পদ্মা ও মেঘনায় সক্রিয় ৪টি নৌ-ডাকাত গ্রুপ, চরের মাটি বিক্রি নিয়ে উত্তেজনা

  কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশ: ৩ জুলাই ২০২১, ২১:০৬ |  আপডেট  : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮

মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলার সীমান্তবর্তী পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনায় তিন থেকে চারটি নৌ-ডাকাত গ্রুপ বিভিন্ন নৌযান গুলোতে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালাচ্ছে। ফলে পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনা এখন নৌযান চালক-শ্রমিকদের আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। ভূক্তভোগীরা সর্বস্ব হারিয়ে নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ায় অনেক ঘটনাই থানায় এজাহার হিসেবেও নথিভূক্ত হচ্ছে না। প্রায়ই পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনা এবং আশপাশ এলাকায় নৌ-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে।

অপরদিকে এসব অপকর্ম ছাড়াও জলদস্যু বাহিনী গুলো পদ্মা ও মেঘনার নদীর তীরের মাটি অবৈধ ভাবে কেটে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে ভরে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর অবৈধ এই মাটি ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে প্রায়ই দুই জলদস্যু বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে জেলহাজত খেটে দ্ইু সপ্তাহ আগে জামিনে বের হয়ে বাবলা গ্রুপের প্রধান নৌ-ডাকাত বাবলা এলাকায় ফিরলে আধিপত্য বজায় রাখা ও পুনরুদ্ধার নিয়ে বর্তমানে আরফান বেপারী গ্রুপসহ ৩ থেকে ৪টি গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে বলে মেঘনা নদীর তীর সংলগ্ন গ্রামবাসী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা ও মেঘনা নদীতে জেগে ওঠার চর দখলে নিয়ে স্থানীয় নৌ-ডাকাত আরফান বেপারী গ্রুপ, বাবলা গ্রুপ, কবির খালাসী গ্রুপসহ একাধিক গ্রুপ অবৈধ ভাবে মাটি কেটে বিভিন্ন ইটভাটায় নিয়ে বিক্রি করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। আর এ মাটি কাটার আধিপত্য বজায় রাখতে নৌ-ডাকাত গ্রুপগুলো একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, পদ্মা ও মেঘনা মোহনায় বিভিন্ন নৌযান গুলোতে ডাকাতি ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধের পাশাপাশি জেগে ওঠা চরের জমি মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় নৌ-ডাকাত আরফান গ্রুপের প্রধান আরফার বেপারী গং। এ জন্য নাসিরাচর গ্রামের জমির মালিকদের মাঝে ৫ লাখ টাকা বন্টন করার কথা থাকলেও দুই-তিন জনকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বেশীর ভাগ টাকাই আত্মসাতের লক্ষ্যে নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছে নৌ-ডাকাত আরফান বেপারী। এ নিয়ে নাসিরাচর গ্রামবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা দিলেও হামলা-নির্যাতনের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারছে না। সৃষ্ট এ সমস্যা নিরসনের আগেই জেলহাজত থেকে ছাড়া পেয়ে নৌ-ডাকাত বাবলা এলাকায় ফেরায় এখন আধিপত্য বজায় রাখা ও পুনরুদ্ধার নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে নৌ-ডাকাত বাবলার নেতৃত্বে তার বাহিনী মেঘনা নদীতে ডাকাতি করে ১৭ লাখ টাকা লুটে নিয়ে যায়। পরে লুট করা ১৭ লাখ টাকা মেঘনা নদী ঘেষাঁ মুন্সীগঞ্জের আধারা ইউনিয়নের কালিরচর গ্রামস্থ শ্বশুর বাচ্চু বেপারীর বাড়িতে বসে ভাগবাটোয়ারা করে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলছে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ সদরের কালিরচর গ্রামের নৌ-ডাকাত আরফান বেপারী বাহিনী বেপোরোয়া হয়ে ওঠায় পদ্মা ও মেঘনা নদী তীরবর্তী একাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে।

অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কালিরচর ও আশপাশ গ্রাম সংলগ্ন পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনায় বিভিন্ন নৌযান গুলোতে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাদাঁবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড চালাচ্ছে একাধিক নৌ-ডাকাত গ্রুপ। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে আরফান বেপারী গ্রুপ। নৌ পথে সংঘটিত অপরাধের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও নৌ-ডাকাত গ্রুপের সদস্যরা দ্রুতগামী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার আবার কখনো কখনো স্পিডবোট দিয়ে পালিয়ে যায়। মেঘনা নদীতে মতলবের মহনপুর, গজারিয়া থানা ও মুন্সীগঞ্জ সদর থানাধীন চরআব্দুল্লাপুর নৌ-ফাঁড়ির পুলিশ টহল দিলেও  অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে দ্রুত গতির স্পিডবোট ব্যবহার করে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ায় পুলিশ নৌ-ডাকাতদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পুলিশ যাতে গ্রেফতার বা আটক করতে না পারে-সে লক্ষ্যে নৌ-ডাকাত বাহিনীর সদস্যরা কৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন স্থান থেকে স্পিডবোট ভাড়ায় নিয়ে আসে। এছাড়া তাদের নিজস্ব কয়েকটি স্পিডবোটও রয়েছে।

স্থানীয় গ্রামবাসী জানায়, পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনার এক পাশে মতলব, মহনপুর ও চাঁদপুর এলাকা এবং অপর পাশে মুন্সীগঞ্জের বাংলাবাজার, বকচর, কালিরচর ও চরআব্দুল্লাহ গ্রাম। এ বাহিনী প্রতিনিয়ত নদীতে চলাচলরত বালুবাহি বাল্কহেড, তেলবাহি জাহাজ, যাত্রীবাহি লঞ্চ, স্টিমার ও নদীতে মাছ ধরার জেলেদের ট্রলারে হামলা চালিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে আসছে।

অভিযোগ রয়েছে, পদ্মা ও মেঘনা নদীতে টহলরত কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশের কতিপয় সদস্যদের সঙ্গে গোপন যোগসাজশ রয়েছে নৌ-ডাকাতদের। এছাড়া অনেক সময় নৌ-পুলিশ সদস্যরা গ্রেফতারে অভিযান চালালেও জেলার সীমানা জটিলতার কারনে মাঝ পথেই থেমে যায় গ্রেফতার অভিযান। গজারিয়া ও মুন্সীগঞ্জ থানার নৌ পুলিশ চাঁদপুর জেলার মতলব থানার মহনপুর সীমানায় প্রবেশ করে না। আবার মতলব থানার মহনপুর নৌ পুলিশ মুন্সীগঞ্জ জেলার সীমানা অতিক্রম করে না। আর এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ২টি নৌ-ডাকাত গ্রুপ পদ্মা ও মেঘনা নদীতে বেপোরোয়া হয়ে ওঠায় অপর ২টি গ্রুপ কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নদীর তীর সংলগ্ন কালিরচর, চর আব্দুল্লাহ, বকচর, নাসিরাচরসহ আশপাশ গ্রামের শত শত গ্রামবাসী এই নৌ-ডাকাত গ্রুপদের প্রতিরোধের লক্ষ্যে পুলিশ প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ আশা করছেন।

এ প্রসঙ্গে সদর থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, সাম্প্রতিক সময়ে অভিযান চালিয়ে নৌ-ডাকাতদের একটি স্পিডবোট জব্দ করা হয়। পুলিশ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার দিয়ে অভিযান চালালে নৌ-ডাকাতরা দ্রুতগামী স্পিডবোট ব্যবহার করে পালিয়ে যায়। আর এ কারনে নৌ-ডাকাতদের গ্রেফতার করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। তারপরও নৌ ফাড়িঁর পুলিশ সদস্যরা প্রতিদিনই দিনে-রাতে টহল কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত