দায়বন্ধন    

  সাজ্জাদুর সিরাজ নিবিড়

প্রকাশ: ৭ জুলাই ২০২১, ১২:১৮ |  আপডেট  : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:০৮

সূর্য যখন মাঝ গগন থেকে পশ্চিমে এলিয়ে পড়েছে, সদা হাস্যদীপ্ত লামিয়া পাশের বাড়ির উঠেনে কুতকুত (গ্রাম্য খেলা) খেলায় ব্যস্ত তার সাথীদের নিয়ে। লামিয়ার বয়স নয় বছরে পড়েছে। গায়ের বর্ণ কিঞ্চিৎ কৃষ্ণ হলেও নজরুলের মত ঝাপসা চুল আর মোনালিসার মত ভুবনমোহনী হাসি সকলের হৃদয়েই মেয়েটির জন্য মায়ার স্থান করে দেয়। বাবা কর্মহীন হলেও  আশেপাশের বাড়ির মানুষের কাজে সামান্য সাহায্য করে তার নিত্য বিড়ির খরচ যোগাড় করতে পারলেই সন্তুষ্ট। দুই কন্যসহ সংসারের সমস্ত দায় লামিয়ার মায়ের। তিন বাড়ি কাজ করে দুই মেয়ের অন্নের সংস্থান করেন লামিয়ার মা।

লামিয়াদের খেলায় অকস্মিক যুক্ত হয় লামিয়াদের পাশের বাড়ির বড় ভাই (নাম কবি)। বড় ভাইয়ের খেলায় যুক্ত হওয়ায় তাদের খেলার আমোদ যে কিছুটা বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আছরের আজান দেয়ার কিছু পূর্বেই তাদের খেলার পন্ড হয়। লামিয়া তার সাথীদের নিয়ে দৌড়ে চলে যায় পাশের আরেক বাসায়। হয়ত নতুন খেলার আয়োজন করবে তাই। ঠিক তখন একটি শুভ সংবাদে আশেপাশের চার বাড়িতে আনন্দ যেন বাঁধ ভাঙ্গে। কবি ভাইয়ের চাকরি হয়েছে জনতা ব্যাংকে। এই খবর শুনে দৌড়ে আসে লামিয়া বলে ভাই মিষ্টি খাওয়াবেন কবে? মিষ্টি খাওয়ার আবেদনের চাইতে তার চোখে আনন্দের স্থান বেশি। দারিদ্র্য পরিবারের সন্তান হওয়ায় একটু ভাল খাবার পেলেই খুশিতে ভরে উঠত তার মন। কবির চাচী, যিনি তাদের সমগ্র সংসারের কর্তা, মাঝে মাঝেই লামিয়াকে দুধভাত খাওয়াতো তখন লামিয়ার মনের তৃপ্তি ফুটে উঠতো তার চোখে। কবি তাকে মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বলে বের হলো তার মায়ের কবর জিয়ারত করতে। তার এই সুখের দিনে মায়ের সাথে সুখের বিনিময় করার সুযোগ না থাকলেও পরলোকগত মায়ের জন্য দুহাতে দোয়া করাতেই যেন কবির শান্তি।

কবরস্থান হতে ফেরার পথে মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরছে কবি। আকস্মিক তার ফোনে কল এলো লামিয়া বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়েছে। তাৎক্ষনিক অনেকেই ভেবেছিল লামিয়া ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে। এলাকার কিছু তরুণের সহায়তায় দ্রুত তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার তাকে জরুরী চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে বলেন। কবি হাসপাতালে যাওয়ার পথেই দেখে এ্যাম্বুলেন্স লামিয়াকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে রাজধানী শহরে। কবি আর তার বন্ধু রাজু রিক্সা থেকেই দেখলো লামিয়ার মলিন হাঁসি, বেঁচে আছে সে। কে জানতো এই দেখাই হয়ত শেষ দেখা। আগেই বলেছি দারিদ্র্য পরিবারের সন্তান লামিয়া। সন্তানের তিনবেলা খাওয়ার যোগান যেখানে কষ্টসাধ্য সেখানে লামিয়ার মা কীভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার বহন করবে। তাৎক্ষনিক কিছু টাকা ধার করেই তারা ঢাকায় রওনা হয়। নিস্তব্ধতার একটা গভীর মেঘে ঢেকে যায় পুরো এলাকা।

লামিয়া যেখানে বিদ্যুতস্পৃষ্ট সেই জায়গাটি স্থানীয় তিন ধনীর। গ্রামে বিশাল বাড়ি থাকলেও তারা শহরবাসী। সম্প্রতি তিন মালিক মিলে বিশাল একটি পুকুর বালু দিয়ে ভরাট করেছে। পুকুরের উপর দিয়ে চলে গেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইন। কোটি টাকা ব্যয় করে পুকুর ভরাট করলেও, ভরাটের ফলে মাথা ছুঁয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উপরে উঠানোর কোন ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেনি। এমনকি বাড়ির বাউন্ডারি ওয়াল করার সময় মিস্ত্রীরা কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ভরাট জায়গাটির তিনজন মালিকের কারো পরিবারই গ্রামে না থাকায় সকলকে বিপদের সম্মুখে ফেলে তারা ঢাকায় বাস করেন।  

লামিয়াকে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে। লামিয়ার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা এলাকার সকলেরই জানা ছিল তাই এলাকার তরুণেরা এগিয়ে আসে সাহায্যে। লামিয়া বৃহস্পতিবারে ভর্তি হয়। শুক্রবারে এলাকার তরুণেরা মসজিদ থেকে টাকা উঠায়, স্থানীর বাজার থেকে টাকা উঠায়, স্থানীয় বিত্তশালীদের কাছে হাত পাতে, সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে চলে লামিয়ার চিকিৎসা ব্যয়। গ্রাম এবং প্রবাসের স্থানীর সকলেই এগিয়ে আসে লামিয়ার চিকিৎসায়। কিন্তু এই চিকিৎসা ব্যয় বহন করার কথা ছিল ওই তিন মালিকের। কিন্তু তারা কিঞ্চিৎ সাহায্য করে আর যোগাযোগ করেনি। একটা প্রবাদ আছে, জন্তুর পেটে জন্তুর জন্ম হয়। কিন্তু মানুষ তার ব্যতিক্রম। মানুষের পেটে মানুষ এবং মানুষরূপের জন্তুর জন্ম হয়। এই প্রবাদের যথার্থ প্রত্যক্ষ করলো সমগ্র একালাবাসী।

লামিয়ার শরীরের ৪২ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। নরক সম যন্ত্রনায় লামিয়া বেঁচে ছিল সাত দিন। সেই সাত দিনের অধিকাংশ সময় তার চোখে ঝরেছে অশ্রু অবিরাম। লামিয়ার সখ ছিল বেঁচে ফিরবে ঘরে। আবার খেলবে তার খেলার সাথীদের সাথে। লামিয়ার মায়ের মুখে শুনেছি, লামিয়ার পেটের নিচ থেকে পা পর্যন্ত চামড়া খসে পড়েছিল। পরের সপ্তাহে বুধবার সকালে লামিয়া ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে। এলাকার সেই তরুণেরা কবর খোঁড়ে, কাফনের ব্যবস্থা করে। গোসলের সময় খোলা হয়নি লামিয়ার গায়ের ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলেছিল ব্যান্ডেজ খুললে লামিয়ার গায়ের মাংস খসে পড়ার সম্ভবনা আছে। বধবার বাদ আসর দাফন করা হয় লামিয়াকে।

সমগ্র এলাকার যখন শোকের ছায়া, দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসেছিল লামিয়ার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতে কিন্তু আসে নি মানুষরূপের সেই তিন নর পিশাচ। গ্রহণ করে নি কোন দায়। বাংলাদেশের সংবিধানে আইন সকলের জন্য সমান হলেও বাস্তবে তা প্রতিফলিত হয় নি। দারিদ্র্য পরিবারটি পায়নি কোন আইনি সহায়তা কিংবা গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যানের সহায়তা। এই মৃত্যু অবহেলা জনিত হত্যাকাণ্ড। যার সমস্ত দায় ওই যায়গার তিন মালিকের। এভাবেই আবহমান কাল থেকেই নির্যাতিত, উপেক্ষিত হচ্ছে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ। অপরদিকে অপরাধ করে শান্তিতেই আছেন সমাজের বিত্তশালিরা।  
কবি হয়ত সারাজীবন অনেক মানুষকে মিষ্টি কিনে খাওয়াবে, কিন্তু আক্ষেপ থেকে যাবে লামিয়ার জন্য।
সমাজের সকলকে দায়বদ্ধ করে চলে গেল লামিয়া। এই দায়বদ্ধতার থেকে সমাজ মুক্ত হবে কবে?


 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত