গোবর খেয়ে পাপ মোচন!
প্রকাশ: ৬ জুন ২০২৩, ১১:৫৯ | আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৩০
পার্বতীপুরে অবাঙালি হোটেলে গরুর মাংস মুখে দিয়ে আমি কদিন খুবই মর্মপীড়ায় ভুগেছি। আমি কখনও খুব বেশি ধর্মানুরাগী ছিলাম না। ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা আদিখ্যেতাও আমার নেই।
ছোটবেলা থেকেই মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে আমার যথেষ্ট ভাব-ভালোবাসা ছিল। আমাদের বাসায় মুসলমান বন্ধুদের যেমন অবাধ যাতায়াত ছিল, তেমনি মুসলিম বন্ধুদের বাসায় যেতেও আমি কখনো দ্বিধাবোধ করেনি। পাকিস্তানি জামানায় বেড়ে উঠলেও আমি কখনো 'হিন্দু' হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছি বলে মনে হয় না। তবে কারো কারো মধ্যে বিদ্বেষ ছিল না, তা নয়।সেটা বিশেষত কিছু বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল।
আজকাল 'মালাউন' শব্দটা যত কানে আসে ছোটবেলায় তত আসতো না। হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছি বলেই আমি হিন্দু। মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলে হতাম মুসলমান।
আমার জন্মের ওপর যেমন আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, তেমনি আমার ধর্ম বিশ্বাসটাও আমার ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে আমার ওপর বর্তেছে। আমি হিন্দু বলে কখনো এটা দাবি করিনি যে, আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ। আবার আমার কোনো মুসলিম বন্ধুও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে কখনো মারমুখী আচরণ করেনি।
আমরা উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে শান্তিতেই দিন কাটিয়েছি বলে মনে পড়ে।
তারপরও ওই অল্প বয়সে গরুর মাংস মুখে দিয়ে আমার খারাপ লেগেছে। অস্বস্তি লেগেছে। সেটা ধর্ম বিশ্বাসের জন্য যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি প্রচলিত ধারণা বা সংস্কারবশত। হিন্দুরা গরুর মাংস খায় না। মুসলমানরা খায়। এটা কীভাবে চালু হলো তার নিশ্চয়ই 'ইতিহাস' আছে। কিন্তু আমার তাতে আগ্রহ নেই।
কোনো হিন্দু গরুর মাংস খেলে তার হিন্দুত্ব চলে যায় কি না সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না।
কেউ যদি ভুল করে খেয়ে ফেলে তাহলে তার প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই আছে। প্রায়শ্চিত্ত একটি ধর্মীয় রীতিই৷
আমার এক কট্টর হিন্দু বন্ধু একদিন বলেছিল, কোনো হিন্দু গরুর মাংস খেলে তাকে গোবর খেয়ে পাপমোচন করতে হবে।
আমার মনে হয়েছিল, আমি গরুর মাংস মুখে দেওয়ার কথা কাউকে জানালে নিশ্চয়ই আমাকে গোবর খাওয়াবে! বিষয়টি ভাবতেই আমার শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। গোবর খাওয়া - অসম্ভব।
অনেক পরে অবশ্য জেনেছিলাম, ভারতের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই গোমূত্র বা শিবাম্বু পান করতেন!
মানুষ কত বিচিত্র অভ্যাসে অভ্যস্ত ভাবতেও এখন মজা লাগে।
আমি আমার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম, আমাদের কুলপুরোহিত নরেন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাকে আমি মামা বলতাম। আমার মাকে তিনি দিদি ডাকতেন। আমাকে ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব স্নেহ করতেন। এলাকায় অবশ্য তিনি 'বাচ্চা ঠাকুর' বলেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তার বড় ছেলে গোবিন্দ চক্রবর্তী এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
নরেন মামা আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। তুমি ইচ্ছা করে কিছু করোনি। গরুর মাংস খাওনি। ব্যাপারটা তুমি চেপে যাও, ভুলে যাও।
নরেন মামার এই নিদান শুনে আমার বুক থেকে এক বিরাট পাথর নেমে গিয়েছিল। আমার বিয়ের পুরোহিতও ছিলেন নরেন মামা। তখন তিনি বিয়ের সময় আমাকে আরো একটি বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সে গল্প অন্য প্রসঙ্গে।
জীবনে পরবর্তী সময়ে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সব কিছু প্রকাশ করতে হয় না। কিছু বিষয় চেপে রাখতে হয়। আমার জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে যেগুলো আমি চেপে না গেলে বা সেগুলো প্রকাশ পেলে আমাকে বড় বিপদ বা ঝামেলায় পড়তে হতো।
তার মানে আমি মিথ্যা কথা বলি? না, বিষয়টি আমার কাছে মিথ্যা বলা নয়, বরং সাময়িক কালের জন্য সত্য গোপন করা। সত্য গোপন করা কিংবা মিথ্যা বলার মধ্যে কি বড় কোনো প্রার্থক্য আছে। এটা একটি বড় বিতর্কের বিষয়। পরে না হয় এ নিয়ে আরও দু'চার কথা বলা যাবে।
লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত