কালো অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, অবৈধ আর্থিক প্রবাহ ও বিপর্যস্ত জনগণ

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২২, ১১:৩২ |  আপডেট  : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০৮

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন 'অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি', 'আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি', 'হিডেন ইকোনমি', 'শ্যাডো ইকোনমি' বা 'অনরেকর্ডড ইকোনমি' ফাঁদে বন্ধি। এই কালো অর্থনীতির ফাঁদে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ। অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ে ভুগছেন তারা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের বাড়তি বোঝা তাদের জন্য অসহনীয়। আর কালো টাকার মালিক, দূর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, আমলা বা রাজনীতিবিদ অবৈধভাবে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তুলেছে। অবৈধ আর্থিক বহিঃপ্রবাহের ফলে ধনী দেশগুলো ধনী হচ্ছে, আর আমাদের মতন দেশগুলো ‘ঋণফাঁদে’ পড়ে দেউলিয়া হচ্ছে। FACTI প্যানেলের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখিত অবৈধ প্রবাহের পরিসংখ্যান "বিস্ময়কর"। দেশে মূলত সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ অভাবের কারণেই ছায়া বা কালো অর্থনীতির সৃষ্টি হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার দেশের মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারে ডলারের দাম চার টাকা বেড়ে ১১৯ টাকায় উঠেছে, যা দেশের ইতিহাসে খোলাবাজারে সর্বোচ্চ। নানা পদক্ষেপে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা ঠেকাতে না পেড়ে ক্রমশ ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়নের পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম একটি কারণ অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ বা মূলধনের অবৈধ স্থানান্তর। অবৈধ আর্থিক প্রবাহের ফলে বিনিয়োগের জন্য অর্থায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলির ক্ষতি হয়। আমাদের দেশের জন্য শত শত মিলিয়ন ডলার হারানো রাজস্বের উপর প্রভাব ফেলে, যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত। প্রতি বছর প্রচুর অর্থ অবৈধভাবে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। অবৈধ অর্থপ্রবাহের সাধারণ কারণগুলি হলো কর ফাঁকি, দূর্নীতির মাধ্যমে আয়কৃত অর্থ বিদেশে প্রেরণ, আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েস, মাদক এবং চোরাচালানে জড়িত আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কগুলির অবৈধ কার্যকলাপ। আমাদের দেশ থেকে অবৈধ আর্থিক বহিঃপ্রবাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলির পাশাপাশি কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, ভারত বা সিঙ্গাপুর ৷

 বাংলাদেশিদের টাকার ‘পাহাড়’ জমেছে সুইস ব্যাংকে। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে মাত্র ১২ মাসে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ জমা করেছেন তারা। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসএনবি বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২১’বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার এ তথ্য উঠে এসেছে।  গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ আগের বছরের ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ থেকে বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার (১ সুইস ফ্রাঁ =৯৫ টাকা ৮০ পয়সা) হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। টাকার হিসাবে ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা জমা ছিল। ২০১৯ সালে বাংলাদেশিদের মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯০ টাকা হিসাবে), যা কমপক্ষে ১২টি বেসরকারি ব্যাংকের (দেশের) পরিশোধিত মূলধনের সমান। ২০১৮ সালে এ সঞ্চয় ছিল ৫ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ১৩২ কোটি টাকা কমেছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

এমন কোন বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা নেই যা এই তত্ত্বকে সমর্থন করে যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে মূল স্রোতে ফিরে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে, বিভিন্ন সরকার অন্তত ২০ বার কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে।  কিন্তু ১৮০ কোটি টাকার বেশি সাদা করা হয়নি। তাহলে এত বিপুল পরিমাণ কালো টাকা গেল কোথায়? উল্লেখ্য, নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য উত্থাপিত বাজেটেও বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি দেশে না আনলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ কর বসানোর সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এখন পর্যন্ত কালো টাকা বিনিয়োগ জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন কালো টাকার গন্তব্য মূলত অন্য দেশ। সুইস ব্যাংকে আমানত করা হয়, কানাডা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আংশিকভাবে বা ট্যাক্স হেভেন হিসাবে পরিচিত অন্যান্য দেশে, কোম্পানি গঠন বা সম্পত্তি কেনার জন্য পাঠানো হয়। বিভিন্ন দূর্নীতি গ্রস্ত ব্যক্তি, দূর্নীতি গ্রস্ত রাজনীতিবীদ, গ্রুপ অব কোম্পানী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, আবুধাবি, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে প্রচুর বিনিয়োগ করে।

তুরস্ক সম্প্রতি সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে। বাংলাদেশের অন্তত ২০০ বিত্তবান অর্থ পাচারকারী এ প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্কের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন করেছে। আরও অনেক দেশ পরোক্ষভাবে পাচারকৃত অর্থকে স্বাগত জানাচ্ছে। কানাডার বেগমপাড়ায় বাংলাদেশিদের ব্যাপক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, কানাডার বেগমপাড়ায় যেসব বাংলাদেশির বাড়ি রয়েছে, তাদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তা অথবা বর্তমান কর্মকর্তা। তারা নানা উপায়ে বিস্তর অর্থকড়ি সঞ্চয় করে কানাডায় বাড়ি ক্রয় করেছে। 

 ফ্রেডরিক স্নাইডারের মতে, বাংলাদেশে কালো টাকা পরিমাণ জিডিপির প্রায় ২৮ শতাংশ। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্যোগে ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি জরিপ চালায়। 'বাংলাদেশের অপ্রকাশিত অর্থনীতির আকার: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ' শীর্ষক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে কালো টাকার হার জিডিপির সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮১ শতাংশ পর্যন্ত। জরিপে ১৯৭৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কাল বিবেচনা করা হয়। জরিপ অনুযায়ী, অর্থের দিক থেকে সে সময় বাংলাদেশে কালো টাকা ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্থ উদ্ধারের জন্য একটি মার্কিন সংস্থা ফায়ারফক্সকে নিয়োগ করেছিল। কিন্তু কোনো সমাধান ছাড়াই শেষ হয়ে যায় এই প্রচেষ্টা। 

জিএফআই-এর তথ্য অনুযায়ী, পাচারকৃত অর্থের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ৩৩তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আনুমানিক মোট ৭৫৩৩৭০০০ ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশে অর্থ স্থানান্তরের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতিকে হুন্ডি বলা হয়। দেশের অনেক রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীর পরিবার বিদেশে থাকে। এটি পাচারকৃত অর্থের একটি কারণ। বাংলাদেশে সুশাসনের অভাবও অর্থ পাচারে ভূমিকা রাখে। কালো টাকা পাচারের পরিমাণটা জিএফআই আর আইসিআইজে জানিয়েছে কার কার টাকা কোথায় আছে, যা ‘পানামা পেপারস’ ও ‘অফশোর লিংকস’ নামে পরিচিত। আইসিআইজের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ৫৬ জনের নাম রয়েছে এ দুই তালিকায়। এদের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতা, তাদের স্ত্রীরা ও বিদেশী নাগরিক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৩.১ বিলিয়ন ডলার বা ২৬.৪ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর সরকার প্রায় ১২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত।

সাধারণ মানুষ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ে ভুগছেন, যে বোঝা তাদের জন্য অসহনীয়। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত খরচের বোঝা তাদের আর্থিক অবস্থা অসহনীয় করে তুলেছে। অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বন্ধ, দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ বা মূলধনের অবৈধ স্থানান্তর বন্ধ, জর্জরিত দুর্নীতিগ্রস্ত কালো অর্থনীতির মূলোৎপাটনের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়া উচিত সরকারের। সাধারণ মানুষের একটাই স্বপ্ন সহজ সরল জীবনযাপন। দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেঁচে থাকার জন্য তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে কঠিন সংগ্রাম করছে। দুর্নীতি, ঘুষ ও অন্যান্য অপরাধের অর্থসহ চুরি হওয়া সম্পদ অবিলম্বে দেশে ফেরত আনতে হবে। অবশ্যই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ফৌজদারি এবং আর্থিক জরিমানা আরোপ করতে হবে যারা এই ধরনের অর্থ এবং সম্পদ গ্রহণ করে, প্রেরণ করে এবং ব্যবহার করে। দুর্নীতি ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের অবশ্যই নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহি করতে হবে। অবৈধ আর্থিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত সমস্ত সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থাগুলিকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কালো অর্থনীতি ও অবৈধ আর্থিক প্রবাহের সাথে মোকাবিলাকারী বিভিন্ন সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থার কাজের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের জন্য একটি ব্যবস্থা স্থাপন করা উচিত।

 
লেখক :
কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক 
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত