অধ্যাপকের স্বাক্ষর করা শিক্ষকের জরুরি চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েও কোন কাজ হলো না। মাঝে মাঝেই অফিস সময়ের পরে মন্ত্রী-পরিষদ সচিবের একান্ত সচিব কাজী নিশাত রসুল আপার কাছে সচিবালয়ে ঢোকার পাস চাইতে হয়। আপা আমাদের ২২তম বিসিএস ফোরামের সভাপতি, তিনিও আমার জন্য চেষ্টা করেছেন।
বারবার সচিবালয়ে এভাবে যেতে যেতে পার-১ এর স্টেনোগ্রাফার কাম অফিস সহকারী মমিন ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। একদিন তিনি বললেন, গোপালগঞ্জ যাবেন? আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজী হলাম। পার-১ এর উপসচিব মইনউদ্দিন আহমেদ স্যারের স্বাক্ষরিত আদেশের কপি নিয়ে ২০১৪ সালের ১৩ ই মার্চ গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজে যোগদান করলাম।
সেখানে যোগদান করার পর বুঝতে পারলাম, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে ভুল করে ফেলেছি। নতুন মেডিকেল কলেজের বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। পুরাতন হাসপাতালের বিল্ডিং-এ নতুন কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম ও হাসপাতালের রোগী সেবা একসাথেই চলছে। এখানে আমার বসারই জায়গা নেই। তবে এখানকার অধ্যাপক ডা. এস.এম. মঈনউদ্দিন আহমদ স্যারকে আমার খুব ভালো লাগল, তিনি সৎ ও প্রগতিশীল মানুষ। আমার জন্য তাঁদের সাথে বসার এবং জঙ্গলাকীর্ণ একটা একতলা দালানে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেছেন।
বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে আমার একজন প্রিয়, শ্রদ্ধের বড় ভাই ডা. শেখ শাহরিয়ার ফয়সাল ২০১৩ সালে বরিশালে যোগদান করেছেন। একসাথে চাকুরি করার জন্য বরিশালে আবার যাবার চেষ্টা করলাম, কিন্ত হলো না। এখন নিয়মিত গোপালগঞ্জ থেকে বরিশালে প্রুফেশনাল পরীক্ষা নিতে যাই। আর ঘন ঘন ঢাকায় আসি, নিয়মিত প্রমোশনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পার-১ এ ঘোরাঘুরি করি। সুযোগ পেলেই অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মাদারীপুরের বাসুদেব গাঙ্গুলী স্যারের সাথে দেখা করি।
এমনি একদিন রুমে ঢুকে নিজের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে পার-১ এর উপসচিব মইনউদ্দিন আহমেদ স্যারের সাথে পরিচয় হয়। পরিচিত হয়ে তো অবাক, মনে হলো এতদিনে ঈশ্বর আমার মুখ পানে চেয়েছেন। তিনি আমাদের এলাকার মানুষ, আমি আগে জানতামই না। ঝাউটিয়া আর কনকসার লৌহজং থানার কাছাকাছি দুটি গ্রাম। ঝাউটিয়া বহু বছর আগেই পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে, তিনি এখন তার গ্রাম কনকসারই বলেন। তার আত্মীয়-স্বজন অনেকেই কনকসারের বাসিন্দা। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সাবেক সদস্য ড. নূহ-উল আলম লেনিন ভাইয়ের সম্পর্কে বিয়াই। তার আপন বড় ভাই মো. শাহজাহান মিয়া, যিনি অধিকাংশ সময় গ্রামেই থাকেন, তার সম্পর্কে কিছু বলেন।
আমি খুশিতে আটখানা হয়ে লেখক, কবি সুমন্ত দাদাকে ফোন দিই। তার আমন্ত্রণে বিক্রমপুর জাদুঘর উদ্বোধন উপলক্ষে শ্রীনগরে বালাশুর জমিদার বাড়ি যাই। সুমন্ত দাদা অধ্যাপক মো. শাহজাহান স্যারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। স্যারদের সব ভাই-ই মেধাবী। দুজন আমেরিকায়, তার মধ্যে একজন রাশিয়া ফেরত বিখ্যাত লেখক ও চিকিৎসক শাহাব আহমেদ, আরেক ভাই বনবিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত অফিসার মো. দেলোয়ার হোসেন, তিনি একজন কবিও। আর মইনউদ্দিন স্যার শুধু বড় অফিসারই নয়, লেখকও। আর শাহজাহান স্যার? সেজন্যই তো এই ভূমিকা। আমার জানা স্যারের কর্মজীবনের অতি সামান্য অনুভূতি বর্ণনার জন্যই নিবন্ধের শুরুতে পরিচয় পর্বের এই অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো বলতে হলো।
২০১৪ সালে জুন/জুলাই মাসের কোনো একদিন (তারিখটা ঠিক মনে নেই) বিক্রমপুর জাদুঘরের দ্বারোদ্ঘাটন ও নৌকা জাদুঘর উদ্বোধন উপলক্ষে শ্রীনগরের বালাশুরে বেড়াতে যাই। লেখক সুমন্ত দাদা শাহজাহান স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার সম্পাদিত ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যার ‘ত্রৈমাসিক বিক্রমপুর’ পত্রিকার একটি সংখ্যা আমাকে উপহার দিলেন। যে দিন তার সাথে পরিচয় হলো, মনে হলো বহুদিনের পরিচিত আপন মানুষ, এতদিন হয়ত দেখা হয়েছে, কথা হয়নি। মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে অবসর নিয়ে বিরামহীন তার কঠিন গবেষণা কর্ম করে চলেছেন।
আমার শ্বশুরবাড়ি শরিয়তপুরের নড়িয়ার কেদারপুর গ্রামে, তার সেজ শ্যালিকার শ্বশুরবাড়িও কেদারপুরে, পাশাপাশি দুই পরিবারের ঘর-বসতি। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে আমার বড় সম্বন্ধী, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা, রক্ষীবাহিনীর মানিকগঞ্জ শাখার সাবেক কমান্ডার এডভোকেট পান্না লাল রায় কোনো একটা মামলাজনিত ঝামেলা থেকে স্যারের এক ভায়রা-ভাইকে রক্ষা করেছিলেন। একদিন স্যারকে আমাদের ঢাকার বাসায় নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসি, আমার সম্বন্ধীকেও ডাকি। স্যার তাকে চিনলেও আমার সম্বন্ধী বয়সজনিত কারণে সেই স্মৃতি কিছুই মনে করতে পারলেন না।
আমার প্রমোশন ও ঢাকায় পোস্টিং এর জন্য স্যার আপন ছোট ভাই মইনউদ্দিন স্যারকে অনেকবার ফোন দিয়েছেন। প্রমোশন তালিকায় আমার নাম ছিল ২২ নং-এ। সাত/আট জনের বেশি প্রমোশন হবার কথা না। পদ না থাকাতে কয়েক বছর ধরে ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি (ওএমএস)সহ ডেন্টালের বিষয়গুলোতে প্রমোশন হচ্ছিল না। স্বাস্থ্য সচিব মন্জুরুল হক স্যার, দয়াবশতঃ ২৫ বিসিএস পর্যন্ত ওএমএস বিষয়ের ৪১ জনের সবাইকে প্রমোশন দিয়ে দেন। আমি পরদিন মইনউদ্দিন স্যারের কাছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে, মিটফোর্ট-এ পোস্টিং এর জন্য অনুরোধ করি। স্যার আমাকে অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) বাসুদের গাঙ্গুলী স্যারের কাছে পাঠান। স্যারের সাথে আমার আগে থেকেই হৃদ্যতা ছিল। বলা মাত্র স্যার ফোনে মইনউদ্দিন স্যারকে বলে দিলেন, ডা. স্বপনকে ওর সুবিধামত পোস্টিং দাও। আমি কৃতজ্ঞ তাদের কাছে, আমরা কৃতজ্ঞ সরকারের কাছে।
যাই হোক, পরিচিতি ও উপকার পর্ব শেষ করে মূল লেখায় যাই। এরপর থেকে স্যারের সাথেই আছি। লেখালেখির কারণে, বিশেষ করে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি আমার দুর্বলতার কারণে স্যারের সাথে কর্মপরিধি আরও বেড়ে যায়। বিক্রমপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিক্রমপুরের দেশান্তরিত মানুষদের নিয়ে তার কর্মপরিধি ব্যাপক।
শাহাজাহান স্যার বিক্রমপুরের একটি বিখ্যাত পরিবারের মানুষ, তার শ্বশুর বাড়িও বিখ্যাত। তার পিতা একজন ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী মানুষ ছিলেন। দুই পরিবারের সদস্যরাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তার শ্বশুর ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত কমরেড রহমান মাস্টার। তার স্ত্রীর বড় ভাই আওয়ামী লীগের স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য, অগ্রসর বিক্রমপুরের প্রতিষ্ঠাতা নূহ-উল-আলম লেনিন।
একদিন শাহজাহান স্যারের আমন্ত্রণে মণি সিং-ফরহাদ ট্রাস্ট বৈশাখী সম্মিলনী, ১৪২৩ (২২শে এপ্রিল ২০১৬) অনুষ্ঠানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শেষ পাদপ্রদীপটুকু দেখতে শুক্রবার সকাল ১০টায় গিয়েছিলাম পুরানা পল্টনের কমিউনিস্ট ভূমির পশ্চিম অংশে, বিভাজিত মণিসিংহ-ফরহাদ গ্রুপের কমিউনিস্ট অফিসে। যেখানে সমাজতন্ত্রের মশাল নিভে গিয়ে ট্রাস্ট হয়ে জাদুঘর এর মত হয়ে আছে। ছাত্র ইউনিয়নের গোপন আন্দোলনে আবুল কাকার (বর্তমানে প্রবাসী) সাথে রাত জেগে হারিকেনের নিবু নিভু আলোতে স্কুল-কলেজের দেওয়ালে দেওয়ালে হাতে লেখা পোস্টার সাঁটাতে সাঁটাতে কখন যে আমার কচি মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছিলাম, বুঝতেও পারিনি। ১৯৮৬ সালে ছোট স্টেজ থেকে বড় স্টেজে নাটক করতে লৌহজং কিশোর সংঘে যোগ দেই। সেই থেকে পরিচয় আবুল কাকার সাথে। একদিন আবুল কাকা বলেছিলেন, কনকসার এর রহমান মাস্টার এর সুযোগ্য ছেলে আমাদের বড় নেতা লেনিন ভাইয়ের সাথে পরিচয় করাবেন। ১৯৯০ সালে রাশিয়া গেল ভেঙে, সমাজতন্ত্র শেষ হয়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুরু হলো- যে যত পার শোষণ কর, ধনী হও। কিছু মানুষ ছাড়া আমি-তুমি-আমরা সবাই শোষিতের গল্পের নানা চরিত্র ধারণ করে ‘এই তো বেশ ভালো আছি’ ধরনের স্বস্তি নিয়ে আছি। ১০টার প্রোগ্রাম বাংলাদেশের নিয়ম অনুসারে ১১ টায় শুরু হয়েছিল। শংকর সাঁওজাল এর গ্রুপের গান আর রুদ্র মোহাম্মদ শহীদ্ল্লুাহর কবিতা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। দেরি করে হলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জননীদের, অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জুটিদের এবং আন্দোলনের পেছনে থেকে যে জননীরা সহায়তা করেছেন তাদের সম্মানীত করা হয়। অনেকের সাথে বিক্রমপুরের বিখ্যাত কমরেড প্রয়াত রহমান মাস্টারের স্ত্রীও ( ড.নূহ-উল-আলম লেনিনের মা ও শাহাজাহান স্যারের শ্বাশুরী) মরনোত্তর সম্মাননা প্রাপ্ত হন। তাদের পরিবারের সবাই মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করেন। সেই সাথে এই বিখ্যাত পরিবারের ঐতিহাসিক কিছু সত্য ঘটনা জানতে পারি। স্যারের কাছ থেকেও তার শ্বশুর বাড়ির কাহিনি গল্পের মত শুনেছি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ গবেষক কাজ শুরু করেন বিশাল আয়োজনে, তারপর থেমে থেমে এগোয়, তারপর মনে হয়, অর্থ সংকটে পড়ে, গবেষণা তার চোখের সীমানায় থেমে থাকে, তারপর বিভিন্ন সফল গ্রন্থ থেকে কাটপিস করে, বই আকারে প্রকাশ করেন এবং নিজে, নিজের কাছে একজন বিশাল গবেষক হয়ে যান। তারপর পাঠকের অভাবে, সম্মাননার অভাবে তার লিখিত বইটির সংস্করণ আর বের হয় না বা আগ্রহ থাকে না। এ রকম গবেষক আমাদের বিক্রমপুরেও বেশ কয়েকজনকে দেখেছি। মানুষের দ্বারে দ্বারে, গ্রামে গ্রামে, নানান লাইব্রেরি ঘুরে, দরকার হলে দেশের বাইরে গিয়ে হলেও গবেষণার সন্তোজনক একটা সীমানায় গিয়ে শেষ করা উচিত, যাতে পরবর্তী গবেষক সেখান থেকে শুরু করতে পারে। এ রকম একজন গবেষক বিক্রমপুরে আছেন, তার নাম অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া। কেউ তাকে বলে, বিক্রমপুরের ডিকশনারি, কেউ বলেন বিক্রমপুরের এনসাইক্লোপিডিয়া। আমার নিজের কাছে মনে হয়, উনি বিক্রমপুরের চলিষ্ণুবিদ্যাকল্পদ্রুম।
সুকান্ত কুমার সরকার ও আশেক-ই-এলাহী রচিত ‘সুন্দরবনাঞ্চল : মাটি ও মানুষ’- বইটি পড়ে মনে হয়েছে, স্যারকে সাথে নিয়ে আমাদের দক্ষিণ বিক্রমপুরের ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হবে। অঙ্গ, বঙ্গ, সমতট, রাঢ় এসব জনপথের সাথে এই অঞ্চলে গঙ্গারিডি, তাম্রলিপি নামক জনপথও ছিল। দক্ষিণ বিক্রমপুরের কিছু অংশ এই গঙ্গারিডি জনপথের, তারপর এ অংশগুলো পরবর্তীকালে বিক্রমপুরের অংশ হয়ে যায়। সেই সাথে সুন্দরবনের সৃষ্টির ইতিহাসও সামান্য বুঝা যায়। সুন্দরবনে আমি ছয়বার গিয়েছি। বই পড়ে দুই দেশের সীমানার সুন্দরবনের অনেক ইতিহাস জেনেছি। কিন্তু অনেক গহীন বনে দুর্গম শিবসা নদীর পথে শেখেরটেকের দ্বীপ বনগুলোতে ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানগুলোর ইতিহাস জানতে পারি নাই। প্রায় ৫০-৬০টি দালান, ধ্বংসপ্রাপ্ত, দ্বীপসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত দালান শিবসা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একটা মন্দির এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ইটগুলো কেউ বলে রামপালের সময়ের, কেউ বলে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ের। যদিও আমি ইটের ছবিগুলো প্রত্বতত্ব¡ গবেষক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান স্যারকে দিয়েছিলাম। স্যার বলেছিলেন, এগুলো কলোনিয়াল পিরিয়ডের। শাহজাহান স্যারের সাথে এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, সুন্দরবন কোনো এককালে বাদাবন ছিল না, ছিল সভ্যতা। কি সেই সভ্যতা? জানি না। তারপর জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, যুদ্ধ-সংঘাত ইত্যাদি নানান কারণে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা দ্বীপ আবার সমুদ্র গিলে ফেলে। মানুষ উত্তরে চলে আসে। আবার নতুন করে দ্বীপ জেগে ওঠে। এত দ্বীপ যে শুমার করা যায় না। স্যার বলেছেন, আমাদের লৌহজং থানাটি এমনি একটা পদ্মার চর ছিল। চরে সুন্দর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। পাল জমিদারদের গড়া লৌহজং পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের আদি অবস্থা ছিল বর্তমান জায়গা থেকে ২০-২৫ কিমি দক্ষিণে, ধানকুনিয়া গ্রামে, গত ১০০ বছরে ৫/৭ বার পদ্মার ভাঙ্গনের পর এখন বর্তমান জায়গায়, পদ্মা বার বার তার কূলে গড়ে উঠা সভ্যতাকে গিলে খায়, তারপর বমি করে চর জাগায়, সেই বমির সাথে গ্রামগুলোর চর নামক কঙ্কাল আবার জাগে। এখন মাওয়া থেকে পুবে পশ্চিমে যে চর দেখা যায়, তা লৌহজং শ্রীনগরের বিলুপ্ত গ্রামগুলোর কঙ্কাল। বঙ্গোপসাগরের উত্তর পাশে প্রাচীনকালে এমন ঘটনাই ঘটে থাকতে পারে। ইতিহাসের পাতা ধরে এই পাল জমিদার বংশের চতুর্থ উত্তর পুরুষদের সাথে শিলিগুড়িতে স্যার দেখা করে এসেছেন, অনেক তথ্যও সংগ্রহ করেছেন।
স্যারের সাথে চলতে গিয়ে আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি, পথে চলতে চলতে তিনি কি যেন খোঁজেন। মানুষ, হোক সে পরিচিত কি অপরিচিত, কিছু জানতে চান; কোথায় সেটা পাওয়া যাবে, বা তথ্য পাওয়া যাবে, সেই ঠিকানাটাও নিয়ে নেন; তারপর অনুসন্ধান, যাকে কাছে পান তাকে নিয়েই গল্পের নৌকায় পথ চলতে থাকেন। এরকম এক গল্পের পথে চলতে চলতে ২০১৮ সালের ২৭ শে অক্টোবর স্যারের সাথে আমি আর লেখক সুমন্ত রায় সিরাজদিখানের পণ্ডিত-বাড়ি গিয়েছিলাম। পণ্ডিত বাড়িটি গঙ্গাধর-নিত্যানন্দ-মহেন্দ্রনাথ-বিপদভঞ্জন ভট্টাচার্যের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি, প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো। বিক্রমপুরের সিরাজদিখানের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন এই ব্রাক্ষণ পণ্ডিত বাড়ি। ঐতিহাসিক সংস্কৃত টোল তারা এখনও ধরে রেখেছেন। বাংলা পঞ্জিকা লোকনাথ ডাইরেক্টরির ভূতপূর্ব অন্যতম গণক ব্যবস্থাপক বিপদ ভঞ্জন পঞ্চতীর্থ, তিনি ইছাপুরায় নিত্যানন্দ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার পিতা মহেন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ ঢাকা সার¯^ত সমাজের ভূতপূর্ব প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। বিক্রমপুর জাদুঘরের জন্য তারা প্রায় শতবর্ষ-উর্ধ্ব পাথরের একটি বড় থালা, পাথরের দুটি বাটি সম্প্রদান করেন। এ রকম বহু মূল্যবান প্রাচীন সম্পদ স্যার বিক্রমপুরসহ অন্য জেলা এমনকি ভারত থেকেও সংগ্রহ করে বিক্রমপুর জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমাকে অনেকবার বলেছেন- স্বপন, যদি কোথাও বিক্রমপুরের কোনো প্রাচীন কিছু পাও, আমাকে বলিও, জাদুঘরটাকে সমৃদ্ধ করতে চাই।
বিক্রমপুরের ইতিহাস লেখক অম্বিকাচরণ ঘোষ, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রী হিমাংশুমোহন চট্টোপাধ্যায় রচিত কয়েকটি মূল্যবান বই তিনি আমাকে উপহার দিয়েছেন। বইগুলো তিনি কোলকাতা থেকে সংগ্রহ করেছেন। তিন প্রজন্মের বইগুলো নিয়ে কয়েকমাস বিক্রমপুরের ইতিহাসের পাতায় ডুবে ছিলাম। আগে যতটা ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাগল ছিলাম, তার সাথে চলার পর আমি যেন ইতিহাসের জলপথে পরিব্রাজক হয়ে ইতিহাস ঐতিহ্য খুঁজে চলেছি। তার বাড়ির পাশেই ইছামতির নদীর তীরে প্রতিদিন নৌকা ভরে ভরে লেনিন-মোস্তাফিজ-মাহবুব-মুজিব-সুমন্তসহ আরও অগণন মাঝিরা ইতিহাস ঐতিহ্যর তথ্য ঘাটে দিয়ে যায়। আমি দেখেই যাচ্ছি, তার ঘরের ভিতরের লাইব্রেরিটা দিন দিন বইয়ের গুদামের মতো ভরে উঠছে, ভরে উঠেছে তার মগজের বিদ্যালয়টি।
তার বাসার লাইব্রেরির অগণন বই, সেই বইগুলোর একনিষ্ঠ পাঠক হওয়ার কারণে বিক্রমপুরের বিখ্যাত যে কোনো পরিবার, ব্যক্তি সম্পর্কে বিরামহীম কথা বলতে পারেন, সেই পরিবার বা ব্যক্তির আত্নীয়-পরিজন কোথায় কোথায় বাস করেন, তাও বলতে পারেন। রবি ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়িটি নিলামে কিনেছিলেন ভাগ্যকুলের জমিদার পরিবারকে এক নারী; কে সেই নারী- তিনি তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে আনতে সক্ষম হয়েছেন। রবি ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে সেই কুঠিবাড়ি কেনার জন্য তার দেওয়ানকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যকুলের সেই নারী জমিদার তার কেনা শিলাইদহ জমিদার বাড়ি বিক্রি করতে রাজি হননি। অথচ ভাগ্যকুলের জমিদারদের আরেক গবেষক মুজিব রহমানও সে তথ্য জানেন না, শুধু মুজিব রহমান কেন, কেউ এসব তথ্য জানেন না।
তার ‘শিমুল ফুলের হাতছানি’ গ্রন্থের ‘সেরু’ গল্পে শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথের চরিত্র খুঁজে পাই। তার লেখা গল্প, গবেষণা পড়েই বুঝেছি, তিনি কি রকম মানের একনিষ্ঠ পাঠক। আমরা সবাই জানি, ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রচুর বই পড়তেন, এখনও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। তবে বিক্রমপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি তার দুর্বলতা অত্যধিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. ইউসুফ ফকির স্যারের সাথে মেডিকেল ক্যাম্পে অংশ নিতে গিয়ে টঙ্গীবাড়ির পুড়া গ্রামে ভগ্নপ্রায় দালান দেখতে পাই। স্যারকে টেলিফোনে কিছু বলতেই অনেক তথ্য জানিয়ে দিলেন। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত এ গ্রামের পুকুর পাড় থেকে অর্ধনারীশ্বর মূর্তিটি উদ্ধার করেছিলেন। বিক্রমপুরের কোনো গ্রাম, কোনো নদী, কোনো বাড়ি, কোনো প্রাচীন ভগ্নপ্রায় দালান, কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি তথা যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলেই তথ্যসমৃদ্ধ নানান গল্প বলতে থাকেন। বিক্রমপুর নিয়ে এত জানাশোনা মানুষ আমি কোনোদিন দেখি নাই।
লৌহজং-এর বেজগাঁও গ্রামের বাবুর বাড়ির সতীদাহ মঠ নিয়ে তার সাথে অনেক আলোচনা হয়। বাবুর বাড়ির সতী ঠাকরুনের মঠের কাহিনি তার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম, এটাই বিক্রমপুরে একমাত্র সতীমঠ, আর কোন সতী মঠ ছিল কিনা কেউ জানে না, এই জনপদের ইতিহাসে কোনো লেখাও নাই। অথচ বেজগাঁও গ্রামে আমার নিজের বিদ্যালয় লৌহজং পাইলট স্কুলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই এই সতী মঠ অবস্থিত, আমি আগে জানতামই না। পদ্মার করাল গ্রাসে আর বর্তমানে মানুষের লোভের কারণে বাবুর বাড়িসহ মঠটি এখন বিলুপ্তির পথে।
নিজের জীবনটাকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়ম মেনে কখনও চলেননি, নিয়ম মানা তার কাজ নয়, নিয়ম মানলে তো আজ এই শাহজাহান স্যারকে আমরা পেতাম না। অর্থ সম্পদের হিসাব তিনি কখনও করেননি। তাই প্রকৃতির মাঝে এই ঘর-বসতি ছাড়া তার আর কোনো চাহিদাও ছিল না। ১৯৭৬ সালে তিনি জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউটে চাকুরি করতেন, থাকতেন অম্বিকা সাহার প্রকৃতিময় পরিত্যক্ত বাড়িতে। প্রচুর বই পড়তেন। অম্বিকা সাহার বয়স্ক পুত্রবধূ সরযূবালা আর কন্যা বৃদ্ধা কামিনীবালার স্নেহে সেই সময়ে খুবই শান্তিতে ছিলেন। একদিন স্ত্রীকে বললেন, ‘আমাদের আর কোথাও যাবার দরকার নাই। এই প্রকৃতিতেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।’ তিনি এমনি এক উদাস পাগল বই পড়ুয়া আধ্যাত্মিক মানুষ। তিনি যে মুসলিম তার নাম দেখে হয়ত বোঝা যেত, কিন্ত আচরণে বোঝা যেত না, বরং তিনি যে একজন প্রকৃত মানুষ তা সবাই ভালো ভাবেই বুঝতে পারত।
বিক্রমপুরের বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে তার ব্যাপক গবেষণা, যা এর আগে কেউ করেনি। ১৬১৫ সালে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ বৈষ্ণব গ্রন্থে লক্ষণ সেনের প্রধানমন্ত্রী ও ধর্মগুরু হলায়ুধ মিশ্রের ৪র্থ উত্তর পুরুষ কাষ্ঠকাঠা শ্রী জগন্নাথের জীবন কথা লেখা আছে, সেই লেখা কোলকাতা থেকে উদ্ধার করে, লেখার নানান সূত্র ধরে শাহাজাহান স্যার অনেক তথ্য বের করেন। এই জগন্নাথ দাস বিক্রমপুরে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ব্রাক্ষণ শাসিত বিক্রমপুরে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার খুব সহজ ছিল না। জগন্নাথ থেকে শুরু করে তার অষ্টম পুরুষ শ্রী হরিমোহন পর্যন্ত নানান নিন্দা-গঞ্জনা সহ্য করেই বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে হয়েছে। পঞ্চসার, কাঠাদিয়া, রাউৎগাও, হলদিয়া, হাসাড়া, বেলতলী, সোনারং, পাইকারা, খড়িয়া, চোরমর্দন, পূর্বরাইজদিয়া, খিদিরপুর, রসুনিয়া, বাহেরঘাটা প্রভৃতি গ্রামে বৈষ্ণবদের আখড়া ছিল, দেশ ভাগের আগেও ছিল, তারপর প্রায় বিলুপ্তই হয়ে যায়। স্যার এই বিষয় নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, এখনও করছেন। বিক্রমপুরে বিলুপ্তপ্রায় বৈষ্ণব ধর্ম বিষয়ে অগ্রসর বিক্রমপুর পত্রিকায় তিন পর্বের ধারাবাহিক লেখাও ছাপানো হয়েছে। ২০১৫ সালে বিক্রমপুরের নাগেরহাটের শ্রী শ্রী রাধা-গিরিধারী আশ্রম ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা পাগল হরকুমারের জীবনী তিনি প্রকাশ করেন। সাধু-সন্তু, ফকির, দরবেশ বৈষ্ণব তথা সুফিবাদের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ও বিশ্বাস আমাকে বিমোহিত করে।
বিক্রমপুরে প্রায় ২৫-৩০টি পাঠাগার ছিল, যার কোনোটার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তিনি মাসের পর মাস সময় ব্যয় করে বিলুপ্ত পাঠাগারগুলোর ইতিহাস খুঁজে বের করেছেন। বিক্রমপুর ত্রৈমাসিক পত্রিকার ১ম সংখ্যায় তার লেখা ‘বিক্রমপুরের পুরাতন পাঠাগার’ লেখাটি পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। বিক্রমপুরের বিলুপ্ত ১৪-১৫টি পাঠাগারের বর্ণনা, সেই সাথে আরও প্রায় ১০-১৫টি পাঠাগারের নাম উল্লেখ করেছেন, যার সবই প্রায় বিলুপ্ত। হারিয়ে যাওয়া তিনটি ক্লাবের বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন।
ভাগ্যকুল পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আয়োজিত করোনাকালীন ৬০তম অনলাইন পাঠচক্রে বিজ্ঞ আলোচকদের উপস্থিতিতে ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত স্যারের প্রবন্ধ ‘বিক্রমপুরের পুরাতন পাঠাগার’ লেখাটি আমি পাঠ করেছিলাম, পাঠ শেষে আলোচনা হয়েছিল। স্যারের লেখা থেকে জানতে পারি, শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিক্রমপুরকে মধ্যযুগে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হতো। সেই সময়ে নবদ্বীপের পণ্ডিতগণকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য বিক্রমপুরে আসতে হতো। এ রকম সুনামের জন্যই নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত শ্রী চৈতন্য তর্ক যুদ্ধে অংশ নিতে বিক্রমপুরে এসেছিলেন এবং আড়াই বছর এখানে অবস্থান করেছিলেন। এক সময়ে গ্রামগুলোতে প্রচুর টোল ছিল, সেখানে ন্যায় শাস্ত্রের চর্চা হতো। বীরতারার টোল সেই সময়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল এবং বিভিন্ন দেশ-বিদেশ হতে বিদ্যার্থীরা এই টোলে শিক্ষা লাভ করতে আসত। সিরাজদিখানের বাসাইল গ্রাম আজও টোল বাসাইল নামে পরিচিত। এই সময় এই গ্রামের বিখ্যাত জ্ঞানতপস্বী করুণাময় সরস্বতীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ২৫ হাজারের মতো বই ছিল। অতি দুঃখের সাথে বলতে হয়, মুন্সিগঞ্জের রায় বাহাদুর হরেন্দ্রলাল পাঠাগার ছাড়া আর কোনোটির কোনো অস্তিত্ব নেই। এতগুলো পাঠাগারের কিছু সংখ্যক ধরে রাখার মতো আর কোনো উত্তরপুরুষও পাওয়া গেল না? মনে হয়, পাঠকও ছিল না, কারও আগ্রহও ছিল না, সবাই তখন ব্যবসার জন্য দিগি¦দিক ছুটে চলেছে। যাদের আগ্রহ ছিল, যে কয়জন পাঠক ছিল, সবাই কি ’৪৭ পরবর্তীকালে কোলকাতা চলে গিয়েছিল?
বিক্রমপুর এলাকার অনেক গ্রামের নামের ইতিহাস তিনি জানেন। ১৩৫০ সালে শ্রী হিমাংশু মোহন চট্টোপাধ্যায় উত্তর বিক্রমপুরের ২৫টি গ্রাম নিয়ে ৫১২ পৃষ্ঠার একটি ইতিহাস গ্রন্থ বের করেছিলেন। সেই গ্রামগুলো, সাথে সেই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে শ্রী হিমাংশু মোহন চট্টোপাধ্যায় যতটুকু লিখেছেন শাহজাহান স্যার তাঁর চেয়েও আরও বেশি বর্ণনা দিতে পারেন। এটা সম্ভব হয়েছে বিক্রমপুরের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার টানে তথ্যসূত্র ধরে ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিরামহীন তথ্যানুসন্ধান।
করোনার আগে তাঁর সাথে কথা হয়েছিল, বিক্রমপুরের আরও ঐতিহাসিক তথ্য বের করব এবং এক হাজার পৃষ্ঠার একটা ঢাউস সাইজের গ্রন্থ আমরা রচনা করব। প্রয়োজনে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়িতেও যাব। করোনার কারণে তা আর করা হয়নি। ব্রেনস্ট্রোক করার কারণে স্যার এখন বেশ অসুস্থ। তার উপস্থিতি, পরামর্শ বা উৎসাহ ছাড়া এ বিশাল কাজ করা সম্ভব নয়। স্যার জীবন্ত চলমান ইতিহাস গ্রন্থ, তিনি মুখ খুলে কথা বললেই বিক্রমপুরের জায়গাগুলো যেন হয়ে ওঠে ইতিহাস ঐতিহ্যের পুন্যভূমি; তিনি ঐতিহাসিক মানুষগুলোর নাম উচ্চারণ করলেই তারা জীবন্ত হয়ে উঠে, আর মানুষগুলোকে নিয়ে গল্প বললেই সেই মানুষগুলো আমাদের চারপাশে যেন হাঁটতে থাকে, মাঝে মাঝে মনে হতো ইতিহাসের মানুষগুলো তাদের সেই সময় নিয়ে আমাদের সাথেই সমান্তরালে চলছে। যেখানেই বিক্রমপুরের কিছু তথ্য পাবেন বলে মনে করেন, সেখানেই তিনি ছুটে যান। বিক্রমপুর জাদুঘরের এরকম যোগ্য, দক্ষ কিউরেটর দ্বিতীয় কেউ হতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। ড. নূহ-উল-আলম লেনিন ভাইয়ের অনেক কাজের সাথেই স্যার জড়িত। কনকসারের বঙ্গীয় গ্রন্থ জাদুঘরের বই সংগ্রহ ও ক্যাটালগ তৈরির কাজে তাঁর ভূমিকা ব্যাপক।
স্যার কখনও কারো সাথে ঝগড়া করেছেন, রাগ করেছেন, আমি কখনও দেখিনি, শুনিনি। তার কিছু স্বভাবের সাথে আমার মিল আছে। বিশেষ করে, বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ, লেখালেখি, ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি দুর্বলতা। তার আরেকটা দিক আমাকে ভাবুক করেছে, সে সম্পর্কে বলার আগে নিজের স্মৃতি নিয়ে সামান্য বলি- জন্মের পর যখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম বা বলা যেতে পারে যখন নিজেকে চিনতে পারলাম, আরও ভালোভাবে বলতে গেলে স্মৃতির অতল গহীনে হাতড়িয়ে প্রথম নিজের যে স্মৃতিটা মনে করতে পারছি, তা হলো- চার-পাঁচ বছরের নেংটো একটা নিষ্পাপ মানবদেহ, যার মাজাতে দুই কি তিনটি তাবিজ- একটা বনজ শেকড়, কালো সূতা (আমরা কালো কাইতান বলতাম) দিয়ে বাঁধা, গলায় একটা কড়া। গলায় কড়া বা তাবিজ কোনো একটা থাকতই; মাঝে মাঝে দুইটাই থাকত। সংগ্রাম বীরের পাতলা ফকির, কদম বাবার মাজার, মৈছামান্দ্রার পীর, আমাদের দিঘলী গ্রামের তাজু ফকির, উত্তর দিঘলীর ভারত ফকিরের মন্দির, দিঘলী বাজারের গাট্টি পাগলা তথা আরও অগণন উৎস থেকে আমাদের ভাইদের গলায় এসব অমূল্য অলংকার শোভা পেত। আমি ছিলাম দ্বিতীয় ছেলে সন্তান, তাই বড় ভাইয়ের পরে যথেষ্ট নিরাপত্তা পেয়েছি। ঠাকুরমার ধারা আমার মা নিষ্ঠার সাথে আজ অবধি অব্যাহত রেখেছেন। আমার পূর্বপুরুষ বাঁশি হালদার-পঞ্চানন্দ হালদার-ভগবান হালদার-হরিদাস হালদার এরা সবাই একজন করেই বেঁচে ছিলেন। আর তাই আমার পূর্বনারী ঠাকুরমা সাবিত্রী হালদার এসব তাবিজ-কবচ যোগাড় করে ছেলে সন্তানদের গলায়, মাজায় দিতেন যাতে ছেলে সন্তানরা সুস্থ হয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকে। আমার ছেলেবেলার এইটুকু প্রসঙ্গে তোলার কারণ হলো-- আমি আজও মাজার-দরগা-ফকিরের আখড়ায় আমার পূর্বপুরুষ-পূর্বনারীদের উপলব্ধি, আবেগ, বিশ্বাস অনুভব করি। কী বিশ্বাস নিয়ে কত কষ্টে কত আশায় আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামে তারা সহযোগিতা করেছেন, আজও আমরা সেই সংগ্রামের সেই নিদারুণ কষ্টের যন্ত্রণা অনুভব করতে পাই। কী উপকার হয়েছে, আদৌ হয়েছে কিনা, সেই তর্কে না-যাই। এই মাজার-দরগা-ফকির বাড়ি এলেই স্মৃতি তাড়নায় আমার কৃতজ্ঞতা, আমার শ্রদ্ধা আবার জেগে ওঠে। এই মোমবাতি-আগরবাতি-শিন্নি-প্রসাদ-মানুষের মেলা-শিল্পী ভক্তদের গান-আনন্দ-বিশ্বাসে আমি আমার বেঁচে থাকার ইতিহাস খুঁজি, খুঁজি সেই অন্ধ বিশ্বাসের চেতনা-- যা আজও আমার, আমাদের ডিএনএ’র প্রবাহে বয়ে চলেছে অবিরাম। অধ্যাপক শাহজাহান স্যারের সিরাজদিখান চোরমর্দন গ্রামে কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছি। তবে তার ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে গিয়ে তার আরেক সত্তা উপলব্ধি করি। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ৪ মাঘ স্যারের জন্মবাষির্কী। শিষ্য-ভক্তদের মিলনে ফি বছর লালনের আখড়ার মতো তার জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। শাহজাহান স্যার, আমাদের গুরু, পরম বাউলভক্ত, ‘জাহান ফকির’ নামে তার আরেক সত্তার কথা ঐ দিনের আগে আমি জানতাম না। আজ তার বারামখানায় গিয়ে সেই রূপ দর্শন করলাম। পরম সত্তার সাথে মিলনের আরেক পথ। আমরা লালনের আখড়ার মতো তার বারামখানায় গাইলাম, মিলন হবে কত দিনে, জাত গেল জাত গেল..., যেখানে সাঁইয়ের বারামখানা...। দ্বিসত্তা- একই দেহে দুইজনের বসবাস; চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাসেও মনে হচ্ছে দুই রূপ। শিল্প-সাহিত্যের অথবা আধ্যাত্মিক জগতের অনেকেই দ্বিসত্তা ধারণ করেন। বাউল বা বাউল ভক্তরাও এটা ধারণ করেন। স্যার তাবিজ-কবজের ফকির ছিলেন না, তিনি সুফিবাদে বিশ্বাসী একজন লালনভক্ত ফকির, শিখ ধর্মের অনুসারী গুরু নানকের সমসাময়িক সন্ত কবিরের অনুসারী তিনি।
স্যারকে কেউ অপছন্দ করে, আজও শুনি নাই। ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি তার যে মমত্ববোধ, তা সচরাচর দেখা যায় না। আমি কয়েকজন মুসলমান মানুষকে দেখলে নমস্কার দেই। তার মধ্যে স্যার একজন। অন্য ধর্ম, ভিন্ন মতের প্রতি তার শ্রদ্ধা দেখে আমি বুঝতে পারি, আমি এক সত্যিকারের মানুষের সাথে আছি। আজকাল মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। নানান ধর্ম মত ও বিশ্বাস নিয়ে পড়তে পড়তে, বিশ্বাসীদের ধ্যানজ্ঞান দেখতে দেখতে তার অন্তর্জগতে কোনো এক সময় সুফিবাদের প্রতিও বিশ্বাস গড়ে উঠে। একদিন বলে ফেললাম, স্যার আপনার গুরু কে? বলল, সন্ত কবীর। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, তিনি গুরু নানকের সমসাময়িক সন্ত কবিরের গ্রন্থগুলোও পড়েছেন। তিনি আরও অনেক সাধু-সন্তকেও গুরু মানেন, হোক সে জন্মসূত্রে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য কোনো ধর্মের। স্যার উদার মনের মানুষ, কোনো রাজনীতি বা কোনো দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য কোনোদিন প্রকাশ করেননি। তবে যে দলটিকে পছন্দ করতেন, সে দলের সমালোচনাও করতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। সেদিন এবং তার আগে ও পরের দিনসহ সেই সময়, সেই পরিবেশের অতি নিখুঁত এক বর্ণনা তার লেখা ‘নেতা ফিরে আসেননি’ গল্পে আমরা দেখতে পাই।
‘ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর’ পত্রিকার সম্পাদক পরিষদের সভা ছিল ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে। শিল্প সাহিত্যের নানান গুণে গুণান্বিতা নতুন সম্পাদক অধ্যাপক ঝর্না রহমানের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে এটাই ছিল সম্ভবত স্যারের শেষ সভা। দিনটা ছিল শুক্রবার। বিকাল ৫টায় সিরাজদিখানের ইছামতি নদীতে ভাসমান নৌকায় অগ্রসর বিক্রমপুর পত্রিকার প্রকাশনা সংক্রান্ত সম্পাদক পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুজিব রহমান, সুমন্ত রায় ও আমি। পত্রিকাটির পরবর্তী সংখ্যা ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত কয়েক মাসের সংগ্রহ করা লেখা নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং আরও ভালো লেখা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিতব্য তিনটি গ্রন্থ: ‘বিক্রমপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, ‘অতীশ দীপঙ্করের জীবনী’ এবং ‘ভাগ্যকুলের ইতিহাস’ গ্রন্থত্রয়ের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। নৌকাটি ছিল স্যার, স্যারের পরিবার এবং অতিথিদের জন্য প্রমোদতরী। ইছামতি নদীতে তার ভাসমান নৌকায় জীবনে এই প্রথম চারজনে মিলে সভা করেছি। সেদিন তার কাছ থেকে বিক্রমপুরের অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করি। নদী-নৌকা-মাঝি একসময় বিক্রমপুরের প্রাণ ছিল। এত পাকা রাস্তাঘাট ছিল না। সেই সময়ের ইতিহাসের নানান বাঁক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
স্যারের স্মৃতি জাগানিয়া গল্প ‘শিমুল ফুলের হাতছানি’ তার ব্যক্তিগত জীবনকাহিনীর সামান্য অংশ বিক্রমপুরের এই রাঢ়ীখাল-মাখা স্মৃতি অথচ সেই সময়ের খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলোকে আমাদের চোখের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন, সিনেমার পর্দায় নির্বাক হয়ে আমরা স্বচক্ষে দেখছি। তার এরকম অসামান্য বর্ণনা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এ দেখতে পাই। ৩১ পৃষ্ঠার এই স্মৃতি জাগানিয়া গল্পে রাঢ়ীখালের জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন-ছাত্র-শিক্ষক-গ্রাম-হাঁট-জনবসতি-দেশত্যাগী মানুষ-বিভিন্ন পাড়া ও পাড়ার মানুষের জীবন, বিশেষ করে অম্বিকা সাহার বাড়ি, সেই সাথে পাশ্ববর্তী গ্রাম-গঞ্জ-হাঁট-বাজার ঐতিহাসিক বাড়ি, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তার বর্ণনায় তুলে এনেছেন। সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন, আড়িয়াল বিলের প্রকৃতিতে অম্বিকা সাহার বৃক্ষ-লতা-পাতা দিয়ে সাজানো বিশাল বাড়ি।
মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যখন জানতে পারতাম, স্যার চোরমর্দন গ্রামেই আছেন, বলতাম, স্যার আমরা ত্রিরত্ন কাল আসছি। ফোনে স্যার বলতেন, স্বপন আসার সময় তোমরা এটা এটা নিয়ে এসো।’ আমার বাবা নেই। আমি অর্থ রোজগার করার আগেই তিনি চিরতরে হারিয়ে গেছেন, স্যার এমন দরদমাখা সুরে বলেন, এটা ওটা নিয়ে এসো, মনে হয়, আমার বাবাই বলছেন। কখনও আমরা নিজেরাই বলি, কি কি আনতে হবে? স্যার নিজেও জানেন, এই তিনজন খালি হাতে গুরুর বাড়ি কখনও আসে না। তাই তিনি নিজেই বলে দেন, এটা এটা ঘরেই আছে, তোমরা যদি আনতে চাও অল্প অল্প করে এটা এটা নিয়ে এসো। আমাদের বাড়িতে পুর্নিমা, তার মা, আমি--আমরা তিনজন। আমরাও হিসাব করি আমরাও তিনজন, মোট ছয়জন। পুর্ণিমার মা তার ছেলেকে হারিয়ে, মেয়েকে নিয়েই স্যারের বাড়ির একটা ঘরে বসবাস করে। যে ঘরটা জাহান ফকিরের বারামখানা বলে আমরা জানি, সেই ঘরের দুটি রুম আছে। একটা রুমে তারা থাকে অন্য রুমে জাহান ফকিরের বারামখানা হিসেবে প্রতিবছর ৪ মাঘ লালনের গানের আসর বসে।
পাঠককে জানিয়ে রাখতে চাই, ত্রিরত্ন মানে মুজিব-সুমন্ত-স্বপন। আদর করে তিনজনকে এই উপাধিটা স্যারই দিয়েছেন। মুজিব রহমান একজন শক্তিমান কবি, ব্লগার, পেশাগত পরিচয়, তিনি একজন ব্যাংকার। বিক্রমপুরের বিখ্যাত পঞ্চাশ জন ব্যক্তি নিয়ে তার বহুল আলোচিত একটি গ্রন্থ ‘মুন্সিগঞ্জের স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব’ নামে ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। আরও পঞ্চাশ জন বিখ্যাতদের নিয়ে দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশ করবেন। তিনিই প্রথম, ভাগ্যকুল গ্রামের ইতিহাস লিখেছেন। তিনি নিয়মিত গল্প, কবিতা, সমাজ সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকা ও ফেসবুকে বিরামহীন লিখেই যাচ্ছেন। সুমন্ত রায় আরেক শক্তিমান লেখক, একজন কলেজ শিক্ষক তার আটাশটি প্রকাশিত গ্রন্থ আছে। আর আমি এই জ্ঞানী, শক্তিমান লেখকদের সাথে চলি বলে আমিও স্যারের কাছে আরেক রত্ন।
নিমতলা থেকে অটোতে সিরাজদিখানের পথে যেতে যেতে দানিয়াপাড়া শ্মশান ঘাটের কাছে নামতে হয়। তারপর স্যারের সাথে উত্তরে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে এক সময় চমকিত হই, গল্পে গল্পে গ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, পথ-ঘাট, মানুষ, মানুষের সংস্কৃতি-গ্রাম-সবুজ লতা-পাতা-নদ-নদী সবই উঠে আসে। তিনি নিজেই একটা ঐতিহ্যময় পরিবেশ, একটা চলমান ইতিহাস। শান্ত মানুষটি ইছামতি নদীর তীরে প্রকৃতির সব উপস্থিতির মাঝে নিখুঁতভাবে নীড় গড়েছেন। ঘর-বসতির ভিতরটাতে শহুরে আধুনিকতার দারুণ সমন্বয় করেছেন। ঘরে ও বাইরের সমস্ত কিছু কিভাবে সংগ্রহ করেছেন তা বিরামহীন গল্পের মতো বলতেই থাকেন। শুনতেও কারও ক্লান্তি হয় না।
আজ তিনি অসুস্থ, তাকে দেখলে মনে হয়, ইতিহাসের নূহ নবীর নৌকায় তিনি তার ঘর-বসতিসহ বিক্রমপুরের সব কিছু নিয়ে চলেছেন, ঘাটে ঘাটে ইতিহাসে যেখানে যা ছিল, সেখানে নোঙ্গর করে ঠিক জায়গা মতো সব রেখে যাচ্ছেন। আমরা সবাই তার কথা মতো ইতিহাসের ঘাটে ঘাটে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছি; শেষ ঘাটে গিয়ে তিনি দ্রুত তার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মনে হলো, নূহ নবীর এত বড় নৌকা ত্যাগ করে, সব দান করে বিক্রমপুরের বিখ্যাত টলটল ঠাকুরের বাইচের নৌকা নিয়ে একাই চলেছেন ঘন ঘোর অমাবশ্যার অন্ধকারের অজানা কোনো ইতিহাসের সাগরে।
আমার বিশ্বাস, বিক্রমপুরের ইতিহাস লেখক অম্বিকা চরণ ঘোষ, শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রী হিমাংশু মোহন চট্টোপাধ্যায় এদের পরেই তার নাম বিক্রমপুরের উত্তর পুরুষেরা অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত