তৃনমূলে মুক্তিযুদ্ধ: মুন্সীগঞ্জে ২৯ মার্চ লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়

  কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ০৯:৫৬ |  আপডেট  : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ২২:০৩

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনে নির্দেশনার পর ১০ মার্চ মুন্সীগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিপাগল ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। গঠিত মহাকুমা সংগ্রাম কমিটিতে ডাঃ এম এ কাদেরকে আহবায়ক করা হয়। এ কমিটি পরবর্তীতে সকল থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। 

২৭ মার্চ জামালউদ্দিন চৌধুরীর নেতুত্বে ছাত্র শ্রমিক-কৃষক-জনতা সিরাজদিখান থানা পুলিশ ক্যাম্পের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। ২৯ মার্চ মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে তৎকালীন শহীদ মিনারে মুক্তি পাগল ছাত্র জনতার সম্মুখে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই দিন মুন্সীগঞ্জে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় ছাত্র ও জনতা। 

এরপর তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে প্রশিন শুরু করে এবং পাক হানাদার ও তার দোসর রা যাতে মুন্সীগঞ্জে ঢুকতে না পারে সে জন্য জেলার সর্বত্র টহল ও মহড়া দেওয়া শুরু করে।৩১ মার্চ পাকবাহিনী নারায়নগঞ্জে আক্রমন করলে মুন্সীগঞ্জের দামাল ছেলেরা নারায়নগঞ্জের মানুষের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ৪ ঘন্টা যুদ্ধে অংশ নেয়। ২০ এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের মুক্তিপাগল জনতার যুদ্ধ হয়। এরপর অনেক প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ৯ মে পাকবাহিনী ঢুকে পড়ে মুন্সীগঞ্জে।

তারা গজারিয়ায় হানা দিয়ে ফুলদী নদীর তীরে ৩৬০ জেলে ও কৃষককে ব্রাশফায়ার করে হত্যার মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জে প্রবেশ করে। এরপর পাকবাহিনী মুন্সীগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজে অবস্থান নেয় এবং মো. আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরীকে আহবায়ক করে শান্তি বাহিনী গঠন করে। এছাড়া অন্যান্য থানা শান্তি কমিটিও গঠন করে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।

যুদ্ধে অংশ নেওয়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধারা জানায়, পাকসেনারা এ সময় পাকসেনারা মুন্সীগঞ্জ মহাকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ডাঃ এম এ কাদেরের বাড়ি, যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোহাম্মহোসেন বাবুলের বাড়িসহ বেশ কিছু বসতবাড়ি পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। একই সময়ে গজারিয়ার চর ও জেলে পল্লীতে প্রবেশ করে ২’শ নিরীহ মানুষকে হত্যা ও গনহারে নারী ধর্ষনে মেতে ওঠে পাকহানাদাররা।

১৪ মে শহরের অদূরে কেওয়ার চৌধুরী বাড়িতে হানা দিয়ে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা ও ৫০ জন মহিলাকে ধর্ষন করে। ধলাগাওঁ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হানা দিয়ে ১০ মহিলাকে ধর্ষন করে।এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনি ১০ থেকে ১৫ জনকে ধরে নিয়ে তৎকালীন মুন্সেফ কোর্টের বটগাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হতা করা অব্যাহত রাখে হানাদার বাহিনী।

এ অবস্থায় মুক্তিপাগল ছাত্র যুবক স্বাধীনতার পে মুক্তিুযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় ট্রেনিংয়ে যেতে শুরু করে। ভারত থেকে প্রশিন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি জুনের শেষ দিয়ে মুন্সীগঞ্জে ফিরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এ সময় তারা প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় ছাত্র ও যুবককে ক্যাম্প থেকে ১৫ থেকে ২০ দিনের গেরিলা প্রশিন দেওয়া হয়। এতে জেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫শ’ তে উপনীত হয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।

১১ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা শ্রীনগর থানায় পাকসেনাদের উপর আক্রমন করে এবং তুমুল যুদ্ধের পর থানা দখল করে নেয়। ১৩ আগষ্ট টঙ্গিবাড়ি থানার আব্দুল্লাপুর বাজারে হানা দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। সেখানে পিস কমিটির সভা চলাকালে জেলার অন্যতম স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তান জমিয়তে নিজাম ও ওলেমা পাটর্রি কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি মোস্তাফা আল মাদানীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৪ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা লৌহজং থানায় আক্রমন করে তার দখল করে নেয়। 

১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুন্সীগঞ্জ শহরের শান্তি কমিটির কার্যালয়ে অভিযান চালায়। এ অভিযানে শান্তি কমিটির নিদের্শনা কারী এড্যাভোকেট ইদ্রিস আলী বেচেঁ গেলেও মারা যায় সদস্য দুদু মিয়া।

সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ৈখালীর শিকরামপুর হাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। নবাবগঞ্জ থেকে ৩টি গানবোট বোঝাই পাকসেনারা শিকরামপুরে পৌছলে মুক্তিযোদ্ধারা সশন্ত্র হামলা চালায়। এ যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়।মুক্তিযোদ্ধারা জানায়, পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরী ও ইছামতি ঘেরা মুন্সীগঞ্জ জেলায় ভরা মৌসুমে নদী ও খালবেষ্টিত সকল পথ গেরিলা যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন পন্থায় গেলিরা যুদ্ধ শুরু করে।

মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানায়, টঙ্গিবাড়ির আব্দুল্লাপুর বাজারে পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। মুন্সীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশন শুরু হয় আব্দুল্লাপুর বাজার ক্যাম্পে হামলার মধ্য দিয়ে। ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালায়। এতে হানাদার বাহিনী পরাস্ত হয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। এ যুদ্ধে ২ পাক সেনা ও ১১ রাজাকার নিহত হয়।

২৪ সেপ্টেম্বর ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদুল ইসলাম সাঈদসহ মুক্তিযোদ্ধারা গোয়ালীমান্দ্রায় সফল অভিযান চালিয়ে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক পাকসেনাকে হত্যা করে। ২৫ সেপ্টেম্বর সিরাজদিখানের সৈয়দপুর লঞ্চঘাটে পাক সেনাদের সঙ্গে ফাইট সার্জেট ওমর গ্র“পের যুদ্ধ হয়। এতে ৯ পাকসেনা নিহত হয়। এ মাসেই সিরাজদিখানে পাকসেনাদের দালাল হেডমাস্টার হাবিবুর ও হবি মেম্বারকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মিরকাদিমে রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন চালায়। এতে বেশ কিছু রাজাকার নিহত হয়। এছাড়া ধলাগাও, সাধুর আখড়া ও টঙ্গিবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েকটি ছোট অপারেশন চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধারা ধলাগাও বাজারে প্রবেশ করে পাকসেনাদের ক্যাম্প গেরিলা কায়দায় ঘিরে ফেলে দুই ঘন্টা যুদ্ধ করে। এতে ৩ পাক সেনা নিহত হয়।

১ নভেম্বর গজারিয়ার ভাটি বলাকি গ্রামে অপারেশন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জেলার অন্যতম স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লীগ নেতা আফসারউদ্দিন ও তার ভাতিজাকে হত্যা করে। 

৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা টঙ্গিবাড়ী থানা দখল করে নেয়। ৮ নভেম্বর সিরাজদিখান আক্রমন করলেও ১৯ নভেম্বর দ্বিতীয় দফা সফল আক্রমনে পাকবাহিনী সিরাজদিখানে আত্নসমর্পন করেন।

মুন্সীগঞ্জ, টঙ্গিবাড়ী ও গজারিয়া এ তিন থানার বিএলএফ এর যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোহাম্মদ হোসেন বাবুল জানান, ১৪ নভেম্বর রাতে মুন্সীগঞ্জ থানা দখল করার জন্য রামপাল এনবিএম উচ্চ বিদ্যালয়সহ একাধিক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। পরে ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৭টি গ্র“পে ভাগ হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া হয়। এ ৭টি গ্র“পে তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধা আনিসুজ্জামান আনিছ, মৃত খালেকুজ্জামান খোকা, আনোয়ার হোসেন অনু, এসপি আনোয়ার হোসেন ও মোফাজ্জ্লসহ ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত ২টার সময় মুন্সীগঞ্জ থানা দখল করার জন্য আক্রমন করা হয়। এ সময় তুমুল যুদ্ধের পর তারা সদর থানা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং ২৭টি রাইফেল লুট করে নিয়ে যান।

এছাড়া লৌহজং থানা অপারেশনেও যুদ্ধকালীন কমান্ডর শহীদুল ইসলাম সাঈদের সঙ্গে থেকে থানা দখল করতে আক্রমন করেন মোহাম্মদ হোসেন বাবুল। তিনি জানান, এ থানা আক্রমনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আতœসমর্পনকারী রাজাকার কোটগাওয়ের তারা মিয়া তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে গজারিয়ায় কমান্ডর নজরুল ইসলাম যুদ্ধে লিপ্ত থাকা অবস্থায় পাক সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে। আর মুন্সীগঞ্জের কৃতি সন্তান ও বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহমদকে কুখ্যাত আলবদররা হত্যা করে। এছাড়া যেসব মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে মারা যান। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৬ থেকে ৭টি দল বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের উপর আক্রমন অব্যাহত রাখেন। তাদের উপর নিপে করা হয় মর্টার সেল। এতে অবস্থা বেগতিক দেখে পাক সেনারা তাদের বিভিন্ন ক্যাম্প ত্যাগ করে দলে দলে ধলেশ্বরী নদীর তীড়ে অবস্থান নেয়।

এদিকে নভেম্বরের শেষের দিকে গজারিয়ার বাউশিয়া এলাকায় আবেকটি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার নজরুল ইসলাম। এতে পাকবাহিনী একপর্যায়ে আতœসমর্পন করেন। আতœ সমর্পনের পর কমান্ডার নজরুল ইসলাম স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে গেলে আতœসমর্পনকারী এক পাক সৈন্য গুলি চালালে তিনি নিহত হন।

৪ ডিসেম্বর চুরান্ত যুদ্ধ হয় শহর সংলগ্ন রতনরপুর এলাকায়। এ যুদ্ধে বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাক সেনাদের ৩টি বড় দলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকসেনারা ধলেশ্বরী নদীতে থাকা গানবোট থেকে মর্টার সেলিং করছিল। এ সময় মিত্র বাহিনীর বিমান বহন এসে পড়লে পাকসেনারা পিছু হটে। পরে মিত্র বাহিনীর আক্রমনে পাকসেনাদের গানবোট বিধধস্ত হয়। এ যুদ্ধে ৩ পাকসেনার লাশ পাওয়া যায়। স্থানীয় ১৪ থেকে ১৫ জনের মতো নিরীহ মানুষ মারা যায়। এরপর ১০ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে প্রচন্ড শীতের ঘন অন্ধাকারে হানাদার বাহিনী মুন্সীগঞ্জে তাদের সুরতি দূর্গ হরগঙ্গা কলেজ থেকে পালিয়ে যায়। মুক্তিসেনারা তা টের পায় ১১ ডিসেম্বর ভোরে। এরপরই জয় বাংলা স্লোগানে বিজয় মিছিলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মুন্সীগঞ্জবাসী।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত