পদ্মায় ভাঙন: মুন্সীগঞ্জের ১৭টি গ্রামের মানুষ কাটাচ্ছে নির্ঘুম রাত

  কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২১, ১৯:৪৭ |  আপডেট  : ১৯ মে ২০২৪, ০২:৫৬

বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই খরস্রোতা পদ্মার ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে মুন্সীগঞ্জের বিস্তীর্ণ জনপদ। পানি বৃদ্ধিতে পদ্মা নদী উত্তাল হয়ে ওঠায় স্রোতের সঙ্গে বাতাসের তীব্রতায় পদ্মার বড় বড় ঢেউ আছঁড়ে পড়ছে তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর ৬টি গ্রাম, লৌহজংয়ের ৮টি গ্রাম ও সদর উপজেলার ৩টি গ্রাম নিয়ে ১৭ টি গ্রামে এখন পদ্মার ভাঙন তান্ডব চলছে। ইতিমধ্যে ভাঙ্গন তান্ডবে ৩টি উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রাম গুলোর একাধিক ঘরবাড়ী, স্থাপনা ও বিস্তীর্ণ কৃষি জমি খরস্রোতা পদ্মার তলদেশে বিলীন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে পদ্মার ভাঙনের কবলে হুমকির মুখে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল, মসজিদ-মন্দিরসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এই পরিস্থিতিতে পদ্মার তীরের ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলিন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। আর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে একদিকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে একাধিক পরিবার অন্যদিকে ভাঙ্গন আতঙ্ক কেড়ে নিয়েছে মানুষের চোখের ঘুমও। কখন বসতভিটা গিলে ফেলে রাক্ষুসী পদ্মা, এই ভয়ে রাত জেগেই পদ্মার রুদ্রুমূর্তি প্রত্যক্ষ করা ও আছঁড়ে পড়া বড় বড় ঢেউয়ের গর্জন শুনে জীবনযাপন করছে জেলার ৩টি উপজেলার অসংখ্যা পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মার ভাঙনের মুখে থাকা বাড়িঘর ও গাছপালাসহ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে শেষ সম্বল। লৌহজং উপজেলার কনকসার ঝাউটিয়ার জেলেপাড়ায় এখন বিরাজ করছে ভাঙন আতঙ্ক। দু’টি মন্দির আর একাধিক পরিবারের বাড়িঘর নিয়ে গ্রামবাসী রয়েছে বড় দুশ্চিন্তায়। এসব স্থাপনা ভেঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার জায়গাও নেই। তাই নদী ঘেঁষা গ্রামের পরিবারগুলো একরকম নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে পদ্মার তীরেই। ভাঙ্গনকবলিত পরিবারের সদস্যরা জানান, বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই পদ্মা নদীতে স্রোতের তীব্রতা বৃদ্ধিতে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো। টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘিরপাড়, কামারখাড়া, হাসাইল-বানারী ও পাচঁগাঁও ইউনিয়নে ভাঙ্গন শুরু হওয়ায় অসংখ্য বসতবাড়ী ও বিস্তীর্ণ কৃষি জমি পদ্মার ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। তীরবর্তী গ্রামবাসী জানায়, ভাঙ্গন ঠেকাতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা না হলে পদ্মার ভাঙ্গন তান্ডব আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এমনিতেই করোনা আতঙ্ক, এর মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হওয়ায় পদ্মা পাড়ের খেটে খাওয়া মানুষের দিন কাটছে দুশ্চিন্তায়। এছাড়া পদ্মার তীব্র স্রোতের সো সো শব্দ ও তীরে আছঁড়ে পড়া বড় বড় ঢেউয়ের গর্জন শুনে আতঙ্কিত পদ্মাপাড়ের মানুষ। রাতের নিরিবিলি পরিবেশে উত্তাল পদ্মায় বড় বড় ঢেউয়ের গর্জনের শব্দ কখনও কখনও ভয়ঙ্কর হয়ে আকস্মিক ভাঙ্গন তান্ডব শুরু হয়ে যায়। তাই নদী তীরবর্তী গ্রামের শত শত মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয়রা জানান, বর্ষার শুরুতে এবারও পদ্মার ভাঙন দেখা দিয়েছে লৌহজংয়ের ৮টি গ্রামে। এর মধ্যে ১১৯ বছরের প্রাচীন ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে এখন পদ্মা প্রবাহিত। তাই বিদ্যালয়টির নির্মাণাধীন ৪তলা ভবন, শহীদ মিনার, প্রশাসনিক ভবন সবই ভাঙনের মুখে পড়েছে যেকোনো সময় এসব স্থাপনা পদ্মায় বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরী হওয়ায় বর্তমানে সেগুলো রক্ষায় ফেলা হচ্ছে বালু ভর্তি বস্তা। লৌহজং উপজেলার ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হোসেন খসরু বলেন, প্রায় ৩০ লাখ টাকা বরাদ্ধ হচ্ছে ভাঙ্গন প্রতিরোধে। আশা করি, ১১৯ বছরের প্রাচীন বিদ্যালয়টি রক্ষা করতে পারবো। ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের মধ্য বয়সী নারী আলেয়া বেগম জানান, রাক্ষুসী পদ্মা এখন পৈত্রিক ভিটে বাড়ির পাশে চলে এসেছে। আর যেভাবে ভাঙছে এতে বাড়িঘর সব ভেঙে যাবে। বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় থাকবো-তা ভেবে পাচ্ছি না।

অন্যদিকে গতবছরও খড়িয়া গ্রামে পদ্মার ভাঙনে অর্ধশতাধিক বাড়িঘর এবং  লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের পাইকারা আশ্রয়ন প্রকল্পের অর্ধেক অংশ পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এবারও ভাঙ্গন দেখা দেওয়ায় গ্রামগুলো পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে লৌহজং উপজেলার মানচিত্রই পরিবর্তন হয়ে ছোট পরিসরের উপজেলায় রূপ নিবে।

লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হুমায়ুন কবির বলেন, পদ্মার ভাঙনরোধে লৌহজংয়ের খড়িয়া থেকে টঙ্গিীবাড়ীর দিঘিরপাড় পর্যন্ত একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ীর পদ্মার তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হলে ভাঙন ঠেকানো যাবে। বর্তমানে লৌহজংয়ের ৮টি গ্রাম, টঙ্গিবাড়ীর ৬টি গ্রাম ও মুন্সীগঞ্জ সদরের ৩টি গ্রামে এখন পদ্মার ভাঙনের মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে লৌহজংয়ের পদ্মা রিসোর্টসহ আশপাশের অনেক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে পদ্মায়। তাই জনপদ রক্ষায় এখন বালু ভর্তি বস্তা ফেলা হচ্ছে। এছাড়া পদ্মার ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তালিকা তৈরীসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

অপরদিকে টঙ্গিবাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জগলুল হালদার ভুতু জানান, টঙ্গিবাড়ীর দিঘিরপাড় বাজারের দোকানঘরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গত বছরও দিঘিরপাড় বাজারসহ আশপাশ এলাকা ভাঙ্গন দেখা দেয়। এরপরই  ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩০০ ফুট এলাকায় ১৬ হাজার ৪০০ জিও ব্যাগ ভর্তি বালুর বস্তা ফেলে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে। তিনি জানান, গত বছরের ন্যায় চলতি বর্ষা মৌসুমে পদ্মার ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে টঙ্গিবাড়ি ও সদর উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম গুলোতে।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, ৩’টি উপজেলার কোথাও কোথাও পদ্মার ঘুর্ণায়মান স্রোত থাকায় মুর্হুতের মধ্যে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলেও ভাঙ্গন রোধ করা যাচ্ছে না। স্রোতের তীব্রতায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এরপরও লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার একধিক পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

পানি উন্নন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী টিএম রাশিদুল কবীর জানান, জরুরী ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ভর্তি বালু ফেলে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে লৌহজংয়ের খড়িয়া, দক্ষিণ হলদিয়া হয়ে টঙ্গিবাড়ির দিঘিরপাড় পর্যন্ত ৮ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প একনেকের বৈঠকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত