বাঙালীর সংস্কৃতির শিকড়কাব্য

  শাশ্বত স্বপন

প্রকাশ: ১২ মে ২০২১, ০৮:৫৭ |  আপডেট  : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২:১৪

বঙ্গে প্রথম জমি চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল  তোলা পর্যন্ত নানা ধরনের লোকাচার আগেও ছিল, এখনও আছে, এর কতগুলি ফসল তোলার আগে, আর কতকগুলি ফসল তোলার পরের লোকাচার। বৃষ্টির জন্য  মেঘরাণী, হুদমা দেওয়া, বেঙ বিয়া; ফসল রক্ষার জন্য ক্ষেতবন্ধন, কাকতাড়ুয়া, গাড়ু উৎসব প্রভৃতি প্রাকফসল আচার; আর লক্ষীরছড়া,  নবান্ন, মাগন প্রভৃতি ফসলোত্তর অনুষ্ঠান। এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই; তবে  টুসু, ভাদু, করম, বসুধারা প্রভৃতি ব্রতাচার হিন্দু রমণীরাই পালন করে থাকে।

'বার মাসে তের পার্বণ’ প্রবাদ দ্বারা উৎসবমুখর বাঙালি জাতির মৌলিক পরিচয় ফুটে ওঠে। হিন্দুদের ব্রতাদি আচার-অনুষ্ঠানের আধিক্যের কথা বিবেচনা করেই এরূপ প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। বার, তিথি, মাস ও ঋতুভিত্তিক এসব পার্বণের উদ্ভবের পেছনে প্রাকৃতিক ও দৈব শক্তির কল্পনা আছে। শাস্ত্রীয় ধর্মের পাশাপাশি হিন্দুরা লক্ষ্ণী, মনসা,  শীতলা, ষষ্ঠী,  ওলাদেবী, বনদুর্গা, দক্ষিণ রায়, সত্যনারায়ণ, পাঁচু ঠাকুর প্রভৃতি  লৌকিক ও  পৌরাণিক  দেবদেবীর পূজাচার পালন করে থাকে। দীর্ঘকাল একত্র বসবাসের ফলে নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের ওপরেও এসবের প্রভাব পড়েছে। তারা  সত্যপীর, গাজীপীর, মানিকপীর, মাদারপীর,  খোয়াজ খিজির,  ঘোড়াপীর, বনবিবি, ওলাবিবি, হাওয়া বিবি প্রভৃতি কাল্পনিক, লৌকিক ও ঐতিহাসিক পীর-পীরানিকে হিন্দু  দেবদেবীর প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়ে পূজা-মানত করে থাকে। এসবের পেছনে অসহায় মানুষের  রোগ-ব্যাধি ও ক্ষয়-ক্ষতি  থেকে রক্ষা পাওয়ার কামনা-বাসনা নিহিত রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কতক পূজা-মানত পৃথকভাবে করে, আবার কতক ক্ষেত্রে উভয়ে পরস্পরের অংশীদার হয়। সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর, বনদুর্গা ও বনবিবি  যে একই ভাবনার ভিন্ন রূপ তাতে সন্দেহ নেই। 

অনুরূপভাবে, অসংখ্য  মেলা আছে যেখানে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ যোগদান ও আনন্দোপভোগ করে। হিন্দুর রথযাত্রার মেলায় মুসলমান এবং মুসলমানের  মুহররম এর মেলায় হিন্দুর অংশগ্রহণে  কোনো বাধা নেই।  বৈশাখী মেলা এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। হিন্দুরা  দেওয়ালি উৎসবে প্রদীপ ভাসায়, মুসলমানরা মুহররম অনুষ্ঠানে বেরা ভাসায়। শুভ অনুষ্ঠানে মঙ্গলঘট স্থাপন ও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো আগে শুধু হিন্দু সমাজেই প্রচলিত ছিল, এখন মুসলমানের অনুষ্ঠানেও মঙ্গল কামনায় ওইরূপ করা হয়। জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু উপলক্ষে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু আচার-অনুষ্ঠান আছে। গায়ে হলুদ, ডালা, বর-কনে স্নান, আয়নামুখ, কড়ি  খেলা, বরবধূ বরণ, ফিরানি ইত্যাদি আচার কমবেশি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই পালিত হয়। এভাবেই  লোকসংস্কৃতির নানা শাখা গড়ে উঠে।

অনুমান করা হয়, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে সারা বঙ্গদেশ সমুদ্র গর্ভে নিমর্জিত ছিল। সমুদ্রতল জেগে উঠার পর স্থলপ্রকৃতি বন-জঙ্গল-পশু-পাখি তথা শ্বাপদঙ্কুলে ভরে উঠে। শুরুতে এই দেশে চণ্ডাল জাতীয়  বা নিম্নশ্রেণির লোকজন  বসতি স্থাপন করে। প্রাচীন জনপথের অঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ থেকে বিতাড়িত হয়ে অথবা খাদ্যের সন্ধানে হয়তো এই নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা বঙ্গের চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো এলাকা তখনো বঙ্গ নাম ধারণ করেনি। জলমহল-জমি-ফসল-খাদ্য, তারপর অধিকার-ক্ষমতা নিয়ে নানান নামের নানা জাতি-গোষ্ঠীর দ্বন্ধ-সংঘাত চলতেই থাকে। সংগ্রাম চলতে থাকে প্রতি বছর বন্যা থেকে ঘর-বাড়ি ও নিজেদেরকে বাঁচাতে। বাড়ির চারদিকে এরা বাঁধ বা আল দেওয়া শুরু করে, ফসল বাঁচাতে জমির চারদিকেও আল দেওয়া শুরু করে। প্রকৃতির সাথে, নিজেদের সাথে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে তারা কোন এক কালে বঙ্গ জাতিসত্ত্বার ছায়াতলে চলে আসে, এক সময় এই এলাকা বঙ্গ নাম ধারণ করে। তাদের আল দেওয়া কর্মের সাথে মিল রেখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বহিরাগতরা নাম রাখে বঙ্গাল। এমনি ভাবে চন্ডাল, লাঙ্গল,  জোঙ্গাল, জঙ্গল, ডাঙ্গাল, বোহাল, খেড়ওয়াল, সাঁওতাল, বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।

বঙ্গের সাথে অঙ্গ-কলিঙ্গ-সমতট-রাঢ় সহ মোট ১৬টি জনপথের তথ্য পাওয়া যায়। ইতিহাসের অন্ধকারের মধ্যে যতটুকু জানা যায়, বঙ্গ হলো ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বভাগে অবস্থতি একটি প্রাচীন রাজ্য। এই রাজ্যটি এখন রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত-- বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। প্রাচীন বঙ্গ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একটি সমুদ্রচারী রাজ্য। মহাভারতে (৬।৯) অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্য তিনটিকে ভারতবর্ষ বা প্রাচীন ভারতের নিকটবর্তী রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।  মহাভারত থেকে জানা যায়, ১২ বছর র্তীথভ্রমণে বেড়িয়ে অর্জুন বঙ্গ ও কলিঙ্গের সকল পবিত্র স্থানে এসেছিলেন। তারপর ইতিহাস অন্ধকারে চলে যায়,  অনেক পরে ইতিহাস অন্ধকার থেকে মোমের আলোতে, তারপর চাঁদের আলোতে, তারপর সূর্যের আলোতে চলে আসে।

প্রায় ৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ থেকে ধারাবাহিকভাবে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, মুসলিম, পর্তুগীজ, ফরাসী, বৃটিশ, ভারত, পাকিস্তান এই বঙ্গ বিক্রমপুরকে শাসন করেছে। তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি দ্বারা এই এলাকার মানুষ প্রভাবিত হয়েছে।  পলল বদ্বীপে গড়ে ওঠা  বাংলাদেশ মূলতই একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার পলিমাটিতে ব্যাপক ফসল ফলার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা এসে এ এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করেছে। মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই হলো খাদ্য। আর এ খাদ্যের সংস্থান করতে গিয়েই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এ পললভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করার কারণে এটি প্রাচীনকাল থেকেই একটি জনবহুল দেশ। নানা দেশ থেকে ভাগ্যান্নেষণে এখানে যারাই এসেছে, এখানকার উদারদিল লোকেরা তাদের আশ্রয় দিয়েছে, আপন করে নিয়েছে। এভাবে গোড়া থেকেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে বহুত্ববাদের ধারায় গড়ে উঠেছে এ দেশ। 

এখানে নানা ধারায় প্রাচীন জনবসতির গড়ে ওঠায় এখানকার সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেছে এক মিশ্র ধারায়। প্রাচীনকালে বাইরে  থেকে যারা এদেশে এসেছে তাদের মধ্যে- আর্য, শক, হুন,  কোচ,  মেচ,  সেন, আরবীয়, ইরানি, তুর্কী, আফগান,  মোগল, পাঠান, আফ্রিকান, ইউরোপীয়, ওলন্দাজ, ইংরেজ, বিহারি, পাকিস্তানি, আরাকানি ইত্যাদি নানা স্রোত- বঙ্গের সংস্কৃতি বিনির্মাণে উপাদান জুগিয়েছে। এখানকার মানুষ নানা ধর্ম পালন করলেও কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে কৃষির নানা উপাচার তাদের জীবনবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।  যে যে ধর্মেরই অনুসারী  হোক না কেন,  সেগুলোকে উৎড়িয়ে কৃষির  সে সব উপাচার এখানকার মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত