বাংলাদেশের সঙ্গে কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার তুলনা চলে না: পাশে থাকবে ভারত
প্রকাশ: ৮ আগস্ট ২০২২, ১০:৩৫ | আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০১
বিশ্ব অর্থনীতিতে গভীর সংকট চলছে। তবে ভারত মনে করে না বাংলাদেশ নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ আছে। মোদি সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার তুলনা চলে না। এ ছাড়া ঢাকা কোনও সংকটে পড়লে দিল্লি যথাসাধ্য সাহায্য করতে পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম, একাধিক নীতি-নির্ধারক, গবেষক, সাবেক কূটনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা একই মত পোষণ করেন।
গত কয়েক দিনে ভারতের একাধিক শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বহু প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এগুলোর মূল কথা একটাই- বাংলাদেশের হাল শ্রীলঙ্কার মতো হবে এমন ভাবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই।
‘দ্য প্রিন্টে’র সম্পাদক ও দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক শেখর গুপ্তা তার ভিডিও ব্লগে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচার করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, পাকিস্তান যদি একেবারে তলানিতে থাকে, তার কয়েক ধাপ ওপরে শ্রীলঙ্কা এবং তারও অনেক ধাপ ওপরে বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে এমনটা ভাবা বিরাট বোকামো হবে।
‘দ্য ওয়াইওন’ আন্তর্জাতিক চ্যানেলের বিশেষ প্রতিবেদন ‘গ্রাভিটাসে’ নিউজ অ্যাঙ্কর পালকি শর্মা উপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে বলেই গেলো গেলো রব তোলার কিছু নেই। ১৯৯০ সালে ভারতের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ ছিল। ডলার একেবারে ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে তাদের আইএমএফের কাছে হাত পাততে হয়েছিল। তাতে ভারতের ভালোই হয়েছে। আজ তিন দশক পর ভারতের অর্থনীতির দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়।
ভারতের আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ইন্ডিয়া অ্যাব্রড নিউজ সার্ভিসেও (আইএএনএস) কলামে লেখক প্রিয়জিৎ দেব সরকার লিখেছেন— ‘হাসিনা স্ট্যান্ডিং ফার্ম ইন থিক অ্যান্ড থিন’। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির নানা ওঠাপড়ার মধ্যেও শেখ হাসিনা কীভাবে শক্ত হাতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন, নিবন্ধে সেটাই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এবং ভারতের অজস্র মিডিয়াতে সেটি প্রকাশ হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির তুলনীয় না হওয়ার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ভারতের বিভিন্ন কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও একটি শীর্ষস্থানীয় স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাঙ্কের গবেষকে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের মত ব্যক্ত করেছেন।
ঢাকায় একসময় ভারতের হাইকিমশনার ছিলেন দেব মুখার্জি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল বা বাংলাদেশ— আমাদের এই গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেই এই মুহূর্তে একটা টালমাটাল অবস্থা চলছে। এখন অবধি ভারত এই সংকটের আঁচ অনেকটাই এড়াতে পেরেছে। এই পরিস্থিতির অনেক কারণ আছে। তবে ইমিডিয়েট ট্রিগারটা অবশ্যই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে যেভাবে জ্বালানির সংকট তৈরি হয়েছে, যেভাবে ডলারের দাম বাড়ছে— তার ফল ভুগতে হচ্ছে উন্নত, উন্নয়নশীল বা গরিব সব দেশকেই। আমি মনে করি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেই সংকটের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। তবে আমার রিডিং হল, গত কয়েক বছর ধরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে রূপরেখা, তাতে বাংলাদেশের যে কোনও বিপদে ভারতের অবশ্যই সাহায্য করা উচিত, আর তারা সেটা করবেও।
জেএনইউ’র অধ্যাপক, দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ড. সঞ্জয় ভরদ্বাজ গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ আইএমএফের সাহায্য চেয়েছে বা সেখানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলেই ভারত মনে করছে সে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়েছে, বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়। ভারত নিজেও অতীতে আইএমএফের সহায়তা চেয়েছে। জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমানোর প্রয়োজনীয়তা ভারতও উপলব্ধি করে। আবার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারতের যে পরিমাণ স্টেক (স্বার্থ) ও ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ) আছে তা অপরিসীম। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন এখন পুরোপুরি বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশকে প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিট দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপদে পড়া মানে এই বিপুল বিনিয়োগ হুমকিতে পড়া। ভারত যা কিছুতেই হতে দিতে চাইবে না। শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের ধারা কিন্তু ভারতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল না। শ্রীলঙ্কা একটা নিজস্ব গতিপথ নিয়ে চলছিল। যার সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কমই ছিল। নানা কারণে সেটা আচমকা মুখ থুবড়ে পড়লো। এখন সেই শ্রীলঙ্কার বিপদেও কিন্তু ভারত সাড়ে চার-পাঁচ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের প্রয়োজনে ভারতকে যে (শ্রীলঙ্কার চেয়েও) অনেক বেশি কিছু করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিস, দিল্লির সিনিয়র ফেলো ড. স্ম্রুতি পট্টনায়ক গণমাধ্যমকে বলেন, গত দুবছরে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অনেকটা কমেছে। তা ছাড়া রফতানি খাতে তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যারা— সেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র বহু অর্ডার বাতিল করায় রিজার্ভেও টান পড়েছে। কিন্তু এগুলো এমন সব বিষয় যার ওপর বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তবে ভারতের নীতি নির্ধারকরা এটা বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনা সরকার যে আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছেন এটা একটা ‘প্রিএম্পটিভ মুভ’— অর্থাৎ অনাগত বিপদ এড়ানোর জন্য আগেভাগেই নেয়া পদক্ষেপ। সোজা কথায়, বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার অবস্থায় না যায়, সেটার জন্য আগে থেকে তারা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যেটা প্রশংসার যোগ্য। আমি বলব, শেখ হাসিনা বরং অনেক বেশি সতর্ক এক্ষেত্রে। বাংলাদেশের দরকারে ভারতের সাহায্য করার অনেকগুলো রাস্তা আছে। ভারত যে লাইন অব ক্রেডিট বাংলাদেশকে দিয়েছে, তার পরিশোধের সময়সীমা গড়ে ১৫ বছর। সেটা পিছিয়ে দেওয়া বা রিশিডিউল করা যেতে পারে। বাংলাদেশের গারমেন্টের কাঁচামাল ভারত থেকেই মূলত যায়। সেটা কেনার সময় ডলারে পেমেন্ট না করে রুপিতে পেমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের ডলার রিজার্ভের ওপর চাপ কম পড়বে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত