পদ্মাসেতু শেখ হাসিনার উন্নয়নের রোল মডেল

  ওসমান গনি 

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২২, ১০:৩৪ |  আপডেট  : ১১ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪২


 


যোগাযোগ ক্ষেত্রে পদ্মাসেতু নির্মান করে বাঙালি জাতির জন্য এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে স্বীকৃত। দেশের সকল শ্রেনীপেশার মানুষের উপস্থিতিতে ২৫ জুন/২২ ইং সকল ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্ভোধন করে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেন। পদ্মাসেতুর এ আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধনও বাঙালি জাতির জন্য একটা ইতিহাস। এ অনুষ্ঠান বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে।

এ সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা উত্তরবঙ্গের মানুষের নিকট যোগাযোগ ক্ষেত্রে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করবে। মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া, মাদারীপুর জেলার শিবচর ও শরীয়তপুর জেলার ৬ কোটি  মানুষের দীর্ঘদিনে লালিত স্বপ্ন আশা আঙ্খাংকা ও ইচ্ছার প্রতিফলন বাস্তবায়ন করলেন  বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেটা ছিল বাংলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মাসেতু। যা এখন আর মানুষের কাছে স্বপ্ন নয়। এ পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন মানে হলে আকাশের চাদ হাতে পাওয়া। এ পদ্মাসেতু নিয়ে বাঙালি জাতির মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে বিভিন্ন মত-দ্বিমত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে আলোচনা সমালোচনা। নানারকম বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনা তার ভিশন বাস্তবায়ন করেছেন দেশের জনগণের কল্যাণে। তিনি জানেন, যেকোন ভাল কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই। তাই বলে থেমে থাকা যাবে না। তাই তিনি তার দেশের নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের দ্বিতীয় ব্হৎ পদ্মাসেতু নির্মান করেছেন। ২৫ জুন ২২ ইং তারিখে এক অনাড়ম্বর জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ভোধন করলেন স্বপ্নময়ী পদ্মাসেতু। খোলে দেয়া হলো দেশের দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা পদ্মাসেতু। এ সেতু নির্মান করে তিনি শুধু তিনি বাঙালি জাতির মধ্যে ইতিহাস সৃষ্টি করেনি সৃষ্টি করেছেন সারাবিশ্বে ইতিহাস। 

এ সেতু নির্মানে জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল অনেক আগেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ায় সেই সেতু তিনি দেখে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে জনগণের রায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে যমুনার ওপর নির্মাণাধীন সেতুর কাজ দ্রুত গতিতে শেষ করে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সেতু উদ্বোধন করেন। নিজ কন্যার হাতেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা। তিনি পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন। যে সেতু নির্মানে দেশের দেশের রাজনৈতিক ও কিছু অরাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি বিশেষের বিরোধীতার কারনে  বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অদম্য সাহস নিয়ে ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু আমরা নিজেরাই করব। ভয়ের কোন কারন নেই। যেই প্রতিজ্ঞা সেই কাজ। বাংলাদেশের জনগণের টাকায় ই হবে পদ্মাসেতু। ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাত। অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে পদ্মা সেতু করব না। আমাদের জনগণের টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুতে রেলপথ সংযোজনের জন্য নির্দেশনা দেন। তার নির্দেশ মতো সেতুর ডিজাইন বা নকশা পরিবর্তন করা হয়। ওপরে মোটরযান সড়ক এবং নিচে রেলপথ অর্থাৎ দোতলা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ওপরে চারলেনের মোটরযান সড়ক এবং নিচে একলেনের রেলপথের ব্যবস্থা রেখে নকশা তৈরি হয়।

 

সেতুর নকশা পরিবর্তন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও সময় ক্ষেপণের জন্য নির্মাণ ব্যয়ের প্রাক্কলনও বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এ ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে মূল সেতু, নদীশাসন, জমি অধিগ্রহণ, দুই পারে সংযোগ সড়ক নির্মাণ, পুনর্বাসন, কর্মীদের বেতন সব মিলিয়ে তৃতীয়বারের মতো পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পে ৪০০০ কর্মী কাজ করছে। ২০০৭ সালে মার্কিন ডলার ও টাকার বিনিময় হার ছিল ৬৮.৬৫ টাকা। অর্থাৎ এক মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৬৮.৬৫ টাকা। ২০১৮ সালে এ হার হয় ৮৪.৮০ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে প্রকল্প ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। এটা একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। কাজেই ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে এ কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত না করাই শ্রেয়। প্রয়োজনেই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাই বাস্তবতা।

৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮.২ মিটার প্রস্থের পদ্মা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশ তথা পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সবচেয়ে বৃহৎ সেতু। সেতুটি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং শরীয়তপুরের জাজিরাকে সংযুক্ত করেছে। পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা হবে ৬০ ফুট। মোট পিলার ৪২টি। কংক্রিট ও স্টিল সামগ্রী দিয়ে সেতু নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি পিলারের জন্য পাইলিং ৬টি। পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৬৪টি। পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ফুট। এসব তথ্য নির্মাণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গই জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করেছে। তারপরও কুচক্রি মহল সেতু সম্বন্ধে নানা রকম অপপ্রচার চালিয়েছে। দেশের ভালো কিছু তাদের ভালো লাগে না।

পদ্মা সেতুতে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও আরও আছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা। সেতুর জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে পদ্মার দুই পারের জমির মালিক ও জনগণের অবদান অপরিসীম। সবাই সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করেছে। সরকারের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চুক্তি সই হয়। ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ হলো কানাডার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এসএনসি লেভালিন (SNC Lavalin) কাজ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রী, সেতু সচিব, সেতু প্রকল্পের পিডি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। তারা জোর দাবি করে তাদের কাছে দুর্নীতির যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে।

বাংলাদেশ সরকার এত সব ব্যবস্থা নিলেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। তারা ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ঋণচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে জাইকা, এডিবি ও আইডিবি ঋণচুক্তি বাতিল করে। কানাডার একটি আদালত SNC LAVALIN এর দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। পরে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ আদালত অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে মামলা খারিজ করে দেয় এবং অভিযুক্তরা খালাস পায়। বাংলাদেশের দুদকের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় আদালত আসামিদের খালাস দেন। বিশ্বব্যাংক তদন্ত করেও দুর্নীতির পক্ষে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পায়নি। কানাডার আদালতে এবং বাংলাদেশের দুদকের তদন্ত দলের কাছে বিশ্বব্যাংক কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। তারা ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টম্বর। সর্বশেষ স্প্যান অর্থাৎ ৪২তম স্প্যান বসে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেতু নির্মান কাজ সমাপ্ত করে জুন ২৫/২০২২ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ভোধন করে যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়া হয়। এ সেতু চালুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ৬ কোটি মানুষের ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে। খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি আর গদখালীর ফুল, বরিশালের ধান ও পানসহ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি পণ্য ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি সম্ভব হবে। যশোর ও ফরিদপুরের খেজুরের গুড়ের  রফতানি বৃদ্ধি পাবে। পটুয়াখালী থেকে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন মাছ জেলার বাইরে রফতানি হয়। সেতু উদ্বোধনের ফলে মাগুরার লিচু চাষিরা আগামী বছর থেকে প্রতি মৌসুমে অন্তত ৫০ কোটি টাকার বাড়তি লিচু বিক্রি করতে সক্ষম হবেন। লিচুর পাশাপাশি মাগুরায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি, ১২ হাজার হেক্টরে পেঁয়াজ। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি পণ্য। চিংড়ি উৎপাদনের ৯০ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয় খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে। সেতুর ফলে চিংড়ি খামারের উৎপাদনশীলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। 


লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত