গণশিল্পীর চির বিদায়

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২১, ১২:৩৩ |  আপডেট  : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৩

করোনা কেড়ে নিল আরো একজন প্রথিতযশা মানুষকে। বাংলাদেশের গণসঙ্গীত জগতের ধ্রুবতারা ফকির আলমগীর আর নেই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৩ জুলাই রাত ১১টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। স্ত্রী, তিন সন্তান এবং দেশ বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী ভক্ত রেখে গেছেন তিনি। গণশিল্পী ফকির আলমগীরের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিএনপি মহাসিচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণস্বাস্থ্যের ট্রাষ্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

ফকির আলমগীরের মৃত্যুসংবাদ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে শোকের কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছে। একুশে পদকসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা প্রাপ্ত এই মহান শিল্পী ছিলেন বাংলাদেশের গণসঙ্গীত জগতের মহীরুহসম। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি গণসঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৫০ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধায় জন্ম নেয়া ফকির আলমগীর স্থানীয় গেবিন্দ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক পাশ করার পর সাংবাদিকতায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময়ে তিনি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে যোগ দেন এবং গণসঙ্গীত চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ফকির আলমগীর ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। সে সময় তার গাওয়া গান স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী ছাত্র জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর স্নেহধন্য ফকির আলমগীর বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে দেশ ও মানুষের সাথে আত্মীক বন্ধনে আবদ্ধ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার গাওয়া গণসঙ্গীত যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে বাড়িয়ে দিত।

স্বাধীনতার পর পাশ্চাত্য স্টাইলের সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্য মিলিয়ে ভিন্ন ধারার সঙ্গীত পপগানের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে ফকির আলমগীরের রয়েছে অসামান্য অবদান। সে সময়ে পপগুরু আযম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে মিলে পপগানের ব্যাপ্তি বৃদ্ধিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। উল্কার মতো ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। পরে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন গণসঙ্গীত চর্চা ও একে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজে। চারণের মতো গোটাদেশ ঘুরে তিনি গণসঙ্গীতকে পেঁছে দিয়েছেন গণমানুষের কাছে। আশির দশক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের গণসঙ্গীতের ধ্রুবতারা। তার কণ্ঠে উঠে আসে ভাগ্যবিড়ম্বিত সখিনা, মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী রহমতের  শোকার্ত মায়ের অব্যক্ত বেদনার কথা। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ হয়ে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে জোতদার-মহাজন, আদম বেপারীদের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের কথা। তার কণ্ঠের অমর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইল্লা আমারে’, আহারে কাল্লু মাতুব্বর’, ‘সখিনা তোর বিয়ার খবর পাইছি বাড়ি গিয়া রে’, ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়’, ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম’, ‘নাম তার ছিল জন হেনরী’, ‘আবদুল হামিদ খান ভাসানী সংগ্রামেরই একটি নাম’, ‘আবদুল হামিদ খান ভাসানী মওলানা মহান’ ‘বাজে কী মধুর সুরে বাজে বাংলাদেশি বাঁশি’ আজও মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। এসব কালজয়ী গান ফকির আলমগীরকে অনন্তকাল মানুষের হৃদয়পটে বাঁচিয়ে রাখবে।

ফকির আলমগীরের মৃত্যুতে আমাদের সঙ্গীত জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা সহসা পূরণ হবার নয়। কারণ এ ধরনের প্রথিতযশা এবং দেশপ্রেমিক ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ শিল্পী সব সময় আসে না। যুগ যুগ পরে তাদের আবির্ভাব ঘটে। তারা আসেন, কাজ করেন, তারপর জয় করেন মানুষের মন, আসন করে নেন তাদের হৃদয়ের সিংহাসনে। ফকির আলমগীর ছিলেন সেই ক্ষণজন্মা এক প্রতিভাবান গণশিল্পী। আমরা এই মহান শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত